চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় গত কয়েক বছর ধরে কিশোর গ্যাং অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। কোনোভাবেই তাদের নিয়ন্ত্রণ ও দমন করা যাচ্ছে না। দুর্দমনীয় হয়ে ওঠা এসব গ্যাং নির্মূলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিশোরদের বয়স বিবেচনায় আইনের সীমাবদ্ধতা এ ক্ষেত্রে অন্তরায় হয়ে রয়েছে। আইন অনুযায়ী, ১৮ বছর না হলে ছেলে–মেয়েদের কিশোর হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিশোর গ্যাংয়ের সাথে যারা জড়িয়ে রয়েছে তাদের বয়স ১৫ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। ফলে গ্যাংয়ের সাথে জড়িত কিশোর অপরাধীদের গ্রেফতার করা হলেও সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া জোরালো আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। গত ১১ জুন ‘কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে তিন উপায় ভাবছে সিএমপি’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে দৈনিক আজাদীতে। এতে বলা হয়েছে, কিশোর গ্যাং সংস্কৃতি বর্তমানে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। হিরোইজম বা বাহাদুরি, কাঁচা টাকা–পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে ছেলে–মেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত এ সমস্ত গ্যাং এবং তাদের সদস্য সংখ্যা বাড়ছে। সেই সাথে টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানান ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে কিশোররা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এ প্রসঙ্গে জানান, ২০১৯ সালে করা কিশোর গ্যাংয়ের একটি তালিকা আমাদের কাছে আছে। কিশোর গ্যাংয়ের সেই তালিকাটি হালনাগাদ করা হবে। পাশাপাশি এই গ্যাং কালচার দমাতে তিন উপায়ে কাজ করার কথা ভাবছে পুলিশ। এক. নতুন করে কিশোর গ্যাংয়ের সলিড তালিকা তৈরি করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা। দুই. কিশোর গ্যাংয়ে জড়িত কিশোরদের অভিভাবকদের ডেকে এনে কাউন্সেলিং সভা করা। তিন. এসব গ্যাং কালচারে যেসব কথিত বড় ভাইরা ছায়া হয়ে আছেন তাদেরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনা।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, রাজনৈতিক নেতাদের মদদে দিন দিন ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে কিশোর গ্যাং। পাড়া–মহল্লায় গড়ে ওঠা এসব গ্রুপের দৌরাত্ম্য রুখতে তালিকা হচ্ছে মদদদাতাদের। গত কয়েক বছর ধরে কিশোর অপরাধের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। সিনিয়র–জুনিয়র দ্বন্দ্ব, সিগারেট খাওয়া, প্রভাব বিস্তারের জেরে হরহামেশা ধাওয়া–পাল্টা ধাওয়া, মারধর, সশস্ত্র হামলা, এমনকি খুন করতেও দ্বিধা করছে না তারা। গত এক বছরে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে অন্তত এক ডজন খুনের ঘটনা ঘটেছে।
সমাজবিশ্লেষকরা বলেন, ‘কিশোর গ্যাং কালচার বা কিশোর অপরাধ বন্ধ করার জন্য আমাদের রাজনীতিকদেরকেই মূল বা সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও রাখতে হবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। সন্ধ্যার পর দলবদ্ধ কিশোরদের রাস্তাঘাটে–মার্কেটে আড্ডারত দেখলেই কৈফিয়ত চাইতে হবে এবং ঘরে যাওয়ার জন্য বাধ্য করতে হবে। কিশোর অপরাধীদের জন্য পর্যাপ্ত রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কোনো কিশোর অপরাধীকে গ্রেফতার করা হলে, সে যেন আইনের সঠিক আশ্রয় পায় (সঠিক বিচার হয়) সে ব্যবস্থা করতে হবে। আমাদের অভিভাবকদের তাঁদের ছেলেমেয়েদের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সন্তান কোথায় যায়, কি করে– তা সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল থাকা পিতা–মাতার নৈতিক দায়িত্ব।’
বলা বাহুল্য যে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে কিশোর গ্যাং এখন ‘বিষফোঁড়ায়’ পরিণত হয়েছে। সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, যে কিশোর–তরুণ দেশের ভবিষ্যত, দল বেঁধে তাদের সন্ত্রাসী হয়ে ওঠা উৎকণ্ঠার বিষয়। ভবিষ্যত প্রজন্মই যদি উচ্ছনে কিংবা গোল্লায় যায়, তাহলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের সামনে অন্ধকার ছাড়া কিছু থাকে না। বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টি করতে এক–দুজনের সন্ত্রাসী কার্যক্রমই যথেষ্ট। এ বিবেচনায়, কিশোর গ্যাংয়ের সাথে জড়িত অসংখ্য বিপথগামী কিশোরের উৎপাত সংশ্লিষ্ট এলাকার শান্তি–শৃঙ্খলা বিনষ্ট ও ত্রাস সৃষ্টি কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলার অবকাশ নেই। কিশোর গ্যাং যদি এখনই প্রতিহত ও নির্মূল করা না যায়, তাহলে সমাজ ও রাষ্ট্র এক ভয়ংকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হবে। এ নিয়ে এখনই ভাবতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঝে মাঝে কিশোর গ্যাংয়ের কিছু সদস্য গ্রেফতার করে মিডিয়ার সামনে হাজির করে ঠিকই, তবে তাতে কোনো লাভ হচ্ছে না। যেহেতু কিশোরদের অপরাধের ক্ষেত্রে সংশোধনাগারে পাঠানো ছাড়া কার্যকর শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না, তাই এক্ষেত্রে নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে হবে।