১৯৯৭ সালের ১২ জানুয়ারি, রবিবার দুপুরে আমি আমার ভাসুরের ছেলে নন্দকে সাজানোর সময় আমার শ্বশুর অফিস থেকে এসে বললেন আমার মাসী (ভাইয়ের শাশুড়ি) সিঁড়ি থেকে পড়ে মেডিকেল সেন্টারে ভর্তি আছে আমি দেখতে যাব কিনা। আমি যাব বলার পর উনি তাড়াতাড়ি ভাত খেয়ে তৈরি হতে বললেন। আমার জা যখন নন্দকে ভাত খাওয়াচ্ছে তখন আমি বললাম আমার মাকে তো অসুস্থ দেখে এসেছিলাম কেমন আছে জানি না। দিদি তখন কোনও উত্তর দিল না। আমরা তিনজন টেক্সিতে করে এলাম। ওখানে দেখলাম মাসী বেডে বসে আছে আর মা নিস্তেজ হয়ে শুয়ে। মায়ের শরীরে চারপাশে বিভিন্ন স্যালাইনের নল। মাথা সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। আমি দেখে বুঝলাম কেন আমার জা চুপ ছিল। আমি চিৎকার করে কাঁদতে পারি না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। মাসী জানালো আজ মাকে নিয়ে তার আমাদের বাসায় আসার কথা। সকালে দাদা অফিসে যাওয়ার সময় মাকে বলে দিয়েছে বৌদি আর মাসী ব্যাংক থেকে আসার পর মা মাসীর সাথে আমাদের বাসায় আসবে। মা বলেছে আমার জন্য একটু মোয়া বানিয়ে নেবে। আমি তখন প্রেগন্যান্ট ছিলাম। দাদা বলেছে কিনে নিয়ে যেতে কারণ কিছুদিন আগে মা অসুস্থ ছিল। সবাই যখন চলে গেছে মা তখন আমার জ্যাঠাতো ভাইয়ের ছোট মেয়ে রোমাকে দিয়ে চিড়া গুড় কিনে এনে হিটারের চুলায় মোয়া বানাতে বসল। হঠাৎ মায়ের শাড়ির আঁচল চুলায় পড়ে সেখান থেকে আগুন শরীরে লেগে যায়। রোমা বেড়ার ফাঁক দিয়ে আগুন দেখে দৌড়ে এসে সামনে চটের বস্তা পেয়ে সেটা দিয়ে চেপে ধরে আগুন নেভালো। ওর চিৎকার শুনে কাজ ফেলে ওর মা এসে মায়ের এই অবস্থা দেখে অবাক হয়ে গেল। পরে পাড়ার কয়েকজন এসে মাকে মেডিকেলে নিয়ে এলো। মাকে অনেক বার মা মা করে ডাকলাম কিন্তু মা সাড়া দিলো না। আমি মায়ের ডান হাতটা ধরলাম। বাম হাত অবশ। মায়ের নাকে যে নল লাগানো ছিল ডান হাত সেখানে বারবার নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে বেশিক্ষণ থাকতে দিলো না। মায়ের শরীরের পোড়া অংশগুলো আমাকে দেখতে দেয়নি। বাবাকে বললাম আমাকে একটু নিয়ে যেতে। বাবা জানালো এসময় আমার মেডিকেলে যাওয়া উচিত নয়। মায়ের সেন্স আর আসেনি, অবস্থা খারাপের দিকে। পাশের বাসার রুমাদি আমার জা‘কে বলল, ভাসুর ফোন করেছে ওদের ফোনে। আমার জা গেল। কেন জানি আমার খটকা লাগলো। আমি চুপিচুপি গিয়ে উনার কথা শুনলাম। দেখলাম, দিদি ফোনে মাথা নেড়ে বলছে, ইস, নেই। আমি আর দাঁড়াতে পারলাম না। দ্রুত গিয়ে ঘরে দরজা বন্ধ করে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলাম। আমার জা এসে অনেক বার দরজা ধাক্কা দিয়ে বলল, মাসীর কিছু হয়নি তুমি দরজা খোল। শেষে আমার স্বামী আসার পর খুললাম। আমার জা’কে জড়িয়ে ধরে বললাম, দিদি, মা তো আমার বাসায় আসতে পারলো না, আমি রান্না করে মাকে খাওয়াতে পারলাম না। দিদিও কান্না করছে। আমাকে এই অবস্থায় মাকে দেখতে না দিতে সবাই বললেও আমার স্বামী আমাকে নিয়ে গেল, আমার জা‘ সাথে গেল। আত্মীয় স্বজন, বৌদি, আমার বোনেরা সবাই মাকে ঘিরে বসে কান্না করছে। আমাকে কাছে যেতে দেয়নি। মুখের কাপড় সরিয়ে দূর থেকে দেখালো। আমি দেখলাম মায়ের মুখটা ফুলে হলুদ বর্ণের হয়ে গেছে। ঐ একটুকুই দেখা। এরপর মা চলে যাওয়ার দশ দিনের দিন আমার বড় ছেলে সময় পৃথিবীতে আসলো। সেদিন রাতে মা একবার এসেছিল স্বপ্নে। আমার পাশের বেডে বসে পা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে। আমি বারবার জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কেন চলে গেলে কিন্তু মা শুধু হেসেই যাচ্ছে।