কাল আজকাল

কৃতঘ্ন জাতির দেশে একজন শেখ হাসিনা

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২৩ at ৬:০৫ পূর্বাহ্ণ

খুব দূরের অতীত নয়, কার্তিকঅগ্রহায়ণ মাস এলে মঙ্গা দেখা দিত দেশে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলের লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, রংপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব হতো। দৈনিকগুলোর প্রতিদিনের পাতায় সে অঞ্চলের অসহায়, ক্ষুধার্ত মানুষের জীর্ণশীর্ণ ছবি ও অভাবঅনটনের সংবাদ ছাপা হতো। খেতে না পেরে মানুষ মারা যাচ্ছে সে ধরনের সংবাদও স্থান পেতো সংবাদপত্রে। অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠন ত্রাণ নিয়ে যেত সেসব চরাঞ্চলে। অভাবে দু বেলা ভাত খেতে না পারা অনেক পরিবারকে আমি চট্টগ্রামেও দেখেছি। আজ সে বাংলাদেশে কোনো মঙ্গা নেই। অনেকে মঙ্গা শব্দটির অর্থও বুঝবে না এখন। সে বাংলাদেশে আজ না খেয়ে আছে তেমন কোনো খবর পাওয়া যায় না। (মহামারি, রাশিয়াইউক্রেন যুদ্ধ ও অতি সমপ্রতি হামাসইসরাইল যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি চাপে পড়া সত্ত্বেও)

সে বাংলাদেশে আজ কিছু পত্রিকা নিউজ(?) করে ‘মাংসের স্বাধীনতা চাই’, ‘মানুষের পাতে প্রোটিন কমে গেছে‘, ‘প্রতিদিন ডিম খেতে পারে না চার কোটি মানুষ।

এই লেখাটি যেদিন লিখছি সেদিন অর্থাৎ ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রামে প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ ‘শেখ হাসিনা সরণি’ (পূর্বাচল এক্সপ্রেসওয়ে) এবং সে সঙ্গে দেশব্যাপী ২৪টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ১৫৭টি প্রকল্পের ৫ হাজার ৩৬০টি অবকাঠামোর সমন্বিত উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একই অনুষ্ঠানে আশ্রয়ণ২ প্রকল্পের আওতায় ৫ হাজার ৩৯৭টি ভূমিহীন এবং গৃহহীন পরিবারকে ঘর উপহার দিয়েছেন তিনি। মঙ্গলবার সকালে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে অবকাঠামোগুলোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন ও উদ্বোধন করেন। এসব প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৯৭ হাজার ৪৭১ কোটি ৩ লাখ টাকা। বলা যায় লক্ষ কোটি টাকা।

অনুষ্ঠানে ১৫৭টি উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় ৯ হাজার ৯৯৫টি অবকাঠামোর উদ্বোধন এবং ৪৬টি অবকাঠামোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী। এসব প্রকল্পের মধ্যে আরও রয়েছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতর নির্মিত বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১ হাজার ২৫৯টি ভবন এবং প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের আওতাধীন ২ হাজার ২৩টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনা; নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন চট্টগ্রাম বন্দর, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ), বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) এবং বাংলাদেশ স্থলবন্দরের ১৫টি উন্নয়ন কাজের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন প্রভৃতি।

চট্টগ্রামের ৯টি প্রতিষ্ঠানের ১৫টি প্রকল্পের মধ্যে অন্যতম হলো লালখান বাজার থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এটির নামকরণ করা হয়েছে প্রয়াত জননেতা, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরীর নামে।

মহানগরীর সড়ক উন্নয়নে আরেক ধাপ অগ্রগতি এই এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। বিমানবন্দরকেন্দ্রিক যানজট নিরসনে ২০১৯ সালে সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কাজ শুরু করে। আগ্রাবাদ, বারিকবিল্ডিং, সল্টগোলা, ইপিজেডের দীর্ঘ যানজট ঠেলে লালখান বাজার থেকে চট্টগ্রাম আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছতে সময় লাগতো দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। এতে চরম ভোগান্তি পোহাতে হতো বিমানবন্দরগামী যাত্রীদের। এক্সপ্রেসওয়ে চালুর পর সে দুর্গতির অবসান ঘটবে। এক্সপ্রেসওয়ে সমুদ্রবন্দর ও বিমানবন্দরের কানেকটিভিটি সহজ করবে বলে আশা করছেন ব্যবসায়ীরা। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুরোপুরি সুবিধা পেতে সব র‌্যাম্প চালু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েটির সাথে প্রধানমন্ত্রী আরও উদ্বোধন করেছেন ৫৩৭ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বায়েজিদফৌজদারহাট ৫ কিলোমিটার লিংক রোড এবং চন্দনপুরাকালামিয়া বাজার দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ এক্সেস সড়ক। পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল, যা প্রায় দেড় বছর ধরে অলস পড়েছিল। চিটাগাং কনটেইনার টার্মিনাল (সিসিটি), নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালের (এনসিটি) পর চট্টগ্রাম বন্দরের তৃতীয় কনটেইনার টার্মিনাল হিসেবে যাত্রা শুরু করছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি)। জেদ্দাভিত্তিক সৌদি কনটেইনার টার্মিনাল ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল লিমিটেড পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের আধুনিকীকরণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালন করবে।

সে সঙ্গে সিরাজউদ্দৌলা রোড হতে শাহ আমানত ব্রীজ সংযোগ সড়ক (বাকলিয়া এক্সেস) নির্মাণ, যেটির নামকরণ করা হয়েছে জানে আলম দোভাষ সড়ক। চট্টগ্রামের আগ্রাবাদস্থ সিজিএস কলোনীতে জরাজীর্ণ ১১টি ভবনের স্থলে ৯টি বহুতল আবাসিক ভবনে সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য ৬৮৪টি ফ্ল্যাট নির্মাণ। ঢাকা ট্রাংক রোড হতে বায়েজিদ বোস্তামী রোড পর্যন্ত সংযোগ সড়কের নির্মাণ কাজেরও উদ্বোধন করেছেন। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বাকলিয়া এক্সেস রোড ও বায়েজিদফৌজদারহাট লিঙ্ক রোড নগরীর সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় গতি পরিবর্তন করবে বলে আশা করছে নগরবাসী। তবে এক্সপ্রেসওয়ের পূর্ণ সুফল পেতে হলে এর র‌্যাম্পগুলোর দ্রুত নির্মাণ জরুরি।

এ কাজগুলোর অধিকাংশই অবকাঠামোগত উন্নয়ন। ফলে এ উন্নয়নগুলো সহজে দৃষ্টিগোচর হয়। আলোচিত হয়। আমরা অনেক সময় বলে থাকি অবকাঠামো তো বহু হলো এর পাশাপাশি মানবিক উন্নয়ন কতটা হলো? সে বিষয়টি কিছুটা অনালোচিত। এই বাংলাদেশে যে বিশ্বের বৃহত্তম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উদ্বাস্তুদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে তার খবর আমরা কজন জানি।

কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের বাঁকখালী নদীর তীর ঘেঁষা বৃহৎ এ প্রকল্পে নির্মিত ২০টি পাঁচ তলা বিশিষ্ট ভবনে ৬শ’টি পরিবারকে নতুন ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। প্রতিটি পাঁচতলা ভবনে আছে ৪৫৬ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ফ্ল্যাট। পর্যায়ক্রমে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবারকে এখানে ফ্ল্যাট দেওয়া হয়েছে। এখানে প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক র‌্যাম্প, সোলার প্যানেল, বিশুদ্ধ পানির সুবিধা, বিদ্যুৎ, স্যানিটেশন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, ড্রেনেজ ব্যবস্থা এবং গ্যাস সিলিন্ডার সম্বলিত চুলার ব্যবস্থা আছে। এই প্রকল্পে ২৫৩ দশমিক ৫৯ একর জমির ওপর নির্মাণাধীন ১৩৯টি ৫ তলা বিশিষ্ট ভবনে ৪ হাজার ৪০৯টি পরিবার পুণর্বাসিত হবে। যার ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮শ’ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। প্রকল্প এলাকায় ২০ কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ রাস্তা, ৩৬ কিলোমিটার ড্রেনেজ ব্যবস্থা, বর্জ্য পরিশোধন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা, তীর রক্ষা বাঁধ, ছোট সেতু, ১৪টি খেলার মাঠ, মসজিদ, মন্দির, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, পুলিশ ও ফায়ার স্টেশন, তিনটি পুকুর, নদীতে দু’টি জেটি এবং দুটি বিদ্যুতের সাবস্টেশন গড়ে তোলা হচ্ছে।

জলবায়ু উদ্বাস্তু ছাড়াও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিক্ষুক, বেদে, দলিত, হরিজনসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সমপ্রদায়ের মানুষের জন্যও জমিসহ ঘর প্রদান করা হচ্ছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার মাধ্যমে তাদেরকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে প্রকল্পের শুরু থেকে এ পর্যন্ত শুধু আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্যারাক, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন প্রকার ঘর ও মুজিববর্ষের একক গৃহে মোট ৫ লক্ষ ৫৪ হাজার ৫৯৭টি ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। ৪০০ বর্গফুট আয়তনের ২ কক্ষ বিশিষ্ট সেমিপাকা একক গৃহ। এই ঘরে সুপরিসর ২ টি কক্ষের সামনে টানা বারান্দা এবং পেছনে রয়েছে রান্নাঘর ও স্বাস্থ্যসম্মত স্যানিটারি ল্যাট্রিন। বিনামূল্যে বিদ্যুৎ সংযোগের পাশাপাশি পুনর্বাসিতদের জন্য রয়েছে নিরাপদ সুপেয় পানির ব্যবস্থা। ক্লাস্টারভিত্তিক স্থাপিত প্রকল্প গ্রামগুলোতে সুনির্দিষ্ট দৃষ্টিনন্দন লেআউটের মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ রাস্তা, কমিউনিটি সেন্টার, পুকুর, খেলার মাঠ প্রভৃতি নিশ্চিত করা হয়।

এ ছাড়া সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ৪৯ লাখ বয়স্ক পুরুষ ও নারীকে বয়স্ক ভাতা, জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ২০ লাখ ৫০ হাজার নারীকে বিধবা ভাতা, জনপ্রতি মাসিক ৭৫০ হারে ১৮ লাখ ব্যক্তিকে প্রতিবন্ধী ভাতা দেওয়া হচ্ছে। তাঁরই হাতে গড়ে তোলা বাংলাদেশের সব মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশে এই অনন্য কমিউনিটি ক্লিনিকভিত্তিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করেছিলেন, যা সারাদেশের তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের দোরগোড়ায় সরকারের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সুফল সরবরাহে বিপ্লব ঘটিয়েছে। মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার লক্ষ্যে সরকার এ পর্যন্ত সারা দেশে পাবলিকপ্রাইভেট অংশীদারিত্বে ১৪ হাজারেরও বেশি কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করেছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অদম্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করবে। এ বছর থেকে শুরু হয়েছে সব মানুষের জন্য পেনশন স্কিম।

শেখ হাসিনা যা করেছেন তা অতীতে কেউ করেননি। ভবিষ্যতে করতে পারবে তার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে শেখ হাসিনার মতো নেতার দরকার যিনি স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান এবং সে স্বপ্ন পূরণ করার যোগ্যতা ও সাহস রাখেন।

কাজেই উপকারভোগী এই মানুষগুলো কি আমেরিকার প্রেসক্রিপশন মোতাবেক গণতন্ত্রের জন্য দাবি জানাবে? পশ্চিমাদের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিণতি তো আমরা ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, পাকিস্তানে প্রত্যক্ষ করেছি। ফলে বাংলাদেশেও তারা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে কী ঘটাতে চাইছে তা সহজে অনুমেয়। আগে বাংলাদেশের জনগণের দারিদ্র্য বিমোচন হোক তারপর না হয় তাদের পছন্দের গণতন্ত্রের কথা ভাবা যেতে পারে। আমরা আমাদের মতো থাকি, আমাদের মতো বাঁচি।

লেখক : কবিসাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ রুমীকে নিয়ে সুজন বড়ুয়ার আবেগঘন উপন্যাস ‘ভোরের সূর্যমুখী’
পরবর্তী নিবন্ধকেইপিজেডের উদ্যোগে দুই মাসব্যাপী পরিচ্ছন্ন কর্মসূচি