মোখা, চট্টগ্রামবাসীর বঞ্চনা ও
কাণ্ডজ্ঞানহীন মানুষের কথা
অনেক আশঙ্কার জন্ম দিয়ে শেষ পর্যন্ত ঘূর্ণিঝড় মোখা বাংলাদেশ ছেড়ে গেছে। ঝড়ের একটি অংশমাত্র দেশের ওপর দিয়ে গেল। মূল ঝড়টি গেছে মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যদিও অতিঝড় মোখা স্থলভাগে আসতে আসতে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। মানুষ সাধারণত প্রতিবেশীর চেয়ে ভাগে কম পেলে মন খারাপ করে। এবার হয়েছে তার ব্যতিক্রম। ঘূর্ণিঝড় মোখার মূল অংশটি মিয়ানমারের ওপর দিয়ে যাবে শুনে বাংলাদেশিরা খুশি হয়েছে। অনেককে বলতে শুনেছি, যাক, গেলে ওদের ওপর দিয়ে যাক। অনেক জ্বালাচ্ছে ব্যাটারা!
প্রথমদিকে প্রচুর আশঙ্কা তৈরি করলেও শেষ পর্যন্ত কোনো প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। ধারণা করা হচ্ছে সবমিলিয়ে ঝড়ের শিকার প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকতে পারে। ঘূর্ণিঝড় মোখা যেখানে সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে, মিয়ানমারের সেই রাখাইন রাজ্যের অনেক এলাকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সিতওয়ে শহরে বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অসমর্থিত সূত্রে জানা গেছে সেখানে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে রোল মডেল। অন্তত গত ২০ বছরের মধ্যে সংঘটিত বন্যা–সাইক্লোনের মতো দুর্যোগ মোকাবিলায় বাংলাদেশ অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছে। যে কারণে এখন জান–মালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে গেছে। এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত সমন্বয় সাধন করে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের কষ্ট লাঘবে কাজ করেছে। এর পাশাপাশি মিয়ানমারের পরিস্থিতিটা সামান্য তুলে ধরি। মিয়ানমারে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি রামানাথন বালাকৃষ্ণ রয়টার্সকে বলেছেন, রাখাইনে আগে থেকেই মানবেতর অবস্থা বিরাজ করছিল, সেখানে ঘূর্ণিঝড়ের আঘাত দুঃস্বপ্নের মতো পরিস্থিতি তৈরি করেছে। তিনি বলেন, দুর্যোগময় পরিস্থিতির কারণে হাজার হাজার মানুষের খাপ খাওয়ানোর ক্ষমতা আগেই শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারাই আবার ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষতিতে পড়েছে।‘
এসব নতুন তথ্য নয়। ইতিমধ্যে পাঠকরা পত্রিকা, টিভি ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে এরচেয়েও বেশি অবগত হয়েছেন। আমার উদ্দেশ্যও নতুন করে এসব জানানো নয়। আমি আলোকপাত করতে চাই দুটো বিষয়ে। প্রথমটির আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত মানুষের দুর্গতি নিয়ে কিছু রিপোর্ট তুলে ধরতে চাই।
‘ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীতে সাগরে ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল বন্ধ রাখায় চট্টগ্রামের কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। গত শুক্রবার রাত থেকে গ্যাস সংকট শুরু হলেও রোববার সকাল থেকে পুরো নগরীতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকে। এর ফলে খাবারের খোঁজে হোটেলে ছুটছে মানুষ। কিন্তু লাইনের গ্যাসনির্ভর হোটেলগুলোতে রান্না না হওয়ায় সিলিন্ডার দিয়ে যে ক‘টি হোটেলে রান্না হয়েছে সেখানে মানুষের প্রচণ্ড ভিড় জমে যায়। লালদীঘির পাড়ে একটি হোটেলের সামনে ক্রেতার দীর্ঘ লাইন আধা কিলোমিটার পর্যন্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকে। ফেসবুকে অনেকে সে ছবি আপলোডও করেছেন।
সিএনজি ফিলিং স্টেশনগুলোতে গ্যাস সরবরাহ না থাকায় বন্ধ হয়ে গেছে সিএনজি চালিত গণপরিবহন। এতে সকাল থেকে দুর্ভোগে পড়ে অফিসগামী নারী–পুরুষ। ডিজেল চালিত পরিবহনগুলো চললেও তা যাত্রীর তুলনায় খুবই কম। গণপরিবহন না পেয়ে সকাল থেকে রিক্সা কিংবা পায়ে হেঁটে ছুটছ্েন অফিসগামী নারী–পুরুষ। ডিজেল চালিত পরিবহন চলাচল করলেও স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
গ্যাসের এই সংকট কেন তা বলতে গিয়ে রবিবার সচিবালয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সাংবাদিকদের বলেন, ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে মহেশখালীতে ভাসমান দুটি টার্মিনাল থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) সরবরাহ তিন দিন ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে পাইপলাইনে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন, রান্নার চুলা, শিল্পকারখানায় সংকট দেখা দিয়েছে। গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে আরও দুই সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। আর আগামী দুই দিনের মধ্যে লোডশেডিং পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
একই মন্ত্রী ঘূর্ণিঝড়ের আগে বলেছিলেন, ঝড় কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে। পরে বলছেন, ‘গভীর সমুদ্রে থাকা এলএনজি টার্মিনাল দুটি সরিয়ে নেয়া হয়েছিল। এরমধ্যে একটি দুই দিনের মধ্যেই চালু হবে। পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অন্যটি চালু করতে সময় লাগবে। এ কারণেই গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে সময় লাগবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা এফএসআরইউ (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট) চলে গেছিল, পাইপ খুলে দিয়ে। আর যেটা রয়েছে সেটা দিয়ে আমরা দুই–তিনদিনের মধ্যেই গ্যাস সরবরাহ চালু করতে পারব। যেটা খুলে চলে গেছে সেটা রিকভারি করতে আমাদের ১০–১২ দিন সময় লাগবে। বিদেশ থেকে ডুবুরি আসবে। তারা আসার পর এটির কানেকশন দেবে। ৪০০ এমএমসিএফডি গ্যাসের একটা শর্টেজ থাকবে। তবে এখনকার থেকে পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে।’
সরকার বিদেশ থেকে এলএনজি আমদানি করে মহেশখালীর ভাসমান টার্মিনালের মাধ্যমে তা সরবরাহ করে। সমুদ্রে ভাসমান দুটি টার্মিনালের একটি পরিচালনা করে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। আরেকটি পরিচালনা করে সামিট গ্রুপ। ঘূর্ণিঝড় মোখার কারণে গত শুক্রবার রাত ১১টায় ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করা হয়। এরপর এক্সিলারেট তাদের টার্মিনালটি গভীর সমুদ্রে সরিয়ে নেয়। এটি ফিরতে শুরু করেছে। আবার চালু করতে দুই সপ্তাহ লাগতে পারে।
দেশে গ্যাসের যে চাহিদা তা দেশীয় উৎপাদনের মাধ্যমে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। ফলে এলএনজি আমদানি করতে হচ্ছে যদিও তা দিয়ে চাহিদা পূর্ণ হচ্ছে না। বর্তমান যে সরবরাহ তার ত্রিশ শতাংশ আসে এলএনজি গ্যাস থেকে। এই গ্যাস চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হলেও তাতে চট্টগ্রামবাসীর কোনো ফায়দা নেই। এই গ্যাসের সামান্য অংশও চট্টগ্রামে ব্যবহারের সুযোগ নেই। এই গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। প্রশ্ন হলো এই ত্রিশভাগ গ্যাস তো চট্টগ্রামবাসীর জন্য খরচ হতো না তাহলে তা বন্ধ হলে তার খেশারত শুধু চট্টগ্রামবাসী দেবে কেন? জাতীয় গ্রিডে থাকা চট্টগ্রামবাসীর অংশটুকু গেল কোথায়? গ্যাসের তীব্র সঙ্কট তিনদিনের বেশি থাকেনি। কিন্তু মন্ত্রী ও কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানির বিজ্ঞপ্তির প্রকাশের ফলে জনমনে আতঙ্ক তৈরি হয়। যে যেভাবে পারে সিলিন্ডার ও চুলা কিনতে থাকে। সুযোগ বুঝে ব্যবসায়ীরা প্রত্যেকটি চুলা ও সিলিন্ডারের দাম বাড়িয়ে দেয় কয়েকগুণ। একসময় রমজান এলে মৌসুমি পাঞ্জাবি বিক্রেতা দেখা যেত মার্কেট থেকে অলিগলিতে বা কোরবানির সময় মৌসুমী চামড়া ব্যবসায়ীদের দেখা মিলতো। এবারও তেমনিভাবে মৌসুমী সিলিন্ডার ও চুলা বিক্রেতার দেখা মিলল বিভিন্ন স্থানে। এই ফাঁকে মানুষের পকেট থেকে অন্তত কোটি টাকা খসিয়ে নিলো চতুর ব্যবসায়ীরা।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে এমন অবস্থা হতেই পারে। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতেও প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির সঙ্কট দেখা দিতেই পারে। তবে তার জন্য কর্তৃপক্ষ আগাম ঘোষণা দিয়ে রাখে, পরিস্থিতির ব্যাখ্যাও দেয়। বাংলাদেশে কয়েকদিন গ্যাস থাকবে না বলে যে ‘প্যানিক‘ সৃষ্টি করা হয়েছিল তাতে ফায়দা লুটে নিল কিছু অসৎ ব্যবসায়ী। অবশ্য সেজন্য অতি সাবধানি লোকরাও কম দায়ী নয়। লাইনে গ্যাস না পেয়ে কিছু মানুষ পঙ্গপালের মতো ঝাপিয়ে পড়েছে দোকানে, কেরোসিনের স্টোভ থেকে চুলা–সিলিন্ডার, ভাত–তরকারি থেকে রুটি–পাউরুটি কিনে বাসায় স্তূপ করেছে। কেউ একবারও ভাবলো না তার অযথা বেশি কেনার কারণে অনেকে তার প্রয়োজনেরটুকুও কিনতে পারেনি। যুদ্ধ বা যেকোনো জরুরি পরিস্থিতি পড়লে মানুষকে অনেককিছু মেনে নিতে হয়। কিন্তু আমাদের মধ্যে অনেকে আছেন যারা একচুলও ছাড় দিতে রাজি নন। যখন উপকূলের লাখ লাখ মানুষ চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছে, শিশু, নারী, বয়স্ক ও অসুস্থসহ কয়েকলাখ মানুষ সাইক্লোন সেল্টারে এসে কোনোভাবে বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে তখন নিরাপদ জীবনের কিছু ‘সুখী মানুষ‘ কয়েকপদের খাবার খেতে না পেরে চরম অসন্তুষ্টি প্রকাশ করছে।
মানুষের আরেকটি প্রবণতার কথা বলি। সাইক্লোন শুরু হয়ে গেছে তখনও দেখা যাচ্ছে দলে দলে মানুষ সমুদ্রপাড়ে জড়ো হয়ে আছে। বন্ধু–বান্ধব, পরিবার–পরিজন নিয়ে ‘মোখা‘ দেখতে গেছে। কেউ সেলফি তুলছে, কেউ ভিডিও করছে, কেউ সেখান থেকে ‘লাইভ‘ দিচ্ছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব তাদের মধ্যে। এই পরিস্থিতি অবলোকন করে খোদ প্রধানমন্ত্রী ত্রাণ প্রতিমন্ত্রীকে ফোন করে এই তামাশা বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেয়ে সৈকত থেকে অবাঞ্ছিত মানুষদের সরিয়ে দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
মাঝেমধ্যে মানুষের এমন অদ্ভুত আচরণে বিস্মিত হই। কী ‘স্যাডিস্ট‘ আচরণ। একদিকে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুঝুঁকিতে অন্যদিকে তারই মাঝে মানুষ এক আজব বিনোদন খুঁজে পাচ্ছে। এদেশে কোথাও আগুন লাগলেও মানুষ একই আচরণ করে। সহযোগিতা না করে ভিডিও লাইভ করে, সেল্ফি তোলে। আর কেউ কেউ সে সময় চুরিও করে।
এক অদ্ভুত আমাদের মানসিকতা! আমি এর কোনো ব্যাখ্যাও খুঁজে পাই না।
মোখা আসলো, চলেও গেল তবে শিক্ষা দিয়ে গেল যে, আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থা কতটা ভঙুর এবং বৈষম্যমূলক। সময়মতো আমদানি করতে না পারার কারণে হোক বা এধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে হোক বিকল্প কোনো একটি ব্যবস্থা সরকারকে করে রাখতে হবে আর সে সঙ্গে চট্টগ্রামবাসীর প্রাপ্যতাটুকুও নিশ্চিত করতে হবে।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক