ধর্মান্ধতার শেষ এবং মানুষের নয়া পৃথিবী
অনেকের মনে থাকার কথা গত বছর ভারতের স্বাধীনতার প্লাটিনাম জুবিলি উদ্যাপনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) প্রধান মোহন ভাগবত ‘অখণ্ড ভারত’ গঠনের যে লক্ষ্যমাত্রা আবার তুলে ধরেছিলেন তার কথা। তাদের সে লক্ষ্য পূরণ হলে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা তো লোপ পাবেই সে সঙ্গে সার্বভৌমত্ব হারাবে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও শ্রীলঙ্কাও। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষে গত বছরের অগাস্টে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এই ‘লক্ষ্য’ পূরণ প্রসঙ্গে মোহন ভাগবত বলেছিলেন ‘অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্নপূরণের পথে ভয়ই একমাত্র বাধা। যেদিন এই ভয় কাটানো যাবে, সেদিনই অখণ্ড ভারত গড়া সম্ভব হবে।’
তার কথিত সেই অখণ্ড ভারত হবে মূলত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’। তার চরিত্র ও সংবিধান কেমন হবে, সেই খসড়াও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসের দুই দিন আগে বারানসিতে খসড়া সংবিধান প্রকাশ করেন শঙ্করাচার্য পরিষদের পীঠাধ্যক্ষ ও সভাপতি স্বামী আনন্দ স্বরূপ। এ সময় তিনি বলেন, অখণ্ড ভারতে বসবাসকারী মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের ভোটাধিকার থাকবে না। ভোটদানের অধিকার ছাড়া এই দুই সমপ্রদায়ের সবাই অন্যদের মতো সব নাগরিক সুযোগ–সুবিধা ও অধিকার ভোগ করতে পারবেন। অখণ্ড ভারতের রাজধানী হবে বারানসি। নতুন ধর্মসংসদও গড়ে তোলা হবে সেখানে।
তাদের সেই অখণ্ড ভারতের সংবিধানের খসড়া তৈরি করছেন ভারতের ৩০ জন ধর্মগুরু ও পণ্ডিত। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে প্রয়াগরাজের (আগের নাম এলাহাবাদ) ধর্ম সংসদে এই খসড়া প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। তাদের ঘোষণা অনুযায়ী এই বছর প্রয়াগরাজে মাঘী (মাঘ মাসের) পূর্ণিমা মেলায় এই খসড়া সংবিধান চূড়ান্তভাবে অনুমোদিত হবে বলে আনন্দ স্বরূপ জানালেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি।। তিনি জানিয়েছিলেন, ‘অখণ্ড ভারতের প্রত্যেককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ নিতে হবে। কৃষিক্ষেত্র থাকবে আয়করমুক্ত।‘
সে খসড়া সংবিধানের প্রচ্ছদে অখণ্ড ভারতের যে মানচিত্র ছাপা হয়েছে, তাতে পশ্চিমে আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, পূর্বে মিয়ানমার ও বাংলাদেশ এবং দক্ষিণে শ্রীলঙ্কার কোনো অস্তিত্বই রাখা হয়নি। দেখা যাচ্ছে দেশগুলো ভারতের অন্তর্গত। তাদের প্রস্তাবিত পতাকার রং গৈরিক। যদিও তা অখণ্ড ভারতের জাতীয় পতাকা হবে কি না, তা স্পষ্ট করা হয়নি। আনন্দ স্বরূপ জানান, ‘ভারতবর্ষ থেকে যেসব দেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের সবাইকে নিয়েই গঠিত হবে অখণ্ড ভারত, যা হবে হিন্দু রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে ১৬ বছর বয়সীদের ভোটাধিকার থাকবে। ভোটে প্রতিদ্বন্দ্বিতার বয়স হবে ২৫। বর্ণপ্রথা অনুযায়ী দেশ শাসিত হবে। ব্রিটিশ আমলের কোনো আইনের অস্তিত্ব থাকবে না। শিক্ষাব্যবস্থায় আনা হবে জ্যোতিষচর্চা, গণিত, আয়ুর্বেদ। চর্চা হবে ভূগর্ভ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানেরও।‘
এই লক্ষ্য পূরণের সময়ও চূড়ান্ত করেছেন তারা। ২০৪৭ সালে, স্বাধীনতার শত বর্ষে এই লক্ষ্যে পৌঁছাতে চায় তারা। বিজেপির চালিকা শক্তি আরএসএস প্রধান বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতায় বারংবার বলেন, ‘একমাত্র বাধা হলো ভয়। ভয় কাটলেই লক্ষ্য পূরণ সম্ভব। নিজেই নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন, যে দেশ এত বিশাল ছিল, তা কী করে এত কমে গেল? সংস্কৃত ব্যাকরণবিদের (পাণিনি) জন্মস্থান কেন ভারতের অন্তর্গত নয়? ভারতের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। সিন্ধুুসরস্বতী সভ্যতার বয়স ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের মতে সাড়ে তিন হাজার বছর। কিন্তু সেই সভ্যতার প্রকৃত বয়স ৯ হাজার বছর। সেই সভ্যতা ছিল সর্বগামী। তার ব্যাপ্তি ছিল সর্বত্র।’
গত বছরের ১৪ এপ্রিল হরিদ্বারে হিন্দুত্ববাদীদের এক সম্মেলনেও অখণ্ড ভারত গড়ার প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, ‘দেশের জন্য এক হয়ে আমরা সবাই যদি বাঁচতে ও মরতে শিখি, তা হলে অতিদ্রুত এই লক্ষ্য পূর্ণ হবে। এখন যে গতিতে চলছি, তাতে আর একটু গতি সঞ্চারিত হলে ২০–২৫ বছরের মধ্যে স্বপ্ন সফল হবে। আরও একটু বাড়তি গতিতে চললে অর্ধেক সময় কমে যাবে।’ ( সূত্র : প্রথম আলো, ১৫ অগাস্ট, ২০২২)
এইটুকু পড়ে যে সকল মুসলিম ভাইয়েরা মন খারাপ করেছেন তাদের জন্যও সুসংবাদ আছে। এবার নিচের অংশটি পড়ুন। ইন্টারনেট ও ধর্মীয় সাইট থেকে প্রাপ্ত তথ্য কোনোরূপ সম্পাদনা না করে তুলে দিচ্ছি।
‘ধেয়ে আসছে গাজওয়াতুল হিন্দ!’
পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় যে ধর্মযুদ্ধ হবে সেটাই হল “গাজওয়ায়ে হিন্দ” তথা হিন্দুস্থান ভারতের বিরুদ্ধে মুসলমান উম্মাহদের যুদ্ধ। এই সম্মানিত যুদ্ধে নিশ্চিত মুসলমান উম্মাহরা বিজয় লাভ করবেন। সুবহানআল্লাহ! কিন্তু এই সম্মানিত যুদ্ধে এক তৃতীয়াংশ মুসলমান শাহাদাত বরণ করবেন এবং শেষাংশ যুদ্ধ শেষ করে বিজয় লাভ করবেন। সুবহানআল্লাহ! যারা এই সম্মানিত যুদ্ধে শাহাদাত বরণ করবেন উনারা নিশ্চিত জান্নাতবাসী হবেন। সুবহানআল্লাহ! এবং যেসব মুসলমানগণ এই সম্মানিত যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে গাজী হয়ে ফিরবেন উনারা ঈমান নিয়ে মৃত্যুবরণ করে জান্নাতবাসী হবেন। সুবহানআল্লাহ! আবার এই সম্মানিত যুদ্ধ থেকে যেসব নামধারী মুসলমানরা পালিয়ে যাবে তারা বেঈমান হয়ে মৃত্যুবরণ করবে। নাউজুবিল্লাহ!
পবিত্র হাদিস শরীফে গাজওয়াতুল হিন্দ সম্পর্কে বলা হয়েছে, এটা হবে কাফির মুশরিকদের সাথে মুসলমানদের পৃথিবীর ভিতর বৃহত্তম জিহাদ/যুদ্ধ। এই যুদ্ধে হিন্দুস্তানের মোট মুসলিমদের এক তৃতীয়াংশই শহীদ হবে, আরেক অংশ পালিয়ে যাবে আর শেষ অংশ জিহাদ চালিয়ে যাবে। মুসলমানদের নিশ্চিত জয় হবে কিন্তু এটা এতোটাই ভয়াবহ যে হয়তো অল্প কিছু সংখ্যক মুসলিমই বেঁচে থাকবেন বিজয়ের খোশ আমদেদ করার জন্য।
অন্য বর্ণনায় আছে,
গাজওয়াতুল হিন্দ হিন্দুস্তানের (চূড়ান্ত) যুদ্ধ। রাসুল (সা.) একদিন পূর্ব দিকে তাকিয়ে বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছিলেন, এমন সময় এক সাহাবি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) আপনি এমন করছেন কেন!’
রাসুল (সা.) বললেন, ‘আমি পূর্ব দিকে বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছি।’ সাহাবায়ে কেরাম রাদিআল্লাহু তাআ‘লা আনহুম উনারা জিজ্ঞেস করলেন ইয়া রাসুলুল্লাহ(সা.) আপনি কিসের বিজয়ের গন্ধ পাচ্ছেন? রাসুল (সা.) বললেন, পূর্ব দিকে মুসলিম ও মুশরিকদের (যারা মূর্তিপূজা করেন) সাথে যুদ্ধ শুরু হবে। যুদ্ধটা হবে অসম। মুসলিম সেনাবাহিনী থাকবে সংখ্যায় সীমিত, কিন্তু মুশরিক সেনাবিহিনী থাকবে সংখ্যায় অধিক।
ঐ যুদ্ধে মুসলিমরা এত বেশি মারা যাবে যে রক্তে মুসলিমদের পায়ের টাকুনি পর্যন্ত ডুবে যাবে। ঐ যুদ্ধে মুসলিমরা তিন ভাগে বিভক্ত থাকবে; এক ভাগ বিশাল মুশরিক বাহিনি দেখে ভয়ে পালিয়ে যাবে, তারাই হলো জাহান্নামী! আর এক ভাগ সবাই যুদ্ধে শহীদ হবেন। শেষ ভাগ আল্লাহর ওপর ভরসা করে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে এবং শেষ পর্যন্ত জয় লাভ করবেন। রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, এই যুদ্ধ বদর যুদ্ধের সমতুল্য! (সুবহানাল্লাহ)। তিনি আরো বলেছেন, ঐ সময় মুসলিমরা যে যেখানেই থাকুক না কেন তারা যেন সেই যুদ্ধে শরিক হন। [তাদের দেওয়া তথ্যসূত্র : নাসায়ী খণ্ড ০১,পৃষ্ঠা ১৫২; সুনানে আবু দাউদ খণ্ড ০৬,পৃষ্ঠা ৪২]
হিন্দু–মুসলিমের বাইরে এই উপমহাদেশে আরও কয়েক কোটি মানুষ বাস করে। তো এই রোমহষর্ক কাটাকাটি শেষে তাদের অবস্থা কী হবে? তারা কোথায় বা কোনদিকে যাবে? তাদের জন্য তো একটা আবাসস্থল দরকার যেখানে যেকোনো ধর্মের, যেকোনো বর্ণের, যেকোনো মতের মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করবে। তাদের মতো বাস করার অধিকারও কি তাদের নেই? একটা কথা মনে রাখতে হবে, অধিকার কেউ কাউকে দেয় না, আদায় করে নিতে হয়। মানুষকেও তা আদায় করে নিতে হবে, নিজেদের পৃথিবী নিজেদেরই গড়তে হবে। লেখক : কবি–সাংবাদিক