কীর্তিমান পুরুষ আলহাজ্ব ইলিয়াছ চৌধুরী

মো. সোলায়মান | সোমবার , ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:০২ পূর্বাহ্ণ

মানুষ বেঁচে থাকে তাঁর কর্মে। আসা যাওয়ার এ পৃথিবীতে কতো মানুষ হারিয়ে যায় সময়ে র স্রোতে। কিন্তু কীর্তিমান মানুষ যখন মানব সেবায় আত্মনিয়োগ করে মৃত্যু বরণ করেন, তখন তাঁরা সত্যিকার অর্থে মানুষের হৃদয়ে বেঁচে থাকেন চিরদিন। নশ্বর পৃথিবীতে মানুষ অবিনশ্বর হয় তাঁর আপন কর্মগুণে। মানব কল্যাণে ব্রতীরা মানুষের মনে ঠাঁই করে নেন নিজের প্রতিষ্ঠিত কীর্তির মাধ্যমে। প্রকৃতপক্ষে মানব জীবনের সার্থকতা এখানেই। জগৎ এবং জীবনের জন্য কল্যাণকর কাজ করে পৃথিবীতে তাঁরা বেঁচে থাকেন, তাঁদের অম্লান কীর্তিই তাঁদেরকে চিরজাগরুক করে রাখে মানুষের হৃদয়ে, মননে, চিন্তা, চেতনায় এবং আদর্শে। ক্ষণস্থায়ী জীবনে যে ব্যক্তি মানবকল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে জীবনকে উৎসর্গ করেন, গৌরবময় কীর্তির স্বাক্ষর রেখে জীবনকে যিনি মহিমান্বিত করে তুলতে পারেন, তিনি সকলের কাছে সবসময়ই একজন শ্রদ্ধার মানুষ। সেই গৌরবময় কীর্তিই তাঁকে বাঁচিয়ে রাখে যুগ থেকে যুগ যুগ, অনন্তকাল। তাঁর চেয়েও তাঁর কীর্তি হয়ে ওঠে অনুকরণীয়। আলহাজ্ব ইলিয়াছ চৌধুরী দক্ষিণ ফটিকছড়ির একজন আলোকিত মানুষ, যিনি ব্রতী হয়েছিলেন স্বাধীনতা উত্তর এতদাঞ্চলে শিক্ষার আলো জ্বালাতে। লোভ লালসা আর অহমিকার বেড়াজাল ডিঙিয়ে যিনি উদ্যোগী হয়েছিলেন আলোকিত মানুষ তৈরির কারখানা গড়তে। যার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠা হয় দক্ষিণ ফটিকছড়ির জাহানপুরে ইছাপুর বাদশা মিয়া চৌধুরী ডিগ্রি কলেজ। স্বাধীনতা উত্তরকালে এ রকম একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে শিক্ষার আলো ছড়ানোর প্রত্যয়ে যিনি দৃঢ় মনোবলে এগিয়ে এসেছিলেন সকল বাধা তুচ্ছ করে, তাই তিনি সময়ের সাহসী উদ্যোক্তাই বটে। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী মোহাম্মদ আলহাজ্ব ইলিয়াছ চৌধুরীর জন্ম ১৯৪১ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ফটিকছড়ি উপজেলার জাহানপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম মরহুম আলহাজ্ব বাদশা মিয়া চৌধুরী এবং মাতার নাম মরহুমা ছালেহা বেগম। পৈতৃক সূত্রে তাঁর পূর্বপুরুষ ছিলেন ফরিদ আহমদ শাহ। তিনি ইরাকের রাজধানী বাগদাদ হতে ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে এসেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁরই উত্তরাধিকারী বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ হারিচান খানই ফরিদ আহমদ শাহের বংশধর। হারিচান খানের দ্বিতীয় পুত্র ছিলো আলহাজ্ব মরহুম মোবারক আলী চৌধুরী।
মরহুম আলহাজ্ব বাদশা মিয়া চৌধুরী ছিলেন আলহাজ্ব মরহুম মোবারক আলী চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র। মরহুম আলহাজ্ব বাদশা মিয়া চৌধুরীর প্রথম পুত্র ছিলেন মরহুম আলহাজ্ব ইলিয়াছ চৌধুরী। তাঁর জীবনের শৈশব কৈশোর কেটেছে সেই গ্রামের নিবিড় আলো বাতাসে। শিক্ষা জীবনে তিনি তৎকালীন জাহানপুর আমজাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয় হতে এস.এস.সি এবং তৎকালীন সিটি কলেজ হতে এইচ.এস.সি পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর তিনি পারিবারিক ব্যবসায় আত্মনিয়োগ করেন। চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র জেল রোডে ছাতা তৈরির কারখানা স্থাপনের মধ্যদিয়ে তাঁর ব্যবসায়িক জীবন শুরু। পরবর্তীতে তিনি আমদানি-রপ্তানি ব্যবসায়ে নিজেকে নিয়োজিত করেন। তৎকালীন সময়ে চট্টগ্রামের ব্যবসার প্রাণ কেন্দ্র চাক্তাই-খাতুনগঞ্জ কেন্দ্রীক আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করে এতদাঞ্চলের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ীতে পরিণত হন এবং দেশের আরো অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীর সান্নিধ্যে আসেন।
তৎকালীন সময়ে তাঁর ব্যবসায়ের সহযোগী ছিলেন আনোয়ারার সাবেক এমপি ও বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ মরহুম আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, সীতাকুণ্ডের সাবেক এমপি ও বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মরহুম আবুল কাসেম মাস্টার, বর্তমান প্যাসিফিক গ্রুপের চেয়ারম্যান নাসির সাহেব, বর্তমান ক্লিপটন গ্রুপের চেয়ারম্যান কামাল সাহেবসহ আরও অনেক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। শিক্ষাব্রতী এ মানুষ শুধু অর্থমোহে নিজেকে সমর্পণ না করে ভেবে ছিলেন কীভাবে মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা যায়। তিনি ১৯৭২ সালে অবিভক্ত বক্তপুর ইউনিয়নকে বিভক্ত করে জাফতনগর ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা করেন এবং পরবর্তীতে তিনি বিপুল ভোটে এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। তিনিই এই ইউনিয়নের প্রথম নির্বাচিত প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। এই জাফতনগর ইউনিয়নের নাম করণেও তাঁর দূরদর্শিতার পরিচয় মেলে। এই ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম জাহানপুর, ফতেপুর ও তেলপারই নাম এর তিনটি প্রথম আদ্যাক্ষর নিয়ে তিনি (‘জা’ ‘ফ’ ‘ত’) জাফতনগর নামকরণ করেন। চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে এলাকার রাস্তাঘাট সেতু নির্মাণ সহ উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। জনশ্রুতি আছে তিনি ঐ সময়ে ব্যাপক উন্নয়নের জন্য জনদরদী, সমাজসেবী, গরীব ও মেহনতি মানুষের প্রতিনিধি ও একজন দানবীর হিসাবে পরিচিতি পান। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তাঁর এ সুখ্যাতি অক্ষুণ্ন ছিলো। সমাজব্রতী এ শিক্ষানুরাগী ১৯৭২ সালে এলাকার অনগ্রসর জনগোষ্ঠীতে শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে এলাকার মানুষের জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাঁর দুই ভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা মরহুম আইয়ুব বাঙালি ও বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আলহাজ্ব ওমর ফারুক চৌধুরীসহ সম্পূর্ণ নিজস্ব অর্থায়নে তাঁদের মরহুম পিতার নামে ইছাপুর বাদশা মিয়া চৌধুরী কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠানটির এমপিও ভুক্তির পূর্বকাল ১৯৭৯ পর্যন্ত তিনি নিজস্ব অর্থায়নে শিক্ষকদের বেতনভাতা পরিশোধসহ যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। এই প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে এলাকার শিক্ষা বিস্তারে রেখে যাচ্ছে তার অগ্রণী ভূমিকা এবং শিক্ষা লাভ করা ছাত্রছাত্রীরা দেশ ও জাতির কল্যাণে অবদান রেখে যাচ্ছেন নিরন্তর। এ ছাড়াও তিনি এলাকার বিভিন্ন শিক্ষা, সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি ১৯৭৩-১৯৭৭ সাল পর্যন্ত জাহানপুর আমজাদ আলী-আবদুল হাদী ইনস্টিটিউশান এর সভাপতিসহ স্কুল পরিচালনা কমিটির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর ‘বড় জ্যাঠা’(মরহুম আমজাদ আলী চৌধুরী ’র) নামে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় তিনি নিজস্ব অর্থায়নে ভবন নির্মাণ করেন। আমজাদিয়া প্রাথমিক বিদ্যালয়েও তিনি ভবন নির্মাণ করে দেন। আমজাদিয়া মসজিদ নির্মাণেও এলাকাবাসীর সহযোগিতা নিয়ে তিনি মসজিদ সংস্কারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এছাড়া তিনি উল্লেখিত মসজিদ, মাদ্রাসা, প্রাইমারি স্কুল পরিচালনায় প্রায় ত্রিশ বছর যাবৎ সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৭ নং জাফত নগর এবং ১৮ নং ধর্মপুর ইউনিয়নের কিছু অংশের সমন্বয়ে গঠিত প্রায় চৌদ্দ মহল্লার সম্মিলিত বিবির দিঘির পাড় ঈদগাহ পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসাবে মৃত্যু পূর্বকালীন পর্যন্ত দায়িত্বে সমাসীন ছিলেন। তাঁর দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বিবির দিঘির পাড় ঈদগাহের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠকও ছিলেন। তাঁর পৈতৃক বাড়ির কাচারি ছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। তিনি এবং তাঁর আপন ছোট ভাই তৎকালীন সময়ের চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব বাঙালি এলাকার যুব সমাজকে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুপ্রাণিত করে তাঁর পৈতৃক খামার বাড়িতে প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতেন। দূর দুরান্ত ও বিভিন্ন থানা জেলা থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের তিনি তাঁর পৈতৃক খামার বাড়িতে আশ্রয় দিয়ে খাওয়া দাওয়াসহ রসদ যোগান দিতেন।
ভারতের আসাম, গুহাটি, আগরতলা, হরিণা ক্যাম্প হতে মুক্তিযোদ্ধারা ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ১ নং সেক্টর ফটিকছড়ি সীমান্ত সড়ক হয়ে তাঁর খামার বাড়িতে এসে আশ্রয় নিতেন এবং এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিতেন। এই আশ্রয় কেন্দ্র হতে মুক্তিযোদ্ধারা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে অপারেশনের জন্য ছড়িয়ে যেতো। সর্বোপরি তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক, মানসিক ও পারিবারিকভাবে নানা রকমের সাহায্য সহযোগিতায় হাত বাড়িয়েছেন উদারভাবে। এলাকার গরীব দুঃখী, অনাথ ছেলে মেয়ে, অর্থাভাবে পড়াশুনায় অক্ষমসহ নিপীড়িত মানুষের পাশে তাঁকে দেখা গেছে সবসময় একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে। আলহাজ্ব মরহুম ইলিয়াছ চৌধুরী আপন কর্মে সমুজ্জ্বল এক ব্যক্তিত্বের নাম। যিনি উপলব্ধি করেছিলেন শিক্ষাই হচ্ছে জাতির ভাগ্য পরিবর্তনের নিয়ামক। তাই এলাকার মানুষকে সুশিক্ষিত করে তোলার যে আন্তরিক প্রয়াস তাঁর ছিলো, সে উঁচু মনের মানুষ আজ সমাজে বিরল। অর্থবিত্ত ও আত্মকেন্দ্রিকতার যুগে তিনি সমাজ সেবার এক অনন্য উদাহরণ। একজন দেশপ্রেমিক, ধর্মপ্রাণ মানুষ হিসাবেও তিনি সকলের কাছে সবসময় অনুকরণীয়। তিনি শেষ বয়সে ৪৫ বছর এক নাগাড়ে প্রতি রমজান মাসে এতেকাফ গ্রহণ করতেন। তিনি জীবনের শেষ বয়সেও চমশা ছাড়া পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তেন। তিনি তবলীগ জামাতের আমিরও ছিলেন। কীর্তিমান এই ব্যক্তি সকলকে শোকের সাগরে ভাসিয়ে, তিন পুত্র, আট কন্যা ও নাতি নাতনী রেখে ৬ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ইন্তেকাল করেন। আমি তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আমিন।
লেখক : সভাপতি, ইছাপুর বাদশা মিয়া ডিগ্রি কলেজ গভর্নিং বডি, ফটিকছড়ি, চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআসুন নিজে একটু সচেতন হই
পরবর্তী নিবন্ধ‘এই কথাটি মনে রেখো… আমি যে গান গেয়েছিলেম’