কাল আজকাল

আমাদের দৈন্য, আমাদের সীমাবদ্ধতা

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩০ নভেম্বর, ২০২৩ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

পত্রপত্রিকাসহ নানাভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অপরাজেয় বাংলার ছবি যখন দেখতাম আমি মুগ্ধ হতাম। ছবি দেখে আমার ধারণা হয়েছিল অনেক উঁচু বেদীতে নির্মিত আমাদের গৌরব ও অহংকারের প্রতীক এই অপূর্ব ভাস্কর্যটি। কিন্তু আমার সে মুগ্ধতা কেটে গেল প্রথম যেদিন ঐতিহাসিক সে স্থাপনাটি সামনাসামনি দেখলাম। শত শত পোস্টার আর ফেস্টুনে ঢাকা স্থাপনাটি এত নিচুতে নির্মিত যে সেটি আর দশটি ভাস্কর্যের চেয়ে আলাদা মনে হয়নি আমার কাছে।

শৌর্যবীর্য, বিপ্লবসংগ্রাম, স্বাধীনতা ও জাতির গৌরবঅহংকারের এমন মনুমেন্ট, প্রতীক বা ভাস্কর্য এমন উঁচুতে করতে হয় প্রথম দর্শনেই যেন মানুষের মনে তার বিশালত্বের ছাপ পড়ে। দর্শককের মনস্তত্ত্বে প্রভাব বিস্তার করে, মোহিত করে। অনেক উঁচুতে মন্দির নির্মাণ, বৌদ্ধমূর্তি স্থাপন এই চিন্তায় করা হয়েছে। করা হয়েছে কুতুবমিনার, আইফেল টাওয়ার, স্ট্যাচু অব লিবার্টি ইত্যাদি।

অপরাজেও বাংলার মতো একই অনুভূতি হয়েছিল কেন্দ্রীয় শহিদমিনার দেখে। বাংলাদেশের জাতীয় স্মৃতিসৌধ ছাড়া আর তেমন কোনো মনুমেন্ট নেই এত উঁচুতে। আমার ধারণা এটা না হওয়ার সুক্ষ্মতম কারণটি হলো বাঙালির দৈন্য, বাঙালির ক্ষুদ্রতা। এদেশের একশ্রেণির মানুষ তো আবার এমন স্মৃতিসৌধ, মনুমেন্ট ও ভাস্কর্যবিরোধী। ধর্মীয়ভাবে মনে করে এটা নাজায়েজ। কাজেই খুব আন্তরিক ও খোলামনে এরা চায় না এ দেশে (তাদেরভাষায়) মূর্তিপূজা হোক। এই মানসিকতার একটি সুক্ষ্ম প্রভাব লক্ষ্য করা যায় বিশেষ করে এসব ক্ষেত্রে।

এই গৌরচন্দ্রিকার অবতারণা করলাম সমপ্রতি চট্টগ্রাম কালচারাল কমপ্লেক্স ও শহিদমিনার নিয়ে সৃষ্ট বিতর্ক বিষয়ে কিছু লিখব বলে।

২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এ প্রকল্পে কাজ শেষ হওয়ার লগ্নে এখন চট্টগ্রামের সুশীল শ্রেণি ও সংস্কৃতিকর্মীরা বলছেন, আমাদের শহিদমিনার কই? ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে কাজ শুরু হওয়া সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল শুরুতে প্রায় ২৩২ কোটি টাকা। চট্টগ্রামবাসীর শিক্ষা, গবেষণা ও সংস্কৃতিচর্চার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে এ সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেয় বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর। তবে বর্তমানে সাংস্কৃতিক কমপ্লেক্স প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৮১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

১৯২৫ সালে চট্টগ্রামের কিছু সংস্কৃতি ও সমাজসেবীর উদ্যোগে চট্টগ্রাম নগরীর প্রাণকেন্দ্রে চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রায় শতাব্দীকাল ধরে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানা আয়োজন হয়েছে এখানে। ১৯৫৯ সালে সরকার মুসলিম ইনস্টিটিউট অধ্যাদেশের মাধ্যমে হলটি অধিগ্রহণ করে। ১৯৬৩ সালে ইনস্টিটিউটে স্বল্প পরিসরে গণগ্রন্থাগারের কার্যক্রম শুরু হয়।

সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ প্রকল্পের আওতায় নতুন নির্মিত আটতলা মুসলিম ইনস্টিটিউটে বর্তমানে ৯০০ আসনের মিলনায়তন এবং ৩৫০ আসনের মিনি অডিটরিয়াম করা হয়েছে। এখানে একশ ও দু’শ আসনের দুটি সেমিনার কক্ষ থাকছে। আছে একটি আর্ট গ্যালারি ও স্যুভেনির শপ। নবনির্মিত ১৫তলা পাবলিক লাইব্রেরিতে একসঙ্গে মোট দেড় হাজার পাঠক বসে পড়তে পারবেন। আছে একটি বড় ও একটি ছোট সেমিনার হল। এছাড়া আইসিটি লাইব্রেরি, রেস্ট হাউজ ও ডরমেটরিও থাকছে।

প্রকল্পের অধীনে পুরনো শহীদ মিনারের আদল ঠিক রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন শহীদ মিনার ও উন্মুক্ত গ্যালারি। সাংস্কৃতিক কমপ্লেঙ থেকে ২১ ফুট উঁচু পথ ধরে হেঁটে যাওয়া যাবে সেই শহীদ মিনারে। গত ২৮ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বেশকিছু প্রকল্পের সঙ্গে এটিরও উদ্বোধন করেন।

নবনির্মিত শহিদমিনার নিয়ে এই প্রশ্ন তোলার পর আরেক পক্ষ প্রশ্ন তুলেছে, এতদিন ছিলেন কোথায়? তাদের প্রশ্ন এতদিন ধরে এই শহরে সবার সামনে এটি নির্মিত হলো। নির্মাণের সময় কেউ কিছুই বলল না। চালু হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কেন এমন প্রশ্ন?

দেখতে হবে আসলে ভুলটা কোথায়! ভুলটা আসলে আমাদের মাথায়। এখানে একটি ১৫ তলাবিশিষ্ট বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার ভবন হয়েছে। ৯ তলাবিশিষ্ট মুসলিম ইনস্টিটিউট হল হয়েছে এবং বিশাল প্লাজাসহ শহিদমিনার হয়েছে। পাশে গ্যালারিসহ মুক্তমঞ্চ হয়েছে। সবকিছু ঠিক আছে। তবে পুরো কমপ্লেক্সটি হয়েছে আমলা ও সরকারি কর্তাদের দৃষ্টিতে, ভাবনাতে। সংস্কৃতিকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গি বা ভাবনাতে নয়। যে কারণে শহিদমিনারটিকে তাঁরা দোতলায় নিয়ে গেছেন। তাঁদের মাথায় ছিল একটি কালচারাল কমপ্লেক্স। ফলে তাঁরা শহিদমিনারটিও কমপ্লেক্সে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা বুঝতেই পারেননি একটি কমপ্লেঙ আর একট সৌধ বা মনুমেন্টের পার্থক্য। এখানে আমাদের একটি অভিজ্ঞতার কথা বলি। রাউজানের এমপি জনাব ফজলে করিম চৌধুরী তখন রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি হয়েছেন। আমরা নববর্ষ উদযাপন পরিষদের সবাইকে ডেকে তিনি বললেন, আমি আপনাদের জন্য কী করতে পারি। আমাদের বলার পর তিনি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। এখন যা হয়েছে তার সবটুকুই হয়েছে তাঁর আন্তরিক উৎসাহে। তিনি বললেন, আপনাদের মনপুত না হওয়া পর্যন্ত কাজ চলবে। তিনি কাজের অগ্রগতি দেখতে বেশ কয়েকবার গেছেন। কাজ প্রায় শেষ এ সময় একদিন আমাদের মধ্যে একজন ফোন করে বললেন দ্রুত সিআরবি যেতে। গিয়ে আমাদের চক্ষু চরকগাছ। মঞ্চের মাঝখানে শেকড়ের একটি বড় অংশ রয়ে গেছে। আমরা কনসার্ন প্রকৌশলীকে ডাকলাম। তিনি এসে বললেন, শেকড়ের ওপর একটি মঞ্চ হচ্ছে কাজেই মঞ্চে শেকড় না থাকলে কেমন হবে। এটা একটা আর্ট। আমরা প্রতিবাদ করে বললাম, এটা কীভাবে সম্ভব? মঞ্চে শিল্পীরা নাচ করবে কীভাবে? নাটক করবে কীভাবে?

তাঁর স্ত্রী রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে বললেন, ভাই এটা হচ্ছে প্রকৃতিকে ঠিক রেখে ডিজাইন করা। আমরা এমপি মহোদয়কে ফোন করলাম। তিনি প্রকৌশলীকে বাসায় ডেকে নিয়ে বললেন, এনারা যেভাবে বলবে সেভাবে কাজ করবেন। ভুল করলে বারবার ভাঙাব। শেষে কাটা হলো শেকড়।

কাজেই মনে রাখা দরকার মাঠের মানুষ আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসের মানুষের মধ্যে পার্থক্য থাকবে।

এরপর প্রশ্ন উঠেছে কমপ্লেক্সের পরিকল্পনা, ডিজাইন ও লেআউট চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিকর্মীরা কি দেখেননি? তখন তাঁরা এ নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি কেন? এঁদের মধ্যে কেউ কি পরামর্শক কমিটিতে ছিলেন না। কেউ কি দেখভালও করেননি? যতদূর জানি এটার পরিকল্পনার সময়ে তৎকালীন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সঙ্গে চট্টগ্রামের ঘনিষ্ঠদের অনেকেই ছিলেন। তাঁরা কী দাবি করেছিলেন, কী পরামর্শ দিয়েছিলেন তা জানি না। বলাবাহুল্য, আমি এ সংক্রান্ত কোনো মিটিংয়ে আমন্ত্রিত হইনি, ফলে সৌভাগ্যগুণে উপস্থিত থাকার দুর্ভাগ্য হয়নি আমার। এমনকি কয়েকদিন আগে মেয়রের ডাকা দু দফা বৈঠকে নয়।

আমরা সাধারণ মানুষেরা শুনেছিলাম মুসলিম হল, গ্রন্থাগার আর শহিদমিনার পুরোটা জুড়ে কমপ্লেক্স হবে। রাস্তার ওপর এমন বিশাল একটি প্লাজা এবং সে প্লাজার ওপর শহিদমিনার স্থাপিত হবে তেমন কিছু শুনিনি। আমরা আদার ব্যাপারি জাহাজের খবর নিতে কমপ্লেক্সের ধারেকাছে যাওয়ারও সাহস করিনি।

কাজের সুবিধার্থে বছর দুয়েকের জন্য শহিদমিনার স্থানান্তরিত হয়েছিল মিউনিসিপ্যাল স্কুল মাঠে। তা নিয়ে অনেক সংস্কৃতিকর্মী অসন্তোষ প্রকাশ করে তা যত দ্রুত সম্ভব পূর্বের জায়গায় পুনঃস্থাপনের দাবিও তুলেছিলেন। তবে এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শহিদমিনার আগের ডিজাইন বদলানোর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারিও উচ্চারণ করেছিলেন। এটা তাঁরা কোন যুক্তিতে করেছিলেন জানি না। তবে আমি এটা জানি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দেশের সব শহিদমিনার ঢাকায় অবস্থিত কেন্দ্রীয় শহিদমিনারের আদলে করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তাঁর সে নির্দেশের ব্যত্যয় কেন ঘটল তাও জানি না। আমরা এবং আমাদের সন্তানরা শহিদমিনার বলতে ঢাকার শহিদমিনারের আদলটাকেই বুঝি। আমাদের শহিদমিনারের যে আর্কিটেকচারাল ডিজাইন ও নির্মাণশৈলী তার একটা অর্থ আছে। ফলে দেশজুড়ে যার যেমন ইচ্ছা তেমন শহিদ মিনার বানানোর অধিকারও নেই। একটি সৌধ বা মনুমেন্টের একটি অর্থ থাকে। ইটসিমেন্টের কয়েকটি খাম্বা একটি সৌধ হতে পারে না।

নতুন শহিদ মিনারের সমস্যা হলো এটা নিচে থেকে দেখা যায় না। আগের মিনারটি যেমন দেখা যেত, অনেক দূর থেকেও দেখা যেত। একটি পনেরো তলা ও আরেকটি নয়তলা ভবনের বিপরীতে এটাকে একটি শহিদমিনারের বনসাই বলে মনে হচ্ছে। যদিও প্লাজার ওপর প্রচুর খালি জায়গা আছে কিন্তু সেখানে অনুষ্ঠান বা বইমেলার মতো কিছু করার সুবিধা নেই। শহিদমিনারটিও দেখতে হলে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতে হবে। কয়েকদিন আগে ডা. অনুপম সেন উঠতে পারেননি। কবি আবুল মোমেন অনেক ঝুঁকি নিয়ে উঠেছিলেন আর নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী আছাড় খেয়ে পড়ে গিয়েছিলেন। আমরা ভেবেছিলাম মুসলিম হল থেকে শহিদ মিনার পর্যন্ত পুরো জায়গাটিই সমতলে একীভূত হয়ে যাবে।

এখন একটি সুরঙ্গ হয়েছে। দিনের বেলা যেতেও ভয় লাগার কথা।

মোট কথা কমপ্লেক্স হিসেবে সব ঠিক আছে কিন্তু জাতির শৌর্যবীর্যের প্রতীক, বাঙালির ভাষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রতীক, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আন্দোলনের প্রতীক শহিদ মিনারকে দৃশ্যমান করতে হবে। আরও আরও উচ্চতায় তার অভিষেক হতে হবে যা দেখে ভক্তি ও শ্রদ্ধায় সবাই অবনত হবে।

পুনশ্চ, এক চিলতে সবুজ কোনোভাবে বেঁচেছিল বিপ্লব উদ্যানে। তার অর্ধেক কংক্রিটে ঢেকে দিয়ে খাবারের দোকান করা হয়েছিল ২০১৮ সালে। এবার বাকিটুকু খাওয়ার ব্যবস্থা সুসম্পন্ন হয়েছে। চট্টগ্রামের পাঁচটি পত্রিকা অভিন্ন রিপোর্ট করেছিল কয়েকদিন আগে। লেখা হয়েছিল অভিন্ন সম্পাদকীয়। পাঠকরা তা থেকে বিশদ জেনেছেন। চট্টগ্রামের মানুষ এবার সিদ্ধান্ত নিক এই অন্যায়টুকু তারা করতে দেবে কিনা। সে সঙ্গে ২০১৮ সালে এবং এবার এ কাজে সিটি করপোরেশনের কী লাভ হয়েছে তার একটি শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবিও তুলুক।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিশুর মন মানসিকতা
পরবর্তী নিবন্ধমৎস্যখাতে কর্মরত নারীদের পেশাগত স্বাস্থ্যঝুঁকি নিয়ে কর্মশালা