কাশ্মীর নিয়ে ট্রাম্পের মধ্যস্থতার প্রস্তাবে কঠিন চাপে ভারত

| বুধবার , ১৪ মে, ২০২৫ at ৮:৫৪ পূর্বাহ্ণ

পাকিস্তানের সঙ্গে কাশ্মীর নিয়ে দীর্ঘ বিরোধে ভারত বরাবরই তৃতীয় কোনও পক্ষের মধ্যস্থতার বিপক্ষে। দশকের পর দশক ধরেই যেন বিষয়টি নিষিদ্ধ হয়ে আছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নীতিতে। দিল্লির সেই আপত্তির জায়গাতেই এবার হাত দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।

গত শনিবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এক ঘোষণায় তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় চার দিনের লড়াইয়ের অবসান ঘটিয়ে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পরে আরেক পোস্টে কাশ্মীর সংকট সমাধানে দুই দেশের সঙ্গে কাজ করার আগ্রহ প্রকাশ করে তিনি বলেন, আমি উভয়ের সঙ্গেই কাজ করব; দেখি, কাশ্মীর নিয়ে হাজার বছরের সংকটের সমাধানে পৌঁছা যায় কিনা। খবর বিডিনিউজের।

এই প্রস্তাবে বিপাকে পড়েছে দিল্লি। কারণ, ট্রাম্পের এই মধ্যস্থতার প্রস্তাব ভারতের ঐতিহাসিক অবস্থানের সঙ্গে যায় না। তাই ট্রাম্পের এমন বক্তব্যে বহু ভারতীয়ই বিরক্ত। তারা একে দ্বিপক্ষীয় কাশ্মীর ইস্যুকে ‘আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা’ হিসাবেই দেখছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক তৎপরতায় বলতে গেলে প্রায় শেষমুহূর্তে সর্বাত্মক এক যুদ্ধের দ্বারপ্রান্ত থেকে ফিরে এসেছে ভারত ও পাকিস্তান।

সমপ্রতি ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে জঙ্গি হামলাকে কেন্দ্র করে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘাতে বেশ কিছু মানুষ নিহত হয়েছে। দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের মধ্যে এ লড়াই মারাত্মক রূপ নিতে পারে এমন আশঙ্কায় ট্রাম্প প্রশাসন তা থামাতে হস্তক্ষেপ করার পর ভারতপাকিস্তান যুদ্ধবিরতি হয়। একে তো যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতার এই পদক্ষেপ, তার ওপর আবার কাশ্মীর সংকট সমাধান করতে ট্রাম্পের প্রস্তাব, স্বাভাবিকভাবেই ভারত তা ভালভাবে নেয়নি। কারণ, ভারত বহুদিন ধরে কাশ্মীরকে নিজেদের ‘অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করে আসছে , দ্বিপক্ষীয় নীতির বাইরে তৃতীয় কারও হস্তক্ষেপ প্রত্যাখ্যান করে আসছে। ফলে ঐতিহাসিক এই অবস্থান থেকে ভারতের জন্য কাশ্মীর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা অনেকটাই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠবে। আবার দেশের ভেতরেও ভারত সরকারকে পড়তে হচ্ছে নানা প্রশ্ন ও দাবির মুখে, দিতে হচ্ছে কৈফিয়ত।

ভারতের প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস পার্টি সরকারের কাছে যুদ্ধবিরতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়েছে এবং ‘ওয়াশিংটনের কাছ থেকে প্রথম যুদ্ধবিরতির ঘোষণা আসার’ বিষয়টি নিয়ে একটি সর্বদলীয় বৈঠকও চেয়েছে। কংগ্রেস পার্টির চেয়ারম্যান জয়রাম রামেশ বলেছেন, আমরা কি তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপর দ্বার খুলে দিয়েছি? ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস জানতে চায়, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক চ্যানেল আবার খুলে দেওয়া হয়েছে কিনা।

রামেশের এমন প্রশ্নের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিওর একটি বক্তব্য। রুবিও ভারতপাকিস্তান যুদ্ধবিরতির ঘোষণা দেওয়ার সময় এও বলেছিলেন যে, দুই দেশ যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় নিয়ে একটি নিরপেক্ষ স্থানে আলোচনা শুরু করতেও রাজি হয়েছে।

ভারত বরাবরই পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় বসতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদে মদদ দেওয়ার অভিযোগ করে আসছে তারা। অতীতে দুই দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমস্যার সমাধানের চেষ্টায় চুক্তি হলেও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই চুক্তি লঙ্ঘনেরও অভিযোগ ভারত করে এসেছে। ভারত ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা এবং একে অপরের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার বিষয়ে রাজি হওয়ার পরও দেই দেশের মধ্যে কার্গিল যুদ্ধ হয়েছে। সুতরাং ইতিহাস থেকে দেখা যায়, দুইদেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয়ভাবে সংকট সমাধান ঠিকমত না হওয়ায় উত্তেজনা প্রশমন করতে তাদেরকে তৃতীয়পক্ষের ওপরই সে দায়িত্ব ছেড়ে দিতে হয়। কাশ্মীর নিয়ে ভারত তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতার বিরোধিতা করে আসলেও অতীতে এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধ ও সামরিক উত্তেজনা থামাতে বহুবারই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাইরের দেশগুলো। এবারও ভারতপাকিস্তান উত্তেজনা নিরসনে বড় ভূমিকা রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে ট্রাম্প কাশ্মীর নিয়ে মধ্যস্থতার যে প্রস্তাব দিয়েছেন তাতে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কোনও সাড়া দেয়নি ভারত সরকার।

ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শংকর বলেছেন, ভারত সবসময়ই সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর এবং আপোসহীন অবস্থান বজায় রেখেছে। তারা সে অবস্থানেই থাকবে। জয়শংকরের কথায় এ আভাসই মেলে যে, ভারত সরাসরি দ্বিপক্ষীয় আলোচনা সহসাই শুরু করবে না।

আবার ওদিকে, ভারতের এই অনড় অবস্থান এবং দ্বিপক্ষীয় আলোচনা বরাবরই প্রত্যাখানের কারণে পাকিস্তান আন্তর্জাতিক মধ্যস্থতায় আগ্রহী, যাতে ভবিষ্যতে কোনও ধরনের সংঘাত এড়ানো যায়। ইসলামাবাদের সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজ এর নির্বাহী পরিচালক ইমতিয়াজ গুল বলেন, ভারতের সঙ্গে পারষ্পরিক আস্থার অভাব থাকায় পাকিস্তান সবসময়ই কাশ্মীর সমস্যা সমাধানে তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা চেয়ে এসেছে। এখন সুপারপাওয়ার একটি দেশ কিছু করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। পাকিস্তান এটিকে তাদের নৈতিক বিজয় হিসাবেই দেখবে। তিনি বলেন, কাশ্মীর আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের কাছে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সদ্যই কাশ্মীর নিয়ে সংঘাত যে পথে মোড় নিয়েছিল তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারত।

কিন্তু বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হয়ে আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের আত্মবিশ্বাস ও প্রভাব বেড়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী মোদী ক্ষমতায় আসার পর তার প্রভাবশালী কূটনীতিকে বিশ্বে উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসাবে ভারতের আত্মবিশ্বাসের লক্ষণ হিসাবেই দেখা হয়। কিন্তু ভারতকে এখন নিজেদের এই প্রভাব বজায় রাখা এবং ট্রাম্পকে ঠেকিয়ে রাখার মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার কঠিন পথে চলতে হবে। চীনের প্রভাব বাড়তে থাকার কারণে ভারতকে পাশে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য জরুরি। চীনকে মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, জাপানকে নিয়ে গড়ে ওঠা গ্রুপ ‘কোয়াড’এর সদস্য ভারতও।

সমপ্রতি কয়েক দশকে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন ভারতে আধুনিক বিমান, হেলিকপ্টার ও অন্যান্য সামরিক সরঞ্জামও বিক্রি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের আগেকার সরকারগুলো কাশ্মীর নিয়ে ভারতের স্পর্শকাতরতার বিষয়ে সচেতন ছিল।

১৯৪৭ সালে ভারতপাকিস্তান বিভক্তির পর থেকেই কাশ্মীর সংকটের সূচনা। দুই দেশই কাশ্মীরকে নিজেদের অংশ বলে দাবি করে এবং একাধিকবার কাশ্মীর নিয়ে সামরিক সংঘাতে জড়িয়েছে। ২০১৯ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বিলোপ হওয়ার পর এই রাজ্যটি নিয়ে ভারতের অবস্থান আরও দৃঢ় হয়েছে। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্রের অতীত সরকারগুলো মূলত কাশ্মীর নিয়ে হস্তক্ষেপ করা থেকে দূরেই সরে ছিল। কিন্তু ট্রাম্পের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের আগের সেই অবস্থান এখনও থাকবে কিনা তা প্রশ্নসাপেক্ষ। ভারতের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার যুক্তরাষ্ট্র। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন ট্রাম্পের ঘোষিত উচ্চ শুল্ক এড়াতে বাণিজ্য চুক্তি করার জন্য আলোচনা চালাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ভারতকে এখন একরকম সরু দড়ির উপর দিয়েই হাঁটতে হবে। ট্রাম্পের মধ্যস্থতা মেনে নেওয়া, ট্রাম্প প্রশাসনের মধ্যস্থতায় হওয়া যুদ্ধবিরতি দেখা কিংবা সমঝোতার পথে হাঁটার প্রতিকূল পথে চলার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুবিধাজনক বাণিজ্য সম্পর্ক বজায় রাখার কথাও ভারতকে মাথায় রাখতে হবে। ভারত সরকার যদি এখন পাকিস্তানের সঙ্গে সিন্ধুর পানিবন্টন চুক্তি কিংবা কাশ্মীরের মর্যাদার মতো কন্টকাকীর্ণ বিষয় নিয়ে বৃহত্তর আলোচনায় যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে দেশে তুমুল সমালোচনার মুখে পড়বে; এটি যে একটি ফাঁদ, তা মোদী ভাল করেই জানেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধআবির্ভাব’র উদ্যোগে আলোচনা সভা