জব্বারের বলীখেলাকে ঘিরে তিনদিনের বৈশাখী মেলায় কী নেই! পোড়ামাটির ফুলের টব, জগ, গ্লাস, শোপিস, হাতপাখা, শীতল পাটি, দা, বঁটি, খেলনা, টমটমের গাড়ি, শিমুল তুলা, সংসারের টুকিটাকি থেকে শুরু করে ফলসহ গাছের চারা বিক্রির জন্য নিয়ে এসেছেন প্রত্যন্ত অঞ্চলের বেপারী, দোকানি ও গৃহস্থরা। প্রতি বছরই জব্বারের বলী খেলাকে কেন্দ্র করে বসা এ মেলা আগেভাগেই জমে উঠে। এবারও জমে উঠেছে এই মেলা।
বলীখেলাকে ঘিরে চলছে তিন দিনব্যাপী শত বছরের পুরনো ঐতিহ্যবাহী বৈশাখী মেলা। মেলা শুরুর প্রথমদিন থেকে উৎসবের আমেজ বিরাজ করছে এই অঞ্চলের মানুষের মাঝে। গতকাল দ্বিতীয় দিনে লোকেলোকারণ্যে পরিণত হয় মেলা ।
ঘুরে ঘুরে দেখা যায়, সুঁই থেকে শুরু করে ‘ফুলশয্যার খাট’ সব কিছুই পাওয়া যায় জব্বারের বলীখেলার বৈশাখি মেলায়। এবারও মেলা মেলা শুরুর এক–দুই দিন আগে থেকেই ঢাকাসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা ট্রাকে ট্রাকে পণ্য নিয়ে এসেছেন। জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে এবার আনুষ্ঠানিক ভাবে বৈশাখী মেলা বসেছে গত বৃহস্পতিবার থেকে। আজ শনিবার সারাদিন চলবে বৈশাখী মেলা।
মেলায় হৃদয়কাড়া মৃৎশিল্প, কুটির শিল্প, গ্রামীণ নানা পণ্যসামগ্রী দেখেই গত দুইদিন ধরে ভিড় করছেন ক্রেতারাও। নগরের লালদীঘি মাঠে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী এই খেলার ১১৬তম আসর। এই খেলা উপভোগ করতে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে এসেছেন হাজারো মানুষ।
গতকাল শুক্রবার বিকেলে মেলায় গিয়ে দেখা গেছে, নানা বয়সী ক্রেতা বিক্রেতারা ব্যস্ত সময় পার করছেন মেলায়। লালদীঘির আশপাশের এলাকায় পসরা সাজিয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা দোকানিরা। সিনেমা প্যালেস থেকে লালদীঘি মোড় হয়ে শাহ আমানত মাজার গেট; অন্যদিকে টেরি বাজার এলাকা থেকে কোতোয়ালী মোড় পর্যন্ত বসেছে মেলার দোকানপাট। নারী–পুরুষ, শিশু সবাই ঘুরে ঘুরে পছন্দ মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছেন মেলা থেকে। দেশের বিভিন্ন স্থানে উৎপাদিত লোকজ পণ্যে মেলা জমে উঠেছে। ফুলের ঝাড়ু, হাতপাখা, বেতের তৈরি খাঁচা কিংবা মাটির তৈরি তৈজষপত্র সবকিছুই থরে থরে শোভা পাচ্ছে মেলায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, কে,সি দে রোডে আগেভাগেই পছন্দের জায়গায় মাটির তৈরি তৈজষপত্রের স্টল বসিয়েছেন টাঙ্গাইলের গোবিন্দ।
গত বুধবার বরিশাল থেকে ৭ জন মিলে নিয়ে এসেছেন ২৬ পদের জিনিস নিয়ে। তিনি জানান, বরিশাল থেকে ২৫ হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিয়ে এসেছি। এখানে আসা, বসা প্রতিদিনের বিভিন্ন খরচ মিলে অনেক টাকা খরচ হয়েছে। অন্যান্যবার ৫ থেকে ৬ দিন অবস্থান করলেও এবার ৩ দিনের মেলা হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন এই বেপারী।
অপরদিকে ঢাকা থেকে আসা শাকিল রহমান জানান, ১৫০ পদের মাটির তৈরি তৈজষপত্র নিয়ে তিনদিন ৪ দিন আগে চট্টগ্রামে এসেছেন তারা। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার জিনিস এনেছেন। তিনি বলেন, প্রথম দিনের চেয়ে আজ (গতকাল শুক্রবার) বিক্রি ভালো। শনিবারও বিক্রি হবে বলে আশা শাকিলের।
অপর দিকে সাভার, গাজীপুর থেকে মৃৎশিল্পী সুজিত ও দেবরাজ এসেছেন পোড়ামাটির সামগ্রী নিয়ে। যে কারো দৃষ্টি কাড়ে তাদের মাটির তৈরি ফুলদানি, ব্যাংক, কলসিসহ নানান তৈজষপত্রে। অনেকেই কলসিসহ অন্যান্য পণ্যে রং করার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
লালদীঘি মাঠে আয়োজিত বলীখেলা ও আশপাশের প্রায় এক কিলোমিটার জুড়ে বসা বৈশাখী মেলায় লোকজন আসা শুরু করে। দেখতে দেখতে বিকেল গড়াতেই ঐতিহ্যবাহী জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা ঘিরে লাখো মানুষের সমাগম ঘটে।
মেলায় কথা হয় আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালের সামনে বাঁশের তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পের পসরা নিয়ে বসা রহমান শরীফের সঙ্গে। তিনি জানান, নরসিংদী জেলার জুহুরিয়াকান্দা এলাকা থেকে ১২ জনের একটি দল স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বাঁশের তৈরি কুলা, ডালা, টুকরি, চাটাই, চালুনি, হাতপাখা, ঝুঁড়িসহ বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্য নিয়ে এসেছেন গত বুধবার বিকেলে। প্রতিবছর এই মেলার জন্য ৬ মাস ধরে প্রস্তুতি নেন তারা।
মমতাজ আলী বলেন, প্রায় দেড় যুগ ধরেই প্রতিবছর জব্বারের বলীখেলা উপলক্ষে আয়োজিত এই মেলায় আসেন তারা।
দোকানিরা জানান, লোকসমাগম আছে; তবে অন্যান্যবারের চেয়ে এবার বেচাবিক্রি কম। বলা হয়ে থাকে, এ জনপদের গৃহস্থরা জব্বারের বলীখেলার মেলার থেকেই এক বছরের গৃহস্থালির সকল পণ্য কিনে থাকেন।
বিকেল ৪টার দিকে লালদীঘি মাঠে বলীখেলা প্রতিযোগিতার উদ্বোধনের মাধ্যমে জমে উঠেছে আয়োজনের মূল পর্ব। সিএমপি কমিশনার হাসিব আজিজ এই খেলার উদ্বোধন করেন।
বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সদস্যসচিব ও আব্দুল জব্বারের নাতি শওকত আনোয়ার বাদল বলেন, এবার বলীখেলায় ১২০ জন নিবন্ধন করেছেন। তাঁদের মধ্যে ৮০ জনকে বাছাই করে প্রতিযোগিতার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। এই ৮০ জনের মধ্য জয়ী ৪০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়েছে। গতবারের শীর্ষ চারজন ও নতুন চারজন চ্যালেঞ্জ রাউন্ডে খেলেছেন। তাঁদের মধ্যে চারজন সেমিফাইনালে খেলেছেন।
খেলা শেষে জয়ীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ করেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র শাহাদাত হোসেন।