কালজয়ী বাংলা গানের অমর গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের গান

ড. মো. আনোয়ারুল ইসলাম | শুক্রবার , ১৬ জুন, ২০২৩ at ৫:১২ পূর্বাহ্ণ

১৯৭১ সালের মার্চ। আমরা যাকে বলি অগ্নিঝরা মার্চ। ৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু ব্রজকন্ঠে বললেন, ‘আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।’ বঙ্গবন্ধুর এই ব্রজকন্ঠের উদাত্ত আহবান শুনে এক গীতিকার লিখলেন, ‘শোনো, একটি মুজিবরের থেকে/ লক্ষ মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনিপ্রতিধ্বনি/ আকাশেবাতাসে ওঠে রণী।’ এই গানের গীতিকার হলেন গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। গানটা ইংরেজিতে অনুবাদও হয়, ‘আ মিলিয়ন মুজিবর সিঙ্গিং’। ১৯৭১এ মুজিবনগরে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রী পরিষদের শপথ অনুষ্ঠানে বাজানো হয় সেই গান। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গান আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আমন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে বাংলাদেশে এসেও তিনি লিখেছিলেন অমর কালজয়ী এক গান। আর সেটা হলো ‘মাগো ভাবনা কেন/ আমরা তোমার শান্তিপ্রিয় শান্ত ছেলে’। হেমন্তের কণ্ঠে বিপ্লব এনেছিল সে গান।

গৌরী প্রসন্ন মজুমদার শুধু যে মুক্তিযুদ্ধের গান লিখেছেন এমনটি নয়। আধুনিক গানে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। ২০০৪ সালে বিবিসি বাংলা বিভাগ সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গান নিয়ে জরিপ করেছিল সেখানে গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের দুইটি গান স্থান পেয়েছে। বিশটি গানের সেই তালিকায় চার নম্বরে রয়েছে তাঁর লেখা কফি হাউজের সেই আড্ডাটা আজ আর নেইএবং এগারো নম্বর তালিকায় ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে। বলা যায় বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগ শুরু হয়েছিল তাঁর লেখা গান দিয়েই এবং বাংলা সংগীতের ইতিহাসে তাঁকে বলা হয় আনসাং হিরো

অনেকেই অবাক হন গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের জন্ম, বেড়ে ওঠা এই পূর্ব বাংলায়। ১৯২৫ সালের ৫ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার পাবনা জেলার ফরিদপুর উপজেলার গোপালনগর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের বাবা গিরিজাপ্রসন্ন মজুমদার ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজের খ্যাতনামা অধ্যাপক এবং সেরা একজন উদ্ভিদবিদ। মা সুধা মজুমদারও ছিলেন স্নাতক। ফলে বাড়িতে ছিল জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এক দারুণ পরিবেশ। ফলে শৈশব থেকেই কবিতা ও প্রবন্ধ লেখার প্রতি ছিল তাঁর অসীম আগ্রহ। পাবনা শহরে তাঁকে চিনতো ডাক নামে বাচ্চু মজুমদার নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কলকাতা ছেড়ে পাবনা শহরের মজুমদার পাড়ায় এসে বসবাস শুরু করেন। এই সময় পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজেও ভর্তি হন। তাঁর সঙ্গে পাবনা শহরের আরেক কৃতিমান সাহিত্যিক, গীতিকার ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের সখ্যতা গড়ে উঠেছিল। ১৯৫১ সালে পুনরায় কলকাতা চলে যান। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গান লেখার অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন শচীন দেব বর্মনের কাছ থেকে। আজীবন শচীন দেববর্মণের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক ছিল গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের। ‘মেঘ কালো আঁধার কালো’, ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে,’ ‘বাঁশি শুনে আর কাজ নাই’ এমন অসংখ্য কিংবদন্তি গান সৃষ্টি হয়েছিল গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখায় এবং শচীন দেব বর্মনের সুরে।

শুধু কী শচীন দেব বর্মন লতা মঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে, মান্না দে, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, কিশোরকুমার, রাহুল দেববর্মণ, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায় প্রায় সকল বিখ্যাত গায়কেরাই গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গান গেয়েছেন। একবার বিতর্ক হয়েছিল কার গানে হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায় শ্রেষ্ঠ। সলিল চৌধুরী নাকি গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানে। এর প্রত্যুত্তরে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার বলেছিল “ আমার লেখা আর নচিকেতা ঘোষের সুরে হেমন্তবাবুর গাওয়া ‘আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে’ ওঁর জীবনে সর্বশ্রেষ্ঠ গান।’’ এটা প্রমাণিত হলো বিবিসির জরিপে বাংলা গানের শ্রেষ্ঠ বিশটি গানের হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি আমায় যে পিছু ডাকে’ গানটির গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার। এজন্য বোধহয় কোন এক সময় গৌরী প্রসন্ন মজুমদার জোর গলায় বলেছিলেন ‘উইদাউট গৌরীপ্রসন্ন হেমন্তবাবুর সুরকার ও গায়ক জীবন অসম্পূর্ণ।’ গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের যে সকল বিখ্যাত গানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গেয়েছিলেন তন্মেধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু গান– ‘ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে’, ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’, ‘তারে বলে দিও’,‘আজ দু’জনার দু’টি পথ’, ‘ওগো তুমি যে আমার’ ‘মুছে যাওয়া দিনগুলি’,‘এই রাত তোমার আমার’, ‘পথের ক্লান্তি ভুলে’ ‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ এর মতো অসংখ্য হিট গান। যা বাংলা ছবির ইতিহাসে নতুন অধ্যায় লিখলো। বলা হয়ে থাকে ফ্লপ ছবিকেও শুধু মাত্র গানের জোরে সুপারহিট করে দিতে পারতো গৌরীহেমন্ত জুটি। একবার অমল মুখোপাধ্যায় সঙ্গীত পরিচালনার সুযোগ পেয়ে ছুটে এলেন গৌরীপ্রসন্নের কাছে। বললেন, ‘গৌরীদা, এমন একটা গান লিখে দিন, যেন আমি চিরদিন থেকে যেতে পারি বাংলা গানে।’ উনি লিখে দিয়েছিলেন ‘এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায় এ কী বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু’!

হেমন্তের পরে যে দু’জন শিল্পী তাঁর সবচেয়ে বেশি মন কেড়েছিল, তাঁরা হলেন মান্না দে এবং সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মান্না দে প্রথম দিকে হিন্দি ছবিতে প্লেব্যাক করতেন। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার তাঁকে উৎসাহ দিতেন বাংলা গান গাওয়ার জন্য। গৌরী প্রসন্ন মজুমদার তাঁকে দিয়ে গাওয়ালেন তাঁর কিছু অমর কালজয়ী লেখা কিছু গান। যেমন– ‘তীর ভাঙা ঢেউ আর নীড় ভাঙা ঝড়’, ‘হাজার টাকার ঝাড়বাতিটা’, ‘যদি কাগজে লেখো নাম’, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে’, ‘আমি যামিনী তুমি শশী হে’, ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা’ প্রভৃতি একের পর এক সুপারহিট গান। হিসেব করলে দেখা যায়, মান্না দেরও অধিকাংশ সুপারহিট গানের গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন।

বাংলা গানের অমর কালজয়ী শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে গৌরী প্রসন্ন মজুমদার দিদিভাই বলে ডাকতেন। গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের লেখা গানে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া আর রূপালী পর্দায় সেটার ঠোঁট মেলানো মহানায়িকা সুচিত্রা সেনএ যেন বাংলা সংগীত জগতের অবিমিশ্রিত রসায়ন। বাঙালিকে তখনো যেমন আকর্ষন করতো এখনো সেগুলোর আবেদন এতটুকু কমেনি। মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের রূপালী পর্দার ঠোঁট মেলানো গাওয়া গৌরী প্রসন্ন মজুমদারের গানগুলো হলো– ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু,’ ‘ঘুমঘুম চাঁদ,’ ‘জানি না ফুরাবে কবে এই পথ চাওয়া,’ ‘আকাশের অস্তরাগে’ প্রভৃতি। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় নিজে বলেছিলেন, ‘সুচিত্রা সেন যেভাবে গানে লিপ দিতেন, তা দেখে আমি নিজেও অবাক হয়েছি। শুধু মাত্র চোখ ও মুখের ভঙ্গিতে এমন করে গলা মিলাতে আর কাউকে দেখিনি।’ শুধু গানেই নয়। এই জুটির মধ্যে ছিল আত্মার টান। সুচিত্রা সেনের ঠোঁট মেলানো গানগুলোর গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার যেন তাঁর জন্যই এত গুছিয়ে নিপুণ ভাবে পারফেক্ট করে দর্শকদের মন ছুঁয়ে দিয়েছেন। একথা অবশ্যই বলতে হয় গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এমন গান না লিখলে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় কোথা থেকে গাইতেন এমন অমর ও কালজয়ী গান!

গৌরী প্রসন্ন মজুমদার গানের কথা নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতেন। নৈরাশ্যবাদ জীবনকে তিনি গানের মাধ্যমে আশাবাদের দিকে নিয়ে গেছেন। প্রগতিশীল চিন্তা প্রসূত সময়ের দাবি অনুযায়ী লিখেছেন বাংলা গান।

গবেষক খান আসাদুজ্জামান গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার এবং পুলক বন্দোপাধ্যায়ের উপর গবেষণা করতে গিয়ে যথার্থই বলেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলামের গীতবাণী থেকে দীক্ষা নিয়েই তাঁরা এই দুই শিল্প স্রষ্টার গীত বলয় থেকে মুক্তির জন্য সমকালীন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সঙ্গীতের মূল্যায়ন করে যে নতুন সঙ্গীতাদশের্র সন্ধান করেছেন, তাতে মূল্যবোধবিপর্যস্ত মানুষের নৈরাশ্যের পরিবর্তে প্রবল আশাবাদী উচ্চারণই প্রধান হয়ে উঠেছে।’

এই মহান শিল্পীর শেষ জীবন অতোটা সুখের ছিল না। পরাজিত হলেন ক্যান্সারের কাছে। কিন্তু যখন ক্যান্সারের চিকিৎসা চলছিল তখনও তিনি গান লিখে চলছেন। হাসপাতালে শুয়ে লিখেছিলেন শেষ গান, ‘এবার তাহলে আমি যাই, সুখে থাক ভালো থাক, মন থেকে এই চাই।’ গানটি গাইলেন সতীনাথ মুখোপাধ্যায়। ১৯৮৬ সালের ২৫ জুন মুম্বাইয়ে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার শেষ সময়েও লিখেছেন – ‘যেতে দাও আমায় ডেকো না, কবে কি আমি বলেছি মনে রেখো না’। ১৯৮৬ সালের ২০ আগস্ট তাঁর মৃত্যুর পরে আশা ভোঁসলের কণ্ঠে গানটি রেকর্ড করা হয় গানটি।

বাংলাভাষার কবি ও গীতিকার গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার। বাংলা সংগীত ভুবনে এক অসাধারণ স্রষ্টা ছিলেন তিনি। তাঁর অসংখ্য অমর সৃষ্টি আমাদের সংগীতকে করেছে সমৃদ্ধ। তাঁর গান বিভিন্ন কণ্ঠে বার বার শুনেও যেন আশ মেটে না বাঙালির। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাকে ২০১২ সালে মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননাদেওয়া হয়। বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী ও বেড়ে ওঠা এই শিল্পীর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা।

লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাক্তন উপউপাচার্য,

পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজুম্’আর খুতবা
পরবর্তী নিবন্ধসুপার ফোরে জয় দিয়ে শুরু পাথরঘাটা দূর্বারের