কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ৩ ডিসেম্বর, ২০২০ at ১০:৩০ পূর্বাহ্ণ

বঞ্চিত চট্টগ্রামের সঞ্চিত দুঃখকথা
একটি পুরনো গানের কথা মনে পড়ে যায়, “নামের বড়াই কর না তো নাম দিয়ে কী হয় / নামের মাঝে পাবে না কো সবার পরিচয়…।” তেমনি চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী, দ্বিতীয় রাজধানী, প্রাচ্যের রানি কত অভিধায় না সিক্ত করা হয়। কিন্তু বাস্তবে? মনোমুগ্ধকর বড় বড় তকমা জুড়ে দিলেও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে চট্টগ্রাম একটি বিভাগীয় শহর ছাড়া বেশি কিছু নয়। দেশের অর্থনীতিতে চট্টগ্রামের বিশাল অবদানের কথা চট্টগ্রামবাসী ছাড়াও অন্যরা বলেন, তবে বললেও তা এক ধরনের প্রবোধ দেওয়ার মতো করে বলেন। রাজনৈতিক বক্তব্যের জন্য বলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো করে বলেন। তবে এ ক্ষেত্রে দেশের সরকার প্রধান মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা। চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য তিনি সত্যিকার অর্থে আন্তরিক। তবে সমস্যা হলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে চট্টগ্রামের সমস্যা ও প্রয়োজন তুলে ধরার মতো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান তেমন নেই।
নগরের প্রসঙ্গে যদি বলি তাহলে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রসঙ্গটি সবার আগে আসে। এই সিটি করপোরেশন আয়তন, লোকসংখ্যা, গুরুত্ব সবদিক দিয়ে ঢাকার পরের স্থানে হলেও এর উন্নয়ন বাজেট ঢাকার চেয়ে বহু অংশে কম। ঢাকা রাজধানী হওয়ার কারণে সব মন্ত্রণালয় থেকে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়া সত্ত্বেও ঢাকা সিটি করপোরেশনের বাজেট বহুলাংশে বেশি। ঢাকার সঙ্গে তুলনা করার কোনো অভিপ্রায় থেকে বলা হচ্ছে না। প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার নিমিত্তে বলা হচ্ছে মাত্র।
সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন রোববার সকালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের পরামর্শক কমিটির সঙ্গে ভার্চুয়াল সভায় এই বাস্তবতাই তুলে ধরেছেন। সভায় তিনি বলেছেন, ‘নাগরিক দুর্ভোগমুক্ত ও সুযোগ-সুবিধাসম্বলিত বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলাই আমার স্বপ্ন। কিন্তু সে স্বপ্ন পূরণে যে আর্থিক সক্ষমতা দরকার তা নেই। নগরীর বিদ্যমান সমস্যাগুলো চিহ্নিত করেছি এবং যেগুলো জরুরি ভিত্তিতে নিরসন প্রয়োজন সেজন্য কাজ শুরু করেছি। পরামর্শক কমিটি থেকে যে পরামর্শগুলো পেয়েছি সেগুলো যৌক্তিক কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। তবে আগামীতে চসিকের নির্বাচিত পরিষদ চট্টগ্রামকে যেন বাসযোগ্য নগরীতে পরিণত করতে পারে সেজন্য কী ধরনের কর্মপরিকল্পনা থাকা দরকার তার একটা ধারণা আমি রেখে যেতে চাই।’
পরামর্শক কমিটির সঙ্গে ভার্চুয়াল সভায় সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে আর্থিক সমস্যা প্রধান অন্তরায়। দায়িত্ব গ্রহণকালে সিটি করপোরেশনের ১০০০ কোটি টাকা দেনা ছিল উল্ল্লেখ করে তিনি বলেন, এই পরিমাণ এখন ১২০০ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।
প্রশাসক বলেছেন, একটি বাসযোগ্য নগরী গড়ে তোলার যে স্বপ্ন তা পূরণে প্রধান অন্তরায় আর্থিক অসচ্ছলতা। সিটি করপোরেশনের আর্থিক অসচ্ছলতা দূর করার লক্ষ্যে তিনি বন্দর ও কাস্টম থেকে এক পারসেন্ট সার্ভিস চার্জ আদায়ের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করেছেন এবং এ সংক্রান্ত প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়েও প্রেরণ করেছেন। একই প্রস্তাব তিনি পরামর্শক সভাতেও উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, চসিকের সেবামূলক কার্যক্রম চলমান রাখতে সরকারের কাছে বরাদ্দ চেয়েছি। ইতোমধ্যে কিছু থোক বরাদ্দ পেলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। সরকারি সেবাসংস্থা বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা তাদের ভারী যানবাহন ও কন্টেইনারগুলো চসিকের রাস্তাগুলো ব্যবহার করে। এ রাস্তাগুলোর উপর ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি মালামাল পরিবহনের কারণেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এ সড়কগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বন্দরের মোট আয় থেকে শতকরা ১ অংশ সার্ভিস চার্জ চেয়েছি। কাস্টমস কর্তৃপক্ষের ল্যান্ডিং অবস্থান এ নগরীতে। এ কারণে তাদের কাছ থেকেও সার্ভিস চার্জ চসিক পেতে পারে। ইপিজেডের হোল্ডিং ট্যাঙ না দিলেও সার্ভিস চার্জ অবশ্যই দেয়া দরকার।
পরামর্শক কমিটির সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবাই প্রশাসকের এই প্রস্তাবকে যৌক্তিক হিসেবে আখ্যায়িত করে সিটি করপোরেশনের আর্থিক দৈন্য ঘোচাতে নানামুখি পদক্ষেপ গ্রহণেরও প্রস্তাব করেছেন। পরামর্শকদের মধ্যে কেউ কেউ শুধু সিটি করপোরেশনের সমস্যাই নয়, চট্টগ্রামের সমস্ত বঞ্চনা ও অবহেলার চিত্র রাজধানী ঢাকায় যথাস্থানে তুলে ধরার ওপর জোর দিয়ে প্রয়োজনে সরকারের কাছে লবিং করারও পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে আমি মনে করি বন্দর ও কাস্টম থেকে অন্তত এক পার্সেন্ট সার্ভিজ চার্জ আদায়ের যে প্রস্তাব সুজন দিয়েছেন তা অত্যন্ত যৌক্তিক ও বাস্তবায়নযোগ্য। সিটি কর্পোরেশন যে সমস্ত সড়ক নির্মাণ করে তার একটি নির্দিষ্ট ধারণ ক্ষমতা থাকে। এই সড়কে যখন বন্দরসংশ্লিষ্ট ভারী যানবাহন চলাচল করে তখন সে সড়ক দ্রুত ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ে ফলে সে সমস্ত সড়ক ঘন ঘন মেরামতের প্রয়োজন হয়। খোরশেদ আলম সুজন শুধু বন্দর নয় স্টিল মিল মালিকদেরও একই ধরনের প্রস্তাব দিয়েছেন। কাজেই এইসব প্রতিষ্ঠান প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিতে পারে। মোটকথা শুধু থোক বরাদ্দ দিয়ে ৬০ লাখ অধিবাসীর এই সিটি করপোরেশন চলতে পারে না। তাছাড়া চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের অধীনে বহু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয়ে থাকে। এটি চট্টগ্রামের ঐতিহ্য। এর পিছনেও বছরে প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে হয় সিটি করপোরেশনকে। অর্থাভাবে এই দুটি সেবাখাত যেন বন্ধ হয়ে না যায় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে।
অতীতে আমরা দেখেছি, সঠিক উন্নয়ন পরিকল্পনা পেলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তা ফিরিয়ে দেননি। তিনি যথার্থ মূল্যায়ন করেছেন। ফলে আমাদের উদ্যোগ নিতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সঠিক চিত্র ও সমস্যার কথা তুলে ধরা। পরামর্শক কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সাবেক মুখ্যসচিব, ব্র্যাকের সিনিয়র অ্যাডভাইজার মো. আবদুল করিমও তেমন কথাই বলেছেন। তিনি বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ উধ্বর্তন পদে চট্টগ্রামের সন্তানরা দায়িত্ব পালন করছেন। অনেক সাবেক কর্মকর্তাও দায়িত্ব পালন করেছেন। সবাইকে নিয়ে ঢাকায় একটি সভা করা দরকার। এখান থেকে চট্টগ্রামের স্বার্থে অনেক সিদ্ধান্ত আসতে পারে।
চট্টগ্রামের সমস্যা অন্তহীন। তা চট্টগ্রামের মানুষ মাত্রই অনুভব করেন । তাছাড়া এই ছোট পরিসরে তা তুলে ধরার অবকাশও নেই। সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সিটি করপোরেশন ছাড়াও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামে আরও একটি প্রতিষ্ঠান আছে । একটি পরিকল্পিত ও আধুনিক নগর গড়ে তোলার লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রতিষ্ঠানটির আমলনামায় সফলতার চেয়ে ব্যর্থতার পাল্লাই ভারী বেশি। অনেক সময় দুটি সংস্থার কাজের এখতিয়ার নিয়েও দ্বন্দ্ব তৈরি হতে দেখা গেছে অতীতে। আসলে গলদটি রয়ে গেছে গোড়ায়। সভায় অন্যতম পরামর্শক চসিক সাবেক মেয়র মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখানে নগর সরকারের কথা উঠেছে। ১৯৮২ সালের সিটি করপোরেশন অর্গানোগ্রাম বাস্তবায়ন না হলে নগর সরকার বাস্তবায়ন হবে না। সবশেষে বলতে চাই, নগর সরকার বা অর্গানোগ্রামের বাস্তবায়ন যাই বলি না কেন পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ না পেলে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সন্তোষজনক কাজ করা সম্ভব নয়।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধআন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধী দিবস: করোনা পরিস্থিতিতে করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম