‘বারান্দায় ছেলের ছবির পাশে আনমনে বসে আছেন হারুন অর রশিদ (৮৪)। ঘরের ভেতর শুয়ে আছেন হাসিনা বেগম (৭০)। তাঁর চোখে ছলছল করছে পানি। প্রতিবছর আগস্ট এলেই ছেলে হারানোর বেদনায় এমন ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠেন এই দম্পতি। তাঁদের সন্তান মাহবুবুর রশিদ ২০০৪ সকালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিদের একজন। ২০০১ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নিয়েছিলেন মাহবুবুর। কিছুদিন পরই যোগ দেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে। তাঁর বাড়ি কুষ্টিয়ার খোকসার ফুলবাড়িয়ায়। হাসিনা বেগমের শারীরিক অবস্থা এখন তেমন ভালো নয়। বললেন, “বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে ওঠে। বয়সের ভারে এখন আর বুকভরে শ্বাস নিতে পারি না। আগস্ট মাস আসলেই কষ্ট ও জ্বালা বেড়ে যায়।’
“মাথা আর পিঠ ছাড়া গোটা শরীরে স্প্লিন্টার ঢুকেছে। দেশ–বিদেশে মোট ১২ বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। তবে সব বের করা যায়নি। ডান হাত ও দুই পায়ের হাড়ের সঙ্গে লেগে আছে স্প্লিন্টার। বুকের বাঁ পাশেও আছে একটি। ছয়– সাতটি স্প্লিন্টার খুব যন্ত্রণা দেয়। তবে শরীরের বিভিন্ন অংশে থাকা স্প্লিন্টারগুলো নিয়ে ততটা অসুবিধা হয় না।”
কথাগুলো বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী শাহানারা ইয়াসমিন। তিনি ১৯ বছর ধরে এই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় স্প্লিন্টারবিদ্ধ হন তিনি।
“আজ আমি জীবন্ত লাশ। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হওয়ার পর আমি পাঁচ বছর হুইলচেয়ার ব্যবহার করেছি। সাত বছর ক্র্যাচে ভর দিয়ে চলাফেরা করেছি। স্প্লিন্টারের যন্ত্রণায় মধ্যরাতে ছটফট করলেও শুধু হাসপাতালে যাওয়ার জন্য নিজস্ব কোনো গাড়ি না থাকায় আমি যেতে পারি না। স্প্লিন্টারের জ্বালাপোড়ায় রাতে ঘুমাতে পারি না। বলতে গেলে আমি কুঁড়ে কুঁড়ে মরে যাচ্ছি। দিনের বেলা স্প্লিন্টারের যন্ত্রণা অনেকটা কম থাকলেও রাতের বেলায় বেড়ে যায়। মৃত্যুর আগে আমার প্রত্যাশা ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার রায়ের বাস্তবায়ন দেখে যাওয়া। এটিই হবে আমার জন্য সবচেয়ে বড় উপহার।” বর্তমানে ঢাকা জেলা (উত্তর) স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি, শরীরে ১হাজার ৭৯৭টি স্প্লিন্টার বয়ে বেড়ানো মাহবুবা পারভীনের।‘
উপরের উদ্ধৃতিগুলো ২১ আগস্টে একটি দৈনিকে ছাপানো কয়েকটি প্রতিবেদন থেকে নেওয়া। আসলে ২১ আগস্টে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলার ভয়াবহতা লিখে প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এই ভূখণ্ডে সংঘটিত দুটো ভয়াবহ ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের এটি একটি। অন্যটিও অগাস্ট মাসেই সংঘটিত হয়েছিল, ১৫ অগাস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে। দুটো হত্যাকাণ্ডই একই দলের প্রধান ও একই পরিবারের সদস্যকে টার্গেড করে। আর দুটো ঘটনার পরিকল্পনাকারী, বাস্তবায়নকারী একই শক্তি। সে একই শক্তি যারা মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের বিচার বাধাগ্রস্ত করেছিল।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সে হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করতে খন্দকার মোশতাক অর্ডিন্যান্স জারি করেছিল,মেজর জিয়া তা সংসদে পাশ করিয়েছিল। তারপর জিয়া, এরশাদ, খালেদা জিয়া দীর্ঘ ২৬ বছর ক্ষমতায় থেকে বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দেশে–বিদেশে চাকরিসহ পুনর্বাসন করেছে। খালেদা জিয়া বঙ্গবন্ধুর খুনীদের সংসদ সদস্য হিসেবে বিনাভোটে জিতিয়ে এনেছিল। শেখ হাসিনা একবার ভাগ্যক্রমে ১৯৭৫ সালে বেঁচে গিয়েছিলেন। আরেকবার বেঁচে গিয়েছিলেন ২০০৪ সালে বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউতে আয়োজিত আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে গ্রেনেড হামলা থেকে। আসলে শেখ হাসিনা শুধু দুবার বেঁচে ফিরেছেন বললে ভুল হবে। অনেকে বলেন, অন্তত ২৪ বার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। আমি মনে করি সেটাও ভুল। প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করা হচ্ছে, চেষ্টা করা হচ্ছে।
১৫ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার না হওয়ার জন্য মোশতাক–জিয়া ইনডেমনিটি আইন করেছিল আর একুশ অগাস্টের হত্যাকাণ্ডের বিচার না করার মানসে জজ মিয়া নাটক ফেঁসেছিল। জীবনে যে গুলি দেখেনি, বোমা ও গ্রেনেডের পার্থক্যই যে বোঝে না এমন এক নিরপরাধ যুবককে ধরে এনে এক মিথ্যা ও সাজানো মামলা দাঁড় করিয়েছিল তৎকালীন খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি–জামায়াত জোট সরকার। গ্রেনেড হামলা নিয়ে সংসদে আলোচনার দাবি করেছিল তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগ। তাদের দাবি তো মানেইনি বরং উলটো সংসদনেত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, শেখ হাসিনাই নাকি ভ্যানিটি ব্যাগে করে গ্রেনেড নিয়ে গিয়েছিলেন। এই ঘটনার উনিশ বছর পর ওই দলের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল বললেন, ‘পুরো বিষয়টিই সাজানো নাটক। যেখানে মিটিং হওয়ার কথা ছিল সেখানে না করে অন্য জায়গায় করল। তিনি বলেন, এই ঘটনায় তারেক জিয়া, আব্দুস সালাম পিন্টু, লুৎফুজ্জামান বাবর কেউ জড়িত ছিলেন না।‘
অন্য মামলায় মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া এই মামলার অন্যতম আসামী এবং শেখ হাসিনাকে হত্যার কয়েকবার চেষ্টাকারী মুফতি হান্নান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে বলেছে, ‘এরপর আমি ও আহসান উল্লাহ কাজল সেখান থেকে চলে যাই। পরদিন মাওলানা তাহের আহসান উল্লাহ ও আবু জান্দালকে মিরপুর ১ নম্বর পানির ট্যাংকের কাছে মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সে যেতে বলেন। সেখানে আবদুস সালাম পিন্টু তাঁর সার্বিক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজের ধরন বর্ণনার পর আবু জান্দাল ও কাজলকে নির্দেশনা দেন এবং জনসভাস্থলে যাঁরা হামলার দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের নামের তালিকা দেন। এরপর ২০–০৮– ০৪ তারিখে তাঁদের পিন্টু সাহেবের বাসায় যেতে বলেন। সে অনুযায়ী ২০ তারিখ বেলা ১১টার দিকে জান্দাল ও কাজল পিন্টু সাহেবের বাসায় যান। তখন আবদুস সালাম পিন্টু ও তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন মাওলানা তাহেরের উপস্থিতিতে হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড জান্দাল ও কাজলকে দেন এবং আবু তাহের খরচ বাবদ জান্দাল ও কাজলকে দুই হাজার টাকা দেন। তখন আবু তাহের বলেন, তিনি ২১–০৮–০৪ তারিখ সকালে বাড্ডার বাসার অফিসে আসবেন।’
ব্যাপারটা হলো এসমস্ত ঘটনায় সবসময় দুটো পক্ষ থাকে। আক্রমণকারী বনাম আক্রান্ত বা ঘাতকপক্ষ বনাম নিহতের পক্ষ। ‘৭৫ থেকে এ পর্যন্ত যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেখানে আওয়ামী লীগ একপক্ষ, বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলো অপরপক্ষ। ফলে মির্জা ফখরুল কিংবা তার নেত্রী খালেদা জিয়া, তারেক জিয়া, জামায়াত এবং বিএনপি ঘেঁষা পত্রিকার সম্পাদক ও সুশীল শ্রেণিদের কাছে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড যেমন নিন্দিত নয় তেমনি ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলাকারীরাও নিন্দিত নয়। নিন্দিত হওয়ার কথাও নয় কারণ এরা সবাইতো হত্যার পরিকল্পনাকারী নতুবা উৎসাহদাতা।
আগস্টে যারা শোক করে, আগস্টে যারা ক্ষতিগ্রস্ত তারা কারা? তারা এদেশে কী করতে চেয়েছিল? এরা বাংলাদেশটিকে স্বাধীন করতে চেয়েছিল। হাজার বছরের পরাধীন বাঙালিকে প্রথম মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছিল। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশটিকে সব ধর্মের, সব বর্ণের, সব লিঙ্গের সমমর্যাদাপূর্ণ একটি দেশের পরিণত করতে চেয়েছিল। অন্যদিকে আগস্ট যাদের উল্লাসের তারা হচ্ছে এসবের বিপরীত। সে শক্তি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধেও তারা বিরোধিতা করেছিল। তাতে ব্যর্থ হয়ে পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার মধ্য দিয়ে পরিত্যক্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। আর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা এ পথের বাধাগুলো দূর করতে হত্যা, ষড়যন্ত্র, সন্ত্রাসের পথ বেছে নিয়েছিল। রাষ্ট্রটিকে পাকিস্তান বানানোর প্রধান বাধা, পাকিস্তান রাষ্ট্র ভেঙে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্থপতিকে হত্যা করেছিল। হত্যার জন্য গ্রেনেড হামলা চালিয়েছিল শেখ হাসিনার জনসভায়।
আগস্টে উল্লাস করে যারা সে ঘাতক এবং তাদের সহযোগিরা একনাগাড়ে রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল ৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ২১ বছর দুঃশাসনের শৃঙ্খল ভঙ্গ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় এলেও ২০০১ সালে নির্বাচনে এই দলকে ষড়যন্ত্র করে পরাজিত করা হয়। ২০০১ সালে আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে ঘাতকের দল, আগস্টে উল্লাসকারীদের দল। টানা একুশ বছর রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকেও যখন তারা দেখল যে, দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে বিতাড়িত করা যায়নি। দুর্বল ও নিশ্চিহ্ন করা যায়নি তখন তারা নতুন করে হত্যা ও ষড়যন্ত্রের পথ বেছে নেয় ১৫ আগস্টের মতো। নেতৃত্বশূন্য করে আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে তাদের আদর্শের পাকিস্তানের ভাবধারায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে।
আজ যারা মানবাধিকারের কথা বলে, গণতন্ত্রের কথা বলে, বিএনপি ও আওয়ামী লীগকে একই পাল্লায় ওজন করে তাদের কাছে জানতে চাই তারা কি বাবা–মাসহ পরিবারের সবাইকে হত্যাকারী, নিজেকে হত্যাকারী ও তাদের সহায়তাকারীদের কাছে টানতে পারতেন? বুকের ভেতর গভীর ক্ষত রেখে ঘাতকদের বুকে টেনে নিতে পারতেন?
লেখক : কবি, সাংবাদিক