১. শুরু করব পরশ্রীকাতর বাঙালির একটি গল্প দিয়ে।
এক যুবক বিয়ে করবে তা শুনে তার পরশ্রীকাতর প্রতিবেশী বলে বেড়ায়, বিয়ে করলে কী হবে ওরতো সন্তান হবে না। যুবকটি একদিন সন্তানের পিতা হলো, প্রতিবেশী বলল, হলে কী হবে লেখাপড়া শেখাতে পারবে না। সন্তানটি লেখাপড়া শুরু করলো, প্রতিবেশী বলল, পড়লে কী হবে, পাশতো করবে না। পাশ করার পর বলল, পাশ করলে কী হবে চাকরিতো পাবে না। চাকরিও পেয়ে গেল একদিন সন্তানটি। তারপর হতাশ সে পরশ্রীকাতর প্রতিবেশীটি বলল, চাকরি পেলে কী হবে বেতনতো পাবে না।
নির্বাচন নিয়ে কয়েকবছর ধরে বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর অবস্থাও হয়েছে সে পরশ্রীকাতর পড়শীর মতো। নির্বাচনের এক ঘণ্টা আগেও বলেছে, এ নির্বাচন হবে না। এখন নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর বলছে, দেখেন না এই সরকার টিকবে না। সরকার টিকবে না এ কথা তারা ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের পরেও বলেছিল। এবার নির্বাচন গত দুই নির্বাচনের চেয়ে ভালো হয়েছে। ফলে এই সরকারও আগামী পাঁচ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
২. দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ ইশতেহার ঘোষণাকালে ভোটার তথা জনগণকে যে প্রতিশ্রুতিগুলো দিয়েছিল তার অন্যতম ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার। আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি অব্যাহত থাকবে। প্রশাসনে দুর্নীতি নিরোধের লক্ষ্যে সকল ক্ষেত্রে তথ্য–প্রযুক্তির ব্যবহার সমপ্রসারণ করা হবে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে দুর্নীতিবিরোধী মনোভাব গড়ে তোলার জন্য পাঠ্যক্রমে দুর্নীতির কুফল এবং দুর্নীতি রোধে করণীয় বিষয়ে অধ্যায় সংযোজন করা হবে।‘
৩. এবারও সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়লাভ করেছে আওয়ামী লীগ। স্বতন্ত্র যাঁরা তাঁদের বেশিরভাগই আওয়ামী লীগের নেতা। এঁদের হিসাবে ধরলে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাই বলতে হবে।
এবারসহ টানা চারবার শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জয়লাভ করে সরকার পরিচালনা করবে আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬–২০০১ সময়কালসহ পাঁচবারের জন্য আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বে দেশ পরিচালনার সুযোগ পেল। স্বাধীনতার পর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট পর্যন্ত হিসাবটা এখানে ধরলাম না।
এবারের নির্বাচন কেমন হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক চলছে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। লেখাটি যখন লিখছি অর্থাৎ ৯ জানুয়ারি রাত পর্যন্ত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয়ী হওয়ায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে জাপান, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, আর্জেন্টিনা, ইন্দোনেশিয়া, রিপাবলিক অব কোরিয়া, ব্রুনেই দারুসসালাম, মালয়েশিয়া, মিশর, আলজেরিয়া, কুয়েত, লিবিয়া, ইরান, ইরাক, ওমান, কাতার, সৌদিআরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ফিলিস্তিন।
মঙ্গলবার (৯ জানুয়ারি) বাংলাদেশে নিযুক্ত এই দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরা প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। এ সময় স্ব স্ব দেশের পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া দিয়ে অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রদূতরা। এসময় তারা তাদের দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের অভিনন্দন বার্তা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে পৌঁছে দেন। সাক্ষাৎকালে তারা পারস্পরিক স্বার্থ ও উন্নয়ন সংক্রান্ত দ্বি–পাক্ষিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে মতবিনিময় করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ উন্নত সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হবে মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করেন রাষ্ট্রদূতরা। বাংলাদেশের সঙ্গে নিজ নিজ দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন তারা।
গণভবনে আগত রাষ্ট্রদূতদের ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের জনগণ ও সরকারকে অব্যাহতভাবে সহযোগিতা প্রদানের জন্য এসব বন্ধু দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদেরও আন্তরিক ধন্যবাদ জানান তিনি। বাংলাদেশের উন্নয়ন–অগ্রযাত্রায় আগামী দিনগুলোতেও তাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে মর্মে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন।
৪. সদ্য সমাপ্ত দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে তিন প্রতিমন্ত্রীসহ বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে ৫৫ জন হেরেছেন। নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের ২৬ জন প্রার্থী। অন্যদিকে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন ১৬ জন সংসদ সদস্য। তাঁদের মধ্যে ১৩ জনই হেরেছেন। জাতীয় পার্টির বর্তমান ১২ জন সংসদ সদস্যও এবার ভোটে হেরেছেন। তাঁদের মধ্যে দুজন দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলের শরিক তিনটি দলের শীর্ষ তিন নেতাও ভোটে হেরেছেন; যাঁরা বর্তমানে সংসদ সদস্য। হেরেছেন বিকল্পধারার একজন সংসদ সদস্যও। হবিগঞ্জ–৪ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী বেসামরিক বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মো. মাহবুব আলী পরাজিত হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জনপ্রিয় ও যুবলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা ব্যারিস্টার সুমনের কাছে। এ ছাড়া ওয়ার্কার্স পার্টি, জাসদ ও বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি একটি করে আসনে জয় পেয়েছে। ক্ষমতাসীনদের পর সবচেয়ে বেশি জয় পেয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা, ৬২টি আসনে। এর মধ্যে তিনটি আসন ছাড়া বাকি সব আসনের জয়ী প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গেই যুক্ত। আর জাতীয় পার্টি জয় পেয়েছে ১১টি আসনে। সংসদের আসন ৩০০টি, ভোট হয়েছে ২৯৯টিতে। একটি আসনের একটি কেন্দ্রের ভোটের ফল স্থগিত আছে।
নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে যাঁরা পরাজিত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বেশ পরিচিত ও আলোচিত কয়েকজন। এঁদের মধ্যে নেত্রকোনা–৩ (কেন্দুয়া–আটপাড়া) আসনে অসীম কুমার উকিল, মুন্সিগঞ্জ–৩ (মুন্সিগঞ্জ সদর–গজারিয়া) আসনে মৃণাল কান্তি দাস, বরগুনা–১ আসনে (সদর–আমতলী–তালতলী) ধীরেন্দ্র দেবনাথ, মানিকগঞ্জ–২ আসনে সংগীতশিল্পী মমতাজ বেগম, চট্টগ্রাম–১৫ (সাতকানিয়া–লোহাগাড়া) আসনে আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী, যশোর–৬ (কেশবপুর) আসনে শাহীন চাকলাদার, গাজীপুর–৫ (সদর–কালীগঞ্জ) আসনে মেহের আফরোজ চুমকি এবং চট্টগ্রামের পটিয়া আসনে সাবেক হুইপ শামসুল হক, দলের মনোনয়ন না পেয়ে তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছিলেন।
এছাড়া হেরেছেন যশোর–৫ (মনিরামপুর) আসনে পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য। ঢাকা–১৯ আসনে (সাভার ও আমিনবাজারের একাংশ) ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সংসদ সদস্যদের মধ্যে এবার সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ান এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন মনোনয়ন পাননি। এই তিনজন নির্বাচনও করেননি।
অবাধ, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দাবি করলেও এই চিত্র দেখে বলার উপায় নেই যে, নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি। যদি তা না হতো তাহলে এত বাঘা বাঘা প্রার্থী ধরাশায়ী হতেন না। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা ক্ষমতায় থেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন কিন্তু তা সত্বেও যে তারা ভোটে প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি তা বোঝাই যাচ্ছে। ফলে নির্বাচন একতরফা হয়েছে, অগ্রহণযোগ্য হয়েছে তা বলার সুযোগ নেই।
সে সঙ্গে আরেকটি দিক লক্ষণীয় যে, ক্ষমতায় থাকলে অনেকে বাস্তবতা থেকে দূরে সরে যায়। অনেকে ভাবে ক্ষমতা বুঝি চিরস্থায়ী। কিন্তু তা নয়। ভুক্তভোগী, বঞ্চিত মানুষ সুযোগ পেলেই তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবে। কাজেই যারা পুনর্বার নির্বাচিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, যাঁরা নতুনভাবে নির্বাচিত হয়েছেন তাঁদের এখন থেকেই শিক্ষাটা নেওয়া উচিত। জনমতকে তোয়াক্কা করে চলা উচিত। মনে রাখতে হবে পাঁচ বছর পর তাঁদেরকে জনগণের কাছে কৈফিয়ত দিতেই হবে।
৫. লেখাটি যেদিন প্রকাশ হবে সেদিনই নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরপর চারবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাগ্রহণকারী সরকারের কাছে আমাদের বিশেষ কোনো দাবি নেই। গত পনেরো বছরে দেশ অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে। এমনকিছু মেগাপ্রকল্প সম্পন্ন হয়েছে যা বাংলাদেশে সম্ভব সেটাও কল্পনা করেনি অনেকে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বগুণের বৈশিষ্ট্য হলো তিনি স্বপ্ন দেখেন, সে স্বপ্ন জাতিকে দেখান এবং শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত করতে পারেন। এই গুণ সব রাষ্ট্রনায়কের থাকে না। যাঁর থাকে তিনিই হয়ে ওঠেন সফল রাষ্ট্রনায়ক। বর্তমানে বিশ্বে শেখ হাসিনার সমপর্যায়ের কোনো রাষ্ট্রনায়ক নেই। তাঁর মতো অসীম সাহসী, দৃঢ় চিত্তের নেতা নেই যিনি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে থাকেন। যিনি অসীম সাহসে যেকোনো পরাশক্তির অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাঁর মত প্রকাশ করেন।
তাঁর কাছে আমাদের একমাত্র দাবি এবার তিনি যেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে সত্যিকার জিরো টলারেন্স দেখান। ঘুষখোর, মজুতদার, সিন্ডিকেট, লুটেরা, টাকা পাচারকারী ব্যাংকলুটেরাদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান গ্রহণ করেন। কাজটি কঠিন হলেও এটা তাঁকেই করে যেতে হবে কারণ তিনি জাতির পিতা শেখ মুজিবের কন্যা। লেখক : কবি–সাংবাদিক