সেদিন যদি তারা সফল হতেন!
আমরা যে যত কথাই বলি না কেন, যত শক্তির কথাই ধরি না কেন দিন শেষে একটি কথা মানতেই হবে, বাংলাদেশের রাজনীতি মূলত দুই ধারায় বিভক্ত। একটি ’৫২ এর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় একটি অসামপ্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, শোষণহীন সমাজ ব্যবস্থার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে অন্যটি আধা সামরিক, পুরো পাকিস্তানি ভাবধারায় সামপ্রদায়িক ও লুটেরা শ্রেণীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে। প্রথমটির নেতৃত্বে আছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ অন্যটির নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। অনেকে, বিশেষ করে বাম ঘরানার রাজনীতিকরা প্রায়শঃ বলে থাকেন আওয়ামী লীগ-বিএনপি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
বিশদ আলোচনার আগে বিশ্ব বিখ্যাত আরব কবি কাহলিন জিবরানের একটি গল্প বলি। ছোট ছোট কয়েকটি বাচ্চা নিয়ে উপত্যকায় খাদ্য অন্বেষণ করছিল একটি মেষ। এমন সময় একটি বাজপাখি মেষ শাবককে আক্রমণ করতে উদ্যত হলে আরেকটি বাজপাখি এসে বাধা দেয়, ফলে যুদ্ধ লেগে যায় আকাশে দু’বাজপাখির মধ্যে। মেষ শাবকগুলো ভয় পেয়ে মায়ের কাছে ছুটে এসে বললো, ‘ঐ পাখি দুটো বুঝি আমাদের আক্রমণ করতে আসছে।’ শুনে মা বলল ‘তোমরা বুঝতে পারছো না বাছা কোনটি আমাদের আক্রমণ করতে চায় কোনটি চায় বাঁচাতে।’ ইঙ্গিতটি যাঁরা বুঝতে পেরেছেন তারা এখানেই পড়া বন্ধ না করে কলামটি দয়া করে শেষ পর্যন্ত পড়ুন।
’৭৫ এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরে এদেশে বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের নাম নেওয়া যখন নিষিদ্ধ প্রায় তখনও অনেকে বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শকে বুকে লালন করে শুভ দিনের প্রত্যাশা করেছে। জেলে চার জাতীয় নেতাকে হত্যার উদ্দেশ্যেও ছিল আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করা। তা করা গেলে আরেকটি পাকিস্তান তৈরির পথ অনেকটা সুগম হবে তা বুঝতে ভুল করেনি ’৭৫ এর ঘাতকরা। তাদের সেই অভিপ্রায় সফল ও হতো যদি শেখ হাসিনা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন না করতেন এবং দলের হাল না ধরতেন। ’৭৫ থেকে ’৮২ এই ক’বছরেই নানা ষড়যন্ত্রে, নানা মতবাদে নানা নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একটি ভঙ্গুর রাজনৈতিক দলে পরিণত হতে যাচ্ছিল। ’৭৫ পরবর্তী হতাশ, বিভক্ত, কোণঠাসা ও দুর্বল আওয়ামী লীগকে আজকের এই পর্যায়ে আনার পেছনে শেখ হাসিনার অবদান কম নয়। তা যেমন তার নেতৃত্বের কারণে তেমনি জাতির জনকের রক্ত সম্পর্কের কারণেও। বাংলাদেশে প্রগতিশীল রাজনীতিতে এখনো আওয়ামী লীগের বিকল্প গড়ে না ওঠার দায় আওয়ামী লীগের নয়। এই ব্যর্থতা বাম গণতান্ত্রিক দলগুলোর। কারণ শুধু ক্ষমতার রাজনীতির জন্যে, লুটপাটে অংশ নেয়ার জন্যে যারা আজ আওয়ামী লীগে ভিড়েছে এবং যাদের জন্যে আওয়ামী লীগ আজ বিতর্কিত ও নিন্দিত হচ্ছে তাদের উত্থান ঠেকানো যেত যদি এদেশে একটি দেশপ্রেমিক গণতান্ত্রিক শক্তির উত্থান ঘটতো। অতীতের মতো এখনো দেখতে পাই আওয়ামী লীগকে চাপে রাখতে, সঠিক পথে পরিচালিত করতে ১৪ দলের মতো রাজনৈতিক শক্তির প্রয়োজন আছে। এদেশে জঙ্গিবাদ ঠেকাতে, সামপ্রদায়িক শক্তির উত্থান ঠেকাতে আওয়ামী লীগের বিকল্প এখনো নেই। এবং সে আওয়ামী লীগকে একতাবদ্ধ করতে, সুদৃঢ় ও শক্তিশালী করতে শেখ হাসিনার বিকল্প নেই। ১/১১ এর ঘটনা থেকেই আমরা শিক্ষা পেয়েছি হাসিনাবিহীন আওয়ামী লীগকে যোগ্য নেতৃত্ব দেয়ার একক কোনো নেতা নেই। আর আওয়ামী লীগ দুর্বল হলে, দ্বিধা বিভক্ত হলে, এদেশে সামপ্রদায়িক গোষ্ঠীরই শক্তি বৃদ্ধি হবে।
এখন প্রশ্ন উঠতে পারে এটি কোন গণতান্ত্রিক দেশের একটি গণতান্ত্রিক দলের সুস্থ রাজনৈতিক ধারা কিনা? আমি নি:সন্দেহে বলবো তা নয়। এমন পরিস্থিতি কাম্যও নয়। কিন্তু বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতির ধারাতো তাই। বাংলাদেশ ছাড়া পার্শ্ববর্তী মায়ানমার, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এমনকি খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন এফ কেনেডির জনপ্রিয়তাকে পুঁজি করে তার পরিবারের অন্য সদস্যরাও রাজনীতি করেছেন দীর্ঘদিন। ভালো হোক আর মন্দ হোক এই পারিবারিক রাজনীতির আবর্তেই চলছে এদেশগুলোর রাজনীতি। তা থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়।
যাক সে কথা, এবার অন্য শক্তিটির কথা বলি। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক ও ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করা দল ও সামরিক ছত্রছায়ায় জন্ম নেয়া দলগুলোর কথা যদি ধরি। আরেকটু খুলে বললে আওয়ামী লীগ বিরোধী শক্তির কথা যদি ধরি সেখানে নেতৃত্বের কোন সংকট নেই। প্রগতিশীল শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নেতৃত্বে আজ খালেদা জিয়াও যা বাবুনগরীও তা। কিংবা তা যেকোনো ব্যক্তি, তাকে শিখন্ডি করে এই শক্তির তৎপরতা চলতে কোন বাধা নেই। স্বাধীনতার পরে যে কোনোভাবেই হোক জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আওয়ামী লীগের বিরোধিতা করে এসেছে। এবং দীর্ঘদিন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ভুল ও মিথ্যা ইতিহাস শুনিয়ে প্রজন্মের পর প্রজন্ম তৈরি করা হয়েছে। তারা আওয়ামী লীগবিরোধী যেকোনো শক্তিকে সমর্থন দেবে, নেতৃত্বে যারাই থাকুক না কেন। একটি মুসলিম প্রধান দেশে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিতে পরিণত করা সহজ সাধ্য নয়। এছাড়া বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম মুসলিম দেশ যেখানে গণতন্ত্রের চর্চা আছে। (প্রকৃত গণতন্ত্র অবশ্য এখনো সুদূর পরাহত)। অন্তত ভোটাধিকার সহ রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের অংশগ্রহণ কিছুটা হলেও আছে। এই ধর্মনিরপেক্ষতা ও প্রগতিশীলতার বিরুদ্ধে একটি শক্তি বাংলাদেশে সর্বদাই সক্রিয়। এরা রাজনৈতিকভাবেই শুধু চিহ্নিত নয়। সমাজের বিভিন্ন স্তরে এরা সক্রিয়। এরা মুখে উদারতা ও প্রগতিশীলতার কথা বললেও কার্যত আক্রমণ ও ক্ষতি করেন প্রগতিশীল শক্তির।
বিশ্বে বর্তমান সরকার প্রধানদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে আছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দেশে মৌলবাদী ও জঙ্গিগোষ্ঠী, যুদ্ধাপরাধীদের সমর্থক, প্রধান বিরোধি দল, (২০০৪ সালের ২১ আগস্ট তৎকালিন সরকারের সময়ে শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলা করা হয়েছিল। অভিযোগ আছে এই ঘটনার সাথে তৎকালীন জোট সরকারের সংপৃক্ততা ছিল) পার্শ্ববর্তী মায়ানমারের আরকানি মুসলিমদের জঙ্গিগোষ্ঠী, আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাসহ বেশ কিছু উগ্রগোষ্ঠীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু এখন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনার জীবন বিপন্ন হওয়া মানে মৌলিক বাংলাদেশ, উদার বাংলাদেশ ও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ বিপন্ন হওয়া। তাই, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের রাজনীতিতে শেখ হাসিনাকে এখনো অপরিহার্য বলেই মনে হয়। আজকে দেশে অনেক বুদ্ধিজীবী যখন নিরপেক্ষতার দোহাই দিয়ে হাসিনা-খালেদা কিংবা আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে একই পাল্লায় মাপার চেষ্টা করেন এবং আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে বিএনপিকে ভাবেন তখন বিস্মিত হই। ওরা হয় অপরিণামদর্শী নতুবা জ্ঞানপাপী। আওয়ামী লীগ ১০০ ভাগ সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি বটে কিন্তু তাই বলে যে কাজ বিএনপি-জামাত জোটের পক্ষে করা সম্ভব তা ধারণা করা বা মনে করা চরম বোকামি ছাড়া কিছু নয়। সংকট বস্তুত ব্যক্তির নয় সংকট ব্যবস্থার। ব্যবস্থার কারণেই সীমাহীন আন্তরিকতা ও ব্যক্তিগত সততা থাকা সত্ত্বেও শেখ হাসিনা রাষ্ট্র পরিচালনায় হোঁচট খাচ্ছেন বার বার। আমরা নিজেরা বর্তমান বুর্জোয়া রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের তাগিদ অনুভব করছি বটে। কিন্তু তার জন্যে একটি প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি।
হেফাজত নেতা মামুনুল ও অন্যান্যের বয়ানে পরিষ্কার হচ্ছে শাপলা চত্বরের সমাবেশকে কেন্দ্র করে কীভাবে সরকার পতনের নীলনকশা করা হয়েছিল এবং তাতে আওয়ামী লীগবিরোধী সকল রাজনৈতিক দলের কোনটার কী ভূমিকা ছিল। সেদিন যদি তারা সফলকাম হতো (হেফাজতিদের বয়ানমতে) শফি সাহেব হতেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি আর বাবুনগরী প্রধানমন্ত্রী। আজ সে বাস্তবতা দেখতে হয়নি। তার জন্যেও তো অন্তত আওয়ামী লীগ ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
লেখক : কবি ও সাংবাদিক