এই লেখাটির শুরুতেই আমরা কয়েকটি সমীক্ষার তথ্য–উপাত্ত জানব। বাংলাদেশ ব্রেস্টফিডিং ফাউন্ডেশন, পাবলিক হেলথ ইন্সটিটিউট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়সহ কয়েকটি সংস্থার পরিচালিত যৌথ গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ১৩–১৯ বছর বয়সী শহুরে ছেলেমেয়েদের ৬০ শতাংশের বেশি মাঝারি থেকে তীব্র মানসিক চাপে ভোগে। বিএসএমএমইউ (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস ২০২৩ উপলক্ষে বিভিন্ন গবেষণার ফলাফল উপস্থাপন করেছে। সেখানে বলা হচ্ছে দেশে ১০০ জন কিশোর–কিশোরীর মধ্যে ৫২ জনের স্বাস্থ্যের মান খারাপ। বিএমসি সাইকিয়াট্রিতে প্রকাশিত একটি গবেষণা অনুসারে বাংলাদেশের স্কুলগামী কিশোর–কিশোরীদের ৭৩.৫ শতাংশরই মানসিক চাপজনিত কোনো না কোনো লক্ষণ দেখা গেছে। অর্থাৎ আমাদের কিশোর–কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্য আশঙ্কাজনকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। বলাবাহুল্য, সন্তানদের এ ধরনের মানসিক চাপের ব্যাপারে পরিবারে বা অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম।
এবারে আমরা বিষয়টি নিয়ে আরো একটু স্তরায়ন করব, দেখার চেষ্টা করব কিশোরী–স্বাস্থ্য এখানে কতোটা হুমকির মুখে। আমরা লক্ষ্য করলে দেখব কিশোরদের চেয়ে আমাদের দেশে কিশোরীরা শান্ত মনের এবং ক্ষেত্রবিশেষে বেশ অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্নও। তারপরও আমাদের কিশোরীরা মানসিকভাবে সংকটে ভুগছে, তাদের মানসিক স্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কেন? সোশ্যাল মিডিয়া কি তাদের দুর্ভোগের একটি কারণ? পুরুষরাই কি তাদের সমস্যার অংশ? পরিবার কি তার মনোজগত বুঝতে পারছে না? সমীক্ষায় দেখা গেছে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে মেয়েদের মানসিক চাপ ছেলেদের চেয়ে বেশি ছিল। এই মানসিক চাপের ফলে তাদের শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়। কিশোরীদের একটি বড় অংশ বিষণ্নতা বা অবসাদে ভোগে। পুরুষের কাছ থেকে যৌন হয়রানির ভয়, অবাঞ্চিত বন্ধুত্ব এবং ভয়ঙ্কর হুমকির সম্মুখীন হয় কিশোরীরা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ কিশোরীদের মধ্যে নিয়মিত খেলাধুলা করার হার কম। কিশোরীদের মানসিক চাপের ব্যাপারে পরিবারে বা অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা খুবই কম। ফলে মানসিক চাপ সামলাতে পরিবার, সমাজ এবং স্কুলের সহায়তাও খুবই কম পায় তারা। বয়ঃসন্ধিকালে কিশোরীরা নানারকম মানসিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। আর হরমোনের নানা পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত হয় পরিবার ও সমাজের প্রত্যাশার চাপ। মানসিক চাপ বোধ করে পড়াশোনা নিয়েও। এছাড়া ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তা, স্কুলের পরীক্ষার ফলাফল এবং রোমান্টিক সম্পর্কের কারণেও মানসিক চাপে পড়ে তারা। নিজেদের শারীরিক অবয়ব অর্থাৎ তাদের কেমন দেখাচ্ছে সেটা নিয়েও কিশোরীরা মানসিক চাপে থাকে। মা–বাবার মানসিক দূরত্ব, নাগরিক জীবনে একক পরিবার কাঠামোর কারণে তৈরি একাকীত্ব, স্কুলে বা অবসর সময়ে সমবয়সীদের সঙ্গে দ্বন্দ্ব, ইত্যাদি কারণেও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়। মানসিক চাপের কারণে কিশোরীদের জীবনে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়ে। প্রায়শই নিজেদের সমস্যার কথা পরিবারের সদস্যদেরকে বলতে পারে না। কখনো কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে বন্ধু বা সমবয়সীদের ওপর নির্ভর করে। আমাদের দেশে কিশোরীরা সমাজের বিভিন্ন নিয়মের বেড়াজালে অতিরিক্ত চাপের সম্মুখীন হয়, যা তাদের মানসিক সমস্যার অন্যতম কারণ। এর প্রভাবে আত্মহননের প্রবণতাও দেখা দেয়। কিশোরীরা যেসব সমস্যাগুলো ভোগ করে তার মধ্যে একটি হল যৌন হুমকি। সমাজে অনেক লোক নারীর দেহকে যৌনতার উপকরণ হিসাবেই দেখে। এই সমস্ত কারণে কিশোরীদের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয় বিভিন্ন বিধিনিষেধ, নিয়ম–কানুন। কিশোরীরা অশ্লীল রসিকতা, অনুপযুক্ত স্পর্শ, যৌন হুমকি বা সহিংসতার শিকার হয়। এতে তারা মানসিকভাবে অসুস্থ বোধ করতে থাকে, বিষণ্নতার মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকে, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক। প্রশ্ন হতে পারে, কিশোরীরা স্বাভাবিক আবেগ প্রকাশ করতে ততটা উৎসাহিত নয় কেন? কারণ আমরা বাবা–মা, বয়স্কজন বা পূর্ববর্তী প্রজন্ম তা গ্রাহ্য করে না। কিশোরীরা সাধারণত বিষণ্নতা এবং উদ্বেগ দ্বারা কিশোরদের চেয়ে বেশি প্রভাবিত হয়। কিশোরী মেয়েরা ছেলেদের থেকে বেশী অনুভূতিশীল এবং আবেগী।
আরেকটি পরিসংখ্যান টেনে শেষ করব লেখাটি। সর্বশেষ ২০২২ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী দেশে কিশোর–কিশোরীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে অর্থাৎ যা বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক পঞ্চমাংশ। ফলে এই বিশাল সংখ্যক কিশোর–কিশোরীদের শিক্ষা, জীবন–দক্ষতা ও স্বাস্থ্যের ওপর নির্ভর করছে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ। এখনই সময় আমাদের পরিবারের, সমাজের এই বিপুল সংখ্যক কিশোর–কিশোরীদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি নজর দেবার। আমরা তাদের বন্ধু হয়ে, তাদের কথা শুনে, তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে, মনস্তত্ব বুঝে, বাড়িতে–স্কুলে তাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করে দিয়ে, তাদের প্রয়োজন ও ইচ্ছা–অনিচ্ছাকে আমলে নিয়ে এ–কাজটি করতে পারি।