গাজীপুরে প্রকাশ্যে এক ব্যক্তির ওপর হামলা–কোপানোর ঘটনার ভিডিও ধারণ করায় সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। এ ঘটনায় পাঁচজনকে আটক করেছে পুলিশ। গাজীপুর মহানগর পুলিশের বাসন থানার ওসি শাহিন খান গতকাল শুক্রবার দুপুরে বলেন, ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহভাজন পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এখনই তাদের নাম–পরিচয় প্রকাশ করা হচ্ছে না। তুহিনের বড় ভাই মো. সেলিম অজ্ঞাত আসামি করে বাসন থানায় হত্যা মামলাটি করেছেন। ওসি জানান, বর্তমানে ভিডিও ফুটেজের সঙ্গে মিলিয়ে তাদের শনাক্তকরণের কাজ চলছে।
এদিকে ছোট ছেলে তুহিনকে হারিয়ে পাগলপ্রায় বৃদ্ধ বাবা মো. হাসান জামাল আহাজারি করছিলেন, কী অপরাধ করেছিল আমার ছেলে? কী অন্যায় করেছিল সে? কেন এমন হলো? আমি কারো ক্ষতি চাই না। তোমরা আমার ছেলেকে এনে দাও। বয়সের ভারে প্রায় ৮০ বছরের এই বৃদ্ধ ভালোভাবে চলাফেরাও করতে পারেন না। ছেলের মৃত্যুর সংবাদ শোনার পর থেকেই বারবার মুর্ছা যাচ্ছিলেন। প্রতিবেশী–স্বজনরা তাকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছিলেন। খবর বিডিনিউজের।
হাসান জামাল ও সাবিহা খাতুন দম্পত্তির পাঁচ ছেলে আর দুই মেয়ের মধ্যে তুহিন ছিলেন সবার ছোট। ২০০৫ সাল থেকে তিনি পরিবার নিয়ে গাজীপুরের চান্দনা এলাকায় বসবাস করে আসছিলেন। দৈনিক প্রতিদিনের কাগজ পত্রিকার গাজীপুর প্রতিনিধি হিসেবে কাজের পাশাপাশি ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধির কাজও করতেন।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে গাজীপুর মহানগর পুলিশের উপ–কমিশনার রবিউল ইসলাম বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনা এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা মতে দেখা যায়, সন্ধ্যা ৭টার দিকে বাদশা মিয়া নামে এক ব্যক্তি চান্দনা চৌরাস্তা মোড়ে এক নারীর সঙ্গে বিবাদে জড়ান। এ সময় বাদশা মিয়া ওই নারীকে আঘাত করেন। তখন একদল দুর্বৃত্ত নারীর পক্ষ নিয়ে ধারালো চাপাতি হাতে বাদশা মিয়াকে আঘাত করলে তিনি দৌড়ে পালিয়ে যান। আর এ ঘটনাটি রাস্তার পাশ থেকে মোবাইলে ভিডিও করছিলেন সাংবাদিক তুহিন।
তিনি বলেন, তখন সন্ত্রাসীরা তুহিনকে দেখে ফেলে ভিডিও মুছে ফেলতে বলে। তবে তুহিন ভিডিও মুছতে অস্বীকার করলে তাকে ধাওয়া দেয় সন্ত্রাসীরা। এ সময় তুহিন দৌড়ে পালাতে থাকে। সন্ত্রাসীরাও তার পিছু নিয়ে ধাওয়া করে। এক পর্যায়ে চান্দনা চৌরাস্তার মসজিদ মার্কেটের সামনে একটি দোকানের কাছে সন্ত্রাসীরা ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে তুহিনের মৃত্যু নিশ্চিত করে চলে যায়।
আসাদুজ্জামান তুহিন স্ত্রী মুক্তা আক্তার ছাড়াও সংসারে দুই ছেলে তৌকির (৭) ও ফাহিমকে (৩) রেখে গেছেন। স্বজনরা জানান, আসাদুজ্জামান তুহিন ২০০৫ সালে ফুলবাড়িয়া আল হেরা স্কুল থেকে এসএসসি, ২০০৭ সালে সিলেট এম সাইফুর রহমান কলেজ থেকে এইচএসসি পাসের পর গাজীপুর ভাওয়াল কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) করে সেখানে ভাই জসিম উদ্দিনের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। পরে ওষুধ কোম্পানির চাকরি শুরু করেন। ২০১২ সাল থেকে তিনি সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত হন।
তুহিনের হত্যার খবর ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে পরিবারের সদস্যদের কান্না ও আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের আবতারণা হয়। আশপাশ থেকে রাতেই তুহিনের বাড়িতে ছুটে আসেন প্রতিবেশী ও স্বজনরা। তুহিনের বাবা–মা, ভাই–বোনদের সান্ত্বনা দিতে গিয়ে তারাও কান্নায় ভেঙে পড়েন।
স্বজনরা জানান, বাড়ির সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তুহিনের। প্রায় প্রতিদিন বাবা–মায়ের সঙ্গে কথা বলতেন। বুধবারও কথা বলার সময় মাকে চোখের চিকিৎসক দেখানোর কথা বলেছিলেন। ছেলে হত্যার খবর শোনার পর থেকে ৭৫ বছর বয়সী সাবিহা খাতুন বুক চাপড়ে আহাজারি করছিলেন। বিলাপ করতে করতে বলছিলেন, আমার তুহিন কালকে (বুধবার) বলেছে, আমি তোমাকে আগামী মাসে চোখের ডাক্তার দেখাব। ডাক্তার অপারেশন করানোর কথা বললে অপারেশন করাব। আম্মা কোনো চিন্তা করো না। তুমি ভালো হয়ে যাবে। আমার তুহিনরে মাইরা ফেলাইছে। আমার বাবারে মাইরা ফেলাইছে। আমি এর বিচার চাই।
গতকাল দুপুরে তুহিনদের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, পাশাপাশি কয়েকটি ঘরে তারা বসবাস করেন। বাবা–মা বাড়িতেই থাকেন। সারা বাড়িজুড়ে কান্নার রোল। তুহিনের বোন সাইদা আক্তার রত্না কাঁদতে কাঁদতে বলছিলেন, মাঝে মাঝে আমাদের খোঁজ–খবর নেয়। আমার ভাই কোনোদিন কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিন না। কখনো খারাপ ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিত না, কেন আমার ভাইকে হত্যা করা হলো? আমার ভাইয়ের কী অপরাধ ছিল? আমার ভাইকে যারা হত্যা করেছে, তাদের ফাঁসি চাই।
২০০৯ সালের দিকে তুহিনের বড় ভাই জসিম উদ্দিন ক্যান্সার আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। গাজীপুরে তুহিনের সঙ্গে তার আরেক ভাই সেলিম উদ্দিনও বসবাস করেন। সেলিম পরিবহন শ্রমিকের কাজ করেন। দ্বিতীয় ভাই জাহাঙ্গীর আলম কঙবাজারের টেকনাফে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। অন্য ভাই শাজাহান মিয়া সিলেটে বসবাস করেন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় বতর্মানে গ্রামের বাড়িতে বৃদ্ধ বাবা ও মা বসবাস করেন। তারা বার্ধক্যজনিত নানা রোগে আক্রান্ত। ছেলেরাই তাদের দেখভাল করে আসছিলেন।
শুক্রবারই বাড়ি ফিরলেন, তবে নিথর দেহে সাংবাদিক আসাদুজ্জামান তুহিনকে চোখের জলে বিদায় দিয়েছেন স্বজনরা। তাকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলায় দাফন করা হয়েছে। গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে উপজেলার ভাটিপাড়া গ্রামে বাড়ির পাশে দ্বিতীয় জানাজা শেষে সামাজিক কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়। এ সময় স্বজন–প্রতিবেশীদের কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। এর আগে বিকাল সোয়া ৫টার দিকে তুহিনের মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স গ্রামের বাড়িতে পৌঁছায়। তাকে একনজর দেখতে শত শত মানুষ সেখানে ভিড় করেন।
স্বজনরা বলছিলেন, গাজীপুর থেকে শুক্রবার বাড়িতে ফিরে বাবা–মায়ের সঙ্গে দুপুরে খাবার খাওয়ার কথা ছিল তুহিনের। তিনি ঠিকই ফিরেছেন, তবে নিথর দেহে।
বাদ মাগরিব তুহিনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, এভাবে একজনকে কুপিয়ে হত্যা করা কোনোভাবেই কাম্য নয়।