কিশোর অপরাধের সাথে গ্যাং কালচার এখন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। স্কুল-কলেজ এবং বিভিন্ন এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে শিশু-কিশোরদের কয়েকজন মিলে গড়ে তোলে গ্যাং বাহিনী। গ্যাং কালচারের সদস্যরা আন্তঃযোগাযোগ স্থাপন করে নানা কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গ্রুপ খুলে নিয়ে নিজেদের মধ্যে এই যোগাযোগ স্থাপন করে। অনেক সময় দেখা যায় স্কুল-কলেজে বা এলাকায় বন্ধুদের সঙ্গে ঝামেলা হলে এরা ওই গ্রুপের মাধ্যমে অন্য সদস্যদের জানিয়ে দেয়। এরপর স্কুল ছুটি হলে বা সুবিধামতো সময়ে এরা একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের ওপর হামলা চালায়। ছোট ছোট গ্রুপ করে এসব গ্যাংয়ের সদস্যরা আবার কোনো একজন বড় ভাইয়ের অধীনে থাকে। তিনি হচ্ছেন গ্যাং লিডার। অপরাধ করার পরে বা বিপদে আপদে গ্যাং লিডাররা আশ্রয় দিয়ে থাকে। এই কিশোর গ্যাং এর অপতৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে ভিন্ন মাত্রায়। দৈনিক আজাদীতে গত ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় ‘চসিক নির্বাচন সামনে রেখে তৎপর কিশোর গ্যাং’ শীর্ষক একটি সংবাদ। এতে বলা হয়েছে, বর্তমানে নগরজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রামের কিশোর গ্যাং। নিত্যনতুন কৌশলে চুরি-ছিনতাই ও খুনের ঘটনায় যারা ধরা পড়ছে তাদের মধ্যে কিশোর অপরাধীর সংখ্যাই বেশি দেখা যাচ্ছে। ২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি কলেজিয়েট স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র আদনান খুন হওয়ার মধ্য দিয়ে কিশোর গ্যাংয়ের আধিপত্য প্রকাশ্যে আসে। ওই ঘটনার পর ১৬টি থানায় কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা করা হয়। ওই বছর ছোট বড় কিশোর গ্যাং এর ৫৫০ জন কিশোর তালিকাভুক্ত হয়। এছাড়া নগরীর ৩০০টি স্পটকে এসব কিশোরের আড্ডাস্থল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কোচিংভিত্তিক, রাজনৈতিক, স্কুল-কলেজভিত্তিক, চাকরিজীবী এই ধরনের অন্তত ১৫টি ক্যাটাগরির তালিকা করা হয়েছিল। পুলিশ কিশোর অপরাধী চক্রের (কিশোর গ্যাং) ৪৮ জন পৃষ্ঠপোষক বা গডফাদারের তালিকা করে। যার মধ্যে ১৭ জনের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে, ৫ জন সরকারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের পদধারী নেতা। ১৩ জনের দলীয় পদ-পদবী না থাকলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে তারা প্রভাবশালী। বাকি ১১ জন পৃষ্ঠপোষক স্থানীয় টপটেরর। সিএমপির অতিরিক্ত উপ কমিশনার (গোয়েন্দা-উত্তর) শাহ মোহাম্মদ আবদুর রউফ এ প্রসঙ্গে আজাদীকে বলেন, কিশোর অপরাধী এবং আড্ডাস্থলের যে তালিকা আগে করা হয়েছিল, সেটিকেই পরিবর্তন, পরিবর্ধন করে নতুন তালিকা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী অভিযান চলছে, গ্যাং লিডাররা গ্রেপ্তার হচ্ছে।
ড. উজ্জ্বল কুমার দেব আজাদীতে তাঁর এক লেখায় বলেন, আমাদের দেশে বর্তমানে আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তন, আকাশ সংস্কৃতি ও ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা বা তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহার কিশোরদের অপরাধপ্রবণতা বাড়ার অন্যতম কারণ। তথ্য-প্রযুক্তির কারণে শিশু-কিশোরদের নৈতিক স্খলন হচ্ছে বিশেষ করে শহুরে কিশোরদের। একজন কিশোর তার বাবা-মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কাছ থেকে নৈতিক মূল্যবোধভিত্তিক শিক্ষা গ্রহণ করে। এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে কোনও কিশোরের আচরণ গঠনে এবং তার ব্যক্তিত্বকে সুসজ্জিত করতে পরিবার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে কিশোররা হিংস্র হয়ে ওঠে বা কিশোর অপরাধের চিহ্নগুলি কেবল তখনই দেখায় যখন তারা বাড়িতে অশান্তির মুখোমুখি হয়। বর্তমান করোনাকালীন স্কুল কলেজ বন্ধ থাকায় এ ব্যাপারটা আরও বেশি করে দৃশ্যমান। সম্পর্ক খারাপ হওয়ার মাধ্যমে ভেঙে যাওয়া পরিবারগুলি কিশোরদের পথভ্রষ্ট ও হিংস্র হতে পরোক্ষ একটা সমর্থন দেয়। অন্যদিকে হালের কর্পোরেট যুগে বাবা-মা প্রায়শই প্রফেশনের কাজে ব্যস্ত থাকেন, তাই তারা তাদের বাচ্চাদের সাথে মানসম্পন্ন সময় ব্যয় করতে সক্ষম হন না। এটি কিশোর-কিশোরীদের অন্যদের, বিশেষত তাদের সমবয়সীদের সাথে নিজেকে যখন তুলনা করে তখন একধরনের হীনম্মন্যতায় ভোগে। এর ফলে তারা পরিত্রাণের উপায় হিসেবে মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও রাজনৈতিকভাবে কিশোরদের ব্যবহার করার কারণেও তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবার ও সমাজের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর উদ্যোগ ছাড়া ‘গ্যাং কালচার’ রোধ সম্ভব হবে না, এক্ষেত্রে প্রথমেই বাবা-মাকে এগিয়ে আসতে হবে। সন্তানরা কী করছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, এ ক’টি বিষয়ে পর্যাপ্ত মনিটর করতে পারলেই গ্যাংয়ের মতো বাজে কালচারে সন্তানের জড়িয়ে পড়া রোধ করা সম্ভব!