যে বয়সে বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, মাঠে খেলার কথা, সেই বয়সের কিশোররা এখন ছুরি–চালং এমনকি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাস্তানি করে, মাদকের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকে। মেয়েদের দিকে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে, শিস বাজায়। বাধা দিলে রক্তারক্তি, খুনাখুনি করে। সমাজে বেড়ে গেছে কিশোর অপরাধ। ‘কিশোর গ্যাং’ সমসাময়িককালে সমাজে বহুল আলোচিত–সমালোচিত একটি সামাজিক আতংকের নাম। সাধারণত, সদ্য শৈশব পেরোনো ১৩ থেকে ১৭ বছর বয়সী কিশোর বালকদের সংঘবদ্ধ চক্র, গোষ্ঠী বা দলকে ‘কিশোর গ্যাং’ বলা হয়। তবে এ চক্রে ১৮, ১৯, ও ২০ বছর বয়সী বয়ঃসন্ধিকালীন যুবকদেরও দেখা যায়। গত ৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর গ্যাংয়ের হিংস্র কবল হতে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে কোরবান আলী নামে এক চিকিৎসক গুরুতর আহত হন। মুমূর্ষু অবস্থায় কয়েকদিন হাসপাতালে চিকিৎসার পর তিনি মারা যান। এ ঘটনায় কিশোর গ্যাং নিয়ে সারা দেশে সমালোচনার ঝড় বইছে। গত ২৭ এপ্রিল পটিয়ায় কিশোর গ্যাং লিডার জুয়েল প্রকাশ জুলুর ছুরিকাঘাতে প্রতিপক্ষ রাজু হোসেন রাসেল নামে অপর কিশোর গ্যাং লিডার খুন হয়েছে। গত ২১ এপ্রিল রাতে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার পথে নগরীর মনছুরাবাদ এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের হামলার শিকার হন চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের ক্যামেরাপারসন সেলিম উল্লাহ। সর্বশেষ ২ মে নগরীর কোতোয়ালী থানাধীন আলকরণ এলাকায় দুই কিশোর গ্যাং দলের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় আহত হয়েছেন স্থানীয় কাউন্সিলরের সহকারী মো. সালাউদ্দিন। ভাঙচুর করা হয়েছে একাধিক দোকানপাট। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৮ নম্বর নিউরোসার্জারি ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। ‘কিশোর গ্যাং’ সমস্যাটা এতটাই গুরুতর যে, প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন! সরকার প্রধান সম্প্রতি মন্ত্রিসভার এক বৈঠকে কিশোর গ্যাং প্রসঙ্গে বলেন, যখন ছেলে–মেয়েরা স্কুলে যাবে, পড়াশোনা করবে, সেই সময় কিশোর গ্যাং; বিশেষ করে কোভিড অতিমারির সময় কিন্তু এই জিনিসটা সব থেকে বেশি সামনে এসেছে। আমার মনে হয়, প্রত্যেকটা এলাকাভিত্তিক ছেলে–মেয়ে যারা শিক্ষাগ্রহণ করবে, তারা কেন এ ধরনের গ্যাং হবে এবং অসামাজিক কাজে বা ছিনতাই, খুন, ডাকাতি, এসবে লিপ্ত হবে। সে বিষয়টা নজরদারি করা একান্তভাবে জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তৎপরতা চালাচ্ছে; কিন্তু তারপরেও এই বিষফোঁড়ার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলছে না।
হিরোইজম, কাঁচা টাকা–পয়সা, মাদকাসক্তি, সাংস্কৃতিক চর্চার নামে সস্তা ছেলে–মেয়েদের অবাধে মেলামেশার তীব্র আকর্ষণ ইত্যাদি হাতছানি দিয়ে ডাকায় দ্রুত বাড়ছে কিশোর গ্যাং এবং তাদের সদস্য সংখ্যা। সেই সাথে টিকটক, লাইকি ইত্যাদি নানা ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও পথভ্রষ্ট হয়ে তরুণরা কিশোর গ্যাংয়ে নাম লেখাচ্ছে। ফলে সমাজকে ভেতরে ভেতরে উইপোকার মতো খুবলে খেয়ে ফেলছে এই অশুভ চর্চা। কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা হালনাগাদ করার পাশাপাশি এই গ্যাং কালচার দমাতে তিন উপায়ে কাজ করার কথা ভাবছে পুলিশ। নগর পুলিশ শাখার এক প্রতিবেদন বলা হয়েছে, খুন ছাড়াও বিদ্যালয় কামাই করে শিক্ষার্থীরা কিশোর গ্যাং, পর্নোগ্রাফি, অসামাজিক কার্যকলাপ, অনলাইন গেম, জুয়া, সিগারেট ও মাদকাসক্ত হয়ে টাকা জোগাড়ের জন্য চুরি, ছিনতাই এবং মাদক বিক্রিতেও জড়িয়ে পড়ছে। এ ছাড়া ক্লাস না করে বিভিন্ন পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, রেস্টুরেন্ট, ডার্ক রেস্টুরেন্ট, মার্কেট এবং রাজনৈতিক বিভিন্ন কর্মসূচিতে স্কুল–কলেজ পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
কিশোর অপরাধ কমাতে শিক্ষার্থীদের ক্লাসে উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করে সিএমপি কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় বলেন, ক্লাসে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি না থাকলে শিক্ষার্থীদের এসএসসি ও এইচএসসির নির্বাচনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ বন্ধ করতে হবে। অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে বোর্ড সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেবে। ধারাবাহিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৭০ শতাংশ উপস্থিতি বাধ্যতামূলক করা এবং শিক্ষার্থী ক্লাসে অনুপস্থিত থাকলে খুদে বার্তার মাধ্যমে অভিভাবকদের জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে। এসব পদ্ধতি নিলে কিশোর অপরাধ অনেকটা কমে আসবে।
কিশোর গ্যাং নিয়ে সিএমপি কমিশনার বলেন, কিশোর অপরাধ নিয়ন্ত্রণে, কিশোর গ্যাংয়ের সলিড তালিকা তৈরী করে তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা এবং এসব গ্যাং কালচারে যেসব কথিত বড় ভাইরা ছায়া হয়ে আছেন তাদেরও সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে আইনের আওতায় আনার বিষয়ে আমরা কাজ করছি।
র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) তথ্য মতে, চট্টগ্রাম নগরীতে ২৫০টি কিশোর গ্যাং সক্রিয়, আর এগুলোতে প্রায় দেড় হাজার সদস্য আছে। অপরাধ নির্মূলে কিশোর গ্যাংয়ের প্রধান হোতাসহ সদস্যরা নজরদারিতে আছে বলে জানান র্যাব–৭ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মাহবুব আলম। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম নগরীতে কিশোর গ্যাংগুলোর মধ্যে আবার উপগ্রুপ আছে। রোডভিত্তিক, এলাকাভিত্তিক গ্রুপও আছে। এর পেছনে বিভিন্ন বড় ভাই জড়িত। কিশোর গ্যাংগুলোকে কারা সাপোর্ট দিচ্ছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখানে যাদের নাম আসবে, সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। র্যাব কর্মকর্তা জানান, কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে অভিযান অব্যাহত থাকবে, যাতে এদের দৌরাত্ম্য কমে আসে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর বায়েজিদ, কোতোয়ালী, চান্দগাঁও এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে বায়েজিদ এলাকার নূর গ্রুপ, রুবেল গ্রুপ, জনি গ্রুপ, কোতোয়ালী এলাকায় টোকাই জুয়েল গ্রুপ, বাকলিয়া এলাকার ইউসুফ গ্রুপ, পাহাড়তলী এলাকায় সাদ্দাম গ্রুপ, বিপুল গ্রুপ, সাকিব গ্রুপ, সাজ্জাদ গ্রুপ, পাঁচলাইশ এলাকার বাচা গ্রুপ, সদরঘাট এলাকার জীবন গ্রুপ, চান্দগাঁও এলাকায় ধামা জুয়েল, রিফাত, সোহেল ও দিদার গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এ ছাড়া লালখান বাজার, টাইগারপাস, বাঘঘোনা এলাকায় ডিশ সালাউদ্দিন, জাহিদ, নাহিদ ও তানজিদ গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। উত্তর পাহাড়তলী এলাকায় সক্রিয় রয়েছে বিল্লাল, সালাউদ্দিন, শাকিল ও আনিস গ্রুপ।