বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ ভাষণ বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ হিসেবে ইতিমধ্যে সর্বজন স্বীকৃতি পেয়েছে। ভাষণের অনুকরণে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার সোপানের জন্য অনন্য অর্জন যা বাঙালি জাতির জীবনে চিরভাস্বর।
ক্যারিশম্যাটিক লিডার হিসেবে বঙ্গবন্ধু ছিলেন অনন্য। রাজনৈতিক দূরদর্শিতায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রথিতযশা, তাই তো ২৫শে মার্চ বিকালের দিকেই তিনি জানতে পারেন যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে সব ধরনের সম্ভাবনার আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তানি বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের উপর আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঠিক তখনই তিনি তার প্রজ্ঞাবান এবং তেজোদীপ্ত সহকর্মীদের পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেবার নির্দেশ দেন। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, তিনি তাঁর বত্রিশ নম্বর ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পালিয়ে যেতে অস্বীকৃতি জানান, যাতে পাকিস্তানিরা কোন মিথ্যার আশ্রয় নিতে না পারে। এ প্রসঙ্গে মার্কিন লেখক রবার্ট পেইন তাঁর “ম্যাসাকার” গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন: মধ্যরাত অবধি বঙ্গবন্ধু অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে ঘটনা প্রবাহ আমূল পাল্টে যাচ্ছে। টেলিফোনের মাধ্যমে কামানের গোলার শব্দের সাথে সাথে নিরীহ মানুষের চিৎকারে চারপাশের পরিবেশ ভারী হয়ে উঠেছিল। অবশ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ সম্পর্কে তিনি অবগত ছিলেন না। তিনি আঁচ করতে পেরেছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের অধ্যুষিত সামরিক ঘাঁটিতে পাকিস্তানিরা আগে আক্রমণ করবে। তাই সেই রাতেই, ২৬শে মার্চে, বাঙালির অবিসংবাদিত জননেতা দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ সিদ্ধান্তটি নিলেন স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে। সাথে সাথে তাঁর এক বন্ধুকে বেতার যোগে ঘোষণাটি পাঠাবার জন্য নির্দেশ প্রদান করেন। রবার্ট পেইন লিখেছেন, বাণীটি ছিল নিম্নরূপঃ “পাকিস্তান সামরিক বাহিনী মাঝরাতে রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানার পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করেছে। প্রতিরোধ করবার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য শক্তি সঞ্চয় করুন।” বঙ্গবন্ধুর এই আহবান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তাঁর সহকর্মী এবং মুক্তিকামী মানুষের কাছে পৌঁছে যায় নিমিষেই, এবং বাঙালি জাতি সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। বরিশাল থেকে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, যাকে বহু আগেই শেখ মুজিব কলকাতাতে পাঠিয়েছিলেন; তার মাধ্যমেই মূলত হেনা ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাত করতে পেরেছিলেন্। এ আলোচনার প্রত্যেকটি বিষয়বস্তু তথা সারসংক্ষেপ শেখ মুজিবের নখদর্পণে ছিল। প্রখ্যাত লেখক অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার “আমার একাত্তর” বইয়ে শেখ ফজলুল হক মণির সাথে লেখকের কথোপকথনের বিষয়টি তুলে ধরেন।
উপরোক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দৃশ্যমান হয়, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ধারক ও বাহক। কুপমুন্ডকরা অনেক সময়ই বলে থাকেন, স্বাধীনতা যুদ্ধাবস্থায় বঙ্গবন্ধুর প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা ছিল না। ছোট এই আর্টিকেলটি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে ধরিয়ে দেওয়ার জন্যই যথেষ্ট এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুরই পরিকল্পনার ফসল।
মূলত তার দিকনির্দেশনাই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং এতে দ্বিমতের কোন সুযোগ নেই। আর যারা এর পরেও সন্দেহের সুযোগ খুঁজবে তাদের দেশপ্রেমে যথেষ্ট ঘাটতি আছে ধরে নেওয়াটাই স্বাভাবিক। দেশের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও মুক্তি-স্বাধীনতার জন্য শেখ মুজিব বহু নেতৃত্ব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন বিধায় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর অল্প দিনের মধ্যেই বিশ্ববিবেক সৃষ্টি হয়েছিল। বিশ্ববিবেকের জনমত স্বাধীনতার পক্ষে আমাদের সাহস এবং অনুপ্রেরণাকে আশান্বিত করেছিল। সুতরাং আমরা বলতেই পারি, বঙ্গবন্ধু এবং আমাদের মুক্তি স্বাধীনতা একই সূত্রে গাঁথা।