২২ দিনের জন্য ইলিশ মাছ ধরা গতকাল বুধবার থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইলিশ মাছের প্রজনন নির্বিঘ্ন করতে গত বেশ কয়েক বছর ধরে এই নিষেধাজ্ঞা দেয়া হচ্ছে। এই বছর নিষেধাজ্ঞা চলবে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময় মাছ ধরা, বিক্রি, বিপণন, মজুত ও পরিবহন নিষিদ্ধ থাকবে। এর লঙ্ঘন করা হলে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু ইলিশ ধরা থেকে বিরত রাখার ফলে ইলিশের প্রজননে সেটা কি ভূমিকা রাখছে?
ইলিশ গবেষকরা বলছেন, এই সময়ে ইলিশ ধরা থেকে বিরত থাকার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে মা ইলিশ রক্ষা করা, যাতে তারা নিরাপদে নদীতে ডিম ছাড়তে পারে। এই ডিম রক্ষা করতে পারলে তা নিষিক্ত হয়ে জাটকার জন্ম হবে। সেই জাটকা রক্ষা করা গেলে দেশে বড় আকারের ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের ইলিশ বিষয়ক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান বলছেন, ঠিক এই সময়টাতে মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে শুরু করে। একটা মা ইলিশ চার থেকে পাঁচ লক্ষ ডিম ছাড়ে। আমাদের পরীক্ষা নিরীক্ষা বলছে, শুধুমাত্র গতবছরে অন্তত ৭ লাখ ৪০ হাজার কেজি ডিম ছাড়া হয়েছে। সেগুলো বড় হওয়ার সুফল এই বছর আপনারা দেখতে পেয়েছেন। ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে ১০ বছরে : বিজ্ঞানীরা ধরে নেন, এর অর্ধেক যদি নিষিক্ত হয়, তার মধ্যেও ১০ শতাংশ যদি বাঁচে, তাহলে ৩৭ হাজার কোটি ইলিশ পোনা বা জাটকা পাওয়া যায়। সেটা যে হয়েছে, তার প্রমাণ আমরা পাচ্ছি। সেটা না হলে দিনের পর দিন এরকম বড় বড় ইলিশ, এতো ইলিশ ধরা পড়তো না, বলছেন ড. রহমান।
এই বছর বাংলাদেশের বাজারে অনেক কম দামে বড় আকারের ইলিশ মাছ বিক্রি হয়েছে। নদী ও সাগরে তুলনামূলকভাবে বেশি বড় ইলিশও ধরা পড়েছে। আগে যেখানে এক কেজির ওপরের ইলিশের কেজি কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি হতো, এই বছর বাংলাদেশে সেটা হাজার টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। ঢাকার একজন গৃহিণী ইলোরা চৌধুরী বলছেন, কখনোই এত কম দামে এরকম বড় বড় ইলিশ কেনার সুযোগ পাইনি। আবার ইলিশগুলোও অন্য সময়ের তুলনায় বেশ পুষ্ট, সুস্বাদু। গত বছর এই ধরনের ইলিশ তাকে দেড় থেকে দুই হাজার টাকায় কিনতে হয়েছে বলে জানান ইলোরা চৌধুরী।
ইলিশ মাছ আকারে যত বড় হবে, তত তার স্বাদ বেশি হবে। আকারে বড় ইলিশকে অনেকে পাকা ইলিশ বলে অভিহিত করে থাকেন। ইলিশ গবেষক ড. আনিসুর রহমান, ইলিশের উৎপাদন যে বেড়েছে, সেটা তো এখন সবাই বুঝতে পারছে। সেই উৎপাদন বাড়ার পেছনে যেসব কারণ আমরা দেখতে পেয়েছি, তার মধ্যে এই ২২ দিনের ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞাটি সবচেয়ে বেশি কার্যকরী। বাংলাদেশে ২০০৩-২০০৪ সাল থেকেই জাটকা রক্ষার কর্মসূচি শুরু করা হয়। তখন থেকেই আস্তে আস্তে ইলিশের উৎপাদন বাড়ছিল।
২০০৮ সাল থেকে প্রথম আশ্বিন মাসে পূর্ণিমার আগে পরে মিলিয়ে ১১দিনের ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। তখন থেকেই এর সুফল দেখতে শুরু করেন বিজ্ঞানীরা। তখন তারা গবেষণায় দেখতে পান যে, শুধু পূর্ণিমায় নয়, এই সময়ের অমাবস্যাতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। পরবর্তীতে পূর্ণিমার সঙ্গে অমাবস্যা মিলিয়ে টানা ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেয়া শুরু হয়। ২০১৪-২০১৫ সালের পর থেকে কিন্তু ইলিশের উৎপাদন ক্রমান্বয়ে বেড়ে আসছে। রাতারাতি উৎপাদন অনেক বেড়ে গেছে। কারণ আইনটা আগে থাকলেও ওই সময় থেকে কড়াকড়িভাবে তা পালন করা শুরু হয়, বলেন আনিসুর রহমান।
২০১৯ সালে ৫ লাখ ৩৩ হাজার মেট্রিকটন ইলিশ উৎপাদন হয়েছে বলে তিনি জানান। আগেও ইলিশ পাওয়া যেতো, কিন্তু এখন উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি প্রচুর বড় বড় ইলিশ আসছে, পরিমাণে বেশি, আকারে বড়, তিনি বলছেন।
মীরসরাই থেকে শুরু করে ভোলার লালমোহন উপজেলা পর্যন্ত ইলিশের সবচেয়ে বড় প্রজনন ক্ষেত্র। বিশেষ করে মনপুরা, ঢালচর, বালিরচর, মৌলভীরচর-এগুলো হচ্ছে ইলিশের ডিম ছাড়ার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। চট্টগ্রাম, ভোলা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, চাঁদপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা মিলিয়ে প্রায় ৭ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকায় ইলিশ মাছ সবচেয়ে বেশি ডিম ছাড়ে। এর বাইরের উপকূলের অন্যান্য নদীগুলোতেও ইলিশ ডিম ছাড়ে। মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ পর্যবেক্ষণ সেলের হিসেবে ১৫ বছর আগে দেশের ২৪ টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণ ছিল। এখন দেশের অন্তত ১২৫ টি উপজেলার নদীতে ইলিশের বিচরণের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইলিশ মাছ ডিম ছাড়ার পর জাটকা বড় হয়ে আবার সাগরে ফিরে যায়। পরে সেগুলো বড় হলে ডিম ছাড়ার জন্য আবার নদীতে ফিরে আসে। বাংলাদেশের জিডিপিতে এর অবদান এক শতাংশের মত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউটের তথ্যানুযায়ী এই মুহূর্তে দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের প্রায় ১২ শতাংশ আসে ইলিশ থেকে।