তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ?
সরকারি নথি ‘চুরির চেষ্টার’ অভিযোগে‘অফিসিয়াল সিক্রেটস’ আইনের মামলায় গ্রেপ্তার রোজিনা ইসলামকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে নিতে পুলিশের আবেদন নাকচ করে দিয়েছে আদালত। রোজিনা ইসলামের আইনজীবীরা জামিনের আবেদন করলে আংশিক শুনানি শেষে বিচারক বাকি শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার তারিখ রেখেছেন। তার আগ পর্যন্ত কারাগারে থাকতে হবে এই সাংবাদিককে।
মঙ্গলবার সকালে রোজিনাকে ঢাকার মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করার পর শুনানি শেষে বিচারক মোহাম্মদ জসীম এই আদেশ দেন। সরকারি নথি ‘চুরির চেষ্টার’ অভিযোগে সোমবার সচিবালয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের এক কর্মকর্তার কক্ষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা আটকে রাখা হয়। পরে রাতে তাকে শাহবাগ থানায় সোপর্দ করা হয়, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দণ্ডবিধির কয়েকটি ধারায় তার বিরুদ্ধে মামলা করেন স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব শিব্বির আহমেদ যেখানে ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় চুরি এবং ১৯২৩ সালের ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের’ ৩ ও ৫ ধারায় গুপ্তচরবৃত্তি ও রাষ্ট্রীয় গোপন নথি নিজের দখলে রাখার অভিযোগ এনেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এসব ধারায় সর্বোচ্চ তিন বছর সাজার বিধান আছে।
‘সরকারি নথি চুরির অভিযোগে গ্রেফতার এই রোজিনা কে? তিনি কেন সচিবালয়ে সরকারি নথি ‘চুরি’ করতে গিয়েছিলেন? তিনি সচিবালয়ে ঢুকলেন কী করে? নথির হদিস-ইবা পেলে কী করে?
আগে এ বিষয়টি আলোচনা করা দরকার কারণ রোজিনার সঙ্গে যেরূপ আচরণ করা হয়েছে তাতে যে কারোরই মনে হতে পারে রোজিনা একজন দুর্ধর্ষ চোর যিনি সচিবালয়ের মতো একটি অতি নিরাাপদ স্থান থেকেও চুরি করতে পারেন। যারা সাংবাদিকতায় আছেন তারা তো চেনেনই আর যারা নিয়মিত সংবাদপত্র পড়েন কিংবা দেশের নানা বিষয়ে খোঁজ-খবর রাখেন তাদের কাছে রোজিনা ইসলাম নামটি অপরিচিত নয়। গত দু‘বছর ধরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নানা দুর্নীতি নিয়ে চাঞ্চল্যকর রিপোর্ট করে আলোচিত হয়েছেন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক এই রোজিনা ইসলাম ।
রোজিনা যে কাজটি করেছেন তা সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে কোনো অপরাধ নয়। ওয়াটার গেট কেলেঙ্কারির রিপোর্ট থেকে শুরু করে সারাবিশ্বের চাঞ্চল্যকর সব রিপোর্ট এমনভাবে তথ্য সংগ্রহ করে করা হয়েছে, ভবিষ্যতেও তাই হবে। তারপরও
রোজিনা ইসলাম ওই অফিস থেকে কোনো নথি সরানোর অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রোজিনা বলেন, “সচিবের সাথে দেখা করতে আমি তার একান্ত সচিব সাইফুলের কক্ষে আসি। এরপর হঠাৎ করে পুলিশ ডেকে এনে আমাকে এই কক্ষে আটক করা হয়।”
আটকের পর দেহ তল্লাশি করা হয়েছে জানিয়ে এই সাংবাদিক বলেন, “মিজান নামে এক পুলিশ সদস্য আমাকে নাজেহাল করেছে। এ দপ্তর থেকে কোনো ধরনের নথি আমি নিইনি।” তাহলে তার ওপর এতটা চড়াও হলেন কেন সচিবালয়ের বড় কর্তারা? তার সহকর্মীরা বলেছেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবেদন করায় তিনি ‘আক্রোশের শিকার’ হয়ে থাকতে পারেন। ‘আক্রোশ’টা খুবই ভয়াবহ। সোমবার রাতে রোজিনাকে থানা হাজতে রেখে মঙ্গলবার সকালে তাকে আদালতে হাজির করে শাহবাগ থানা পুলিশ। এই সাংবাদিককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পাঁচ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহবাগ থানার পরিদর্শক আরিফুর রহমান সর্দার।
একজন সাংবাদিকের কাজ কী তবে? মন্ত্রী-এমপিরা যা বলবেন তাই খবরের কাগজে ছাপানো বা টিভিতে দেখানো? দেশে কোথাও কোনো অনিয়ম হলে, দুর্নীতি হলে চোখ-মুখ বন্ধ করে রাখা? তাহলে সংবাদমাধ্যমের ভাষায় ‘ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্ট বা ‘অনুসন্ধানী প্রতিবেদন’ কীভাবে তৈরি হবে? অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাঁচাতে যে বক্তব্য প্রদান করবেন বরাবর তাই পাঠকদের সামনে তুলে ধরবেন? তাহলে তো সরকারি প্রেসনোটই যথেষ্ট; খামাখা এত এত পত্রিকা, টিভি কিসের জন্য? রোজিনা একজন পেশাদার সাংবাদিক। অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে তিনি ইতিমধ্যে দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছেন, অনেক সম্মাননাও অর্জন করেছেন। তেমন একজন সাহসী সাংবাদিকের প্রতি এতটা কঠিন আচরণ কেন? তাকে রিমান্ডের আবেদন কেন? একইদিন রিমান্ড ও জামিনের আবেদন করা যাবে না ভেবেই কি পরিকল্পিতভাবে তার রিমান্ডের আবেদন করা হয়েছিল। তিনি কি ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী? আদালত রিমান্ড আবেদন নাকচ করে দিলে তাকে কারাগারে নিয়ে যায় পুলিশ। বৃহস্পতিবার তার জামিন শুনানির তারিখ রেখেছে আদালত।
রোজিনার আইনজীবী শুনানিতে বলেন, “পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে সাংবাদিকের ওপর এ ধরনের দুঃখজনক আচরণ করা হয়েছে। মামলায় যা বলা হয়েছে তার আদৌ কোনো যৌক্তিকতা নেই। এ সংবাদগুলো টপ সিক্রেট নয়, বরং ওপেন সিক্রেট। কিন্তু তাকে গ্রেপ্তারের নামে মেন্টালি ও ফিজিক্যালি অ্যাবিউজ করা হয়েছে।” বিচারক এ সময় বলেন- “এখানে রিমান্ড বাতিল করা ও জামিন একই দিনে দেওয়ার রেওয়াজ আমাদের নেই। আপনারা সামনের দিনে জামিন চান। ভার্চুয়াল কোর্ট হবে, ওই বিচারক দেখবেন বিষয়টি।” পরে বিচারক আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে বৃহস্পতিবার জামিন শুনানির দিন ঠিক করেন বলে সংবাদসূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সাংবাদিকদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সংবাদ সম্মেলন ‘বয়কট’ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সচিবালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম (বিএসআরএফ)।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি কোনো গোপন বিষয় নয়। এর আগে এক গাড়িচালকদের কাহিনি শুনে আক্কেলগুড়ুম হয়েছিল আমাদের। মামলাটি দুদকে বিচারাধীন। তখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছিলেন এক গাড়িচালকদের এই অবস্থা হলে বড়বাবুুদের কী অবস্থা হবে?
রোজিনা শারীরিকভাবে খুব একটা সুস্থ নন। তার স্বামী মিঠু বলেন সাংবাদিকদের বলেছেন, “রোজিনার ছয়টা অসুখ, ১৪টা ওষুধ খায়। এখন ওর শরীরের অবস্থা ভালো না। কিন্তু ওরা যেখানে নিতে চাচ্ছে, ঢাকা মেডিকেলে। আমি ঢাকা মেডিকেলের বিষয়ে অবজেকশন দিয়েছি, কারণ ওখানে করোনা। নেবে জরুরি বিভাগে। ওখানে যারা রোগী যায়, পজিটিভরা ভর্তি হয়, আর যারা কাটাছেঁড়া বা হালকা উপসর্গ নিয়ে আসে, তারা জরুরি বিভাগে যায়। আগের শারীরিক অসুস্থতার মধ্যে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোজিনার অবস্থা ‘বাজে হয়ে যাবে’
সরকার একদিকে অবাধ তথ্যপ্রবাহের কথা বলছে, সমাজ বা রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত করার কথা বলছে অন্যদিকে সাংবাদিকদের পেশাদারিত্বকে ঝুঁকির মুখে ফেলে দেবে তা কী করে হয়। অন্যায়কে অন্যায় বলার উপায়কে রুদ্ধ করা হলে সমাজ ও রাষ্ট্রে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে যা থেকে ক্ষমতাসীনরাও রেহাই পাবেন না। একটি কথা ভুলে গেলে চলবে না, কোনো মন্ত্রণালয় বা সরকারি কোনো ব্যক্তির দুর্নীতি নিয়ে কথা বলার অর্থ সরকারের বিরোধিতা করা নয় বরং তা সরকারকে সহায়তা করা, সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সহযোগিতা করা। যারা আজ রোজিনাকে হেনস্থা করেছে তারা আগে নিজেদের সঠিক পথে আনুক, তাদের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করুক।
লেখক : কবি-সাংবাদিক