প্রিয় স্বদেশ,
থমথমে পরিবেশে তোমায় লিখছি, আমাদের না বলা অনেক কথা। তুমিও নীতির শিখন দিয়ে বিপদে আছো নিশ্চয়। বর্তমানে নিজস্ব অধিকার রক্ষায় সোচ্চার তোমার সন্তানেরা মাথা কাটা দিয়েছে, বেয়োনটের নিচে। কেবল প্রতিবাদী আত্মাই পারে তার ঈশ্বরকে প্রশ্ন করতে। তোমার নীতিও ছিলো প্রতিবাদের। তোমাকে বাংলা মায়ের আঁচলে রাখতে কতশত প্রাণ ঝড়িয়েছিলো শাসকের পিচঢালা রাস্তায়। মাতৃগর্ভে যেমন সন্তান পালিত হয় পরম যত্নে, তেমন প্রতি মুহূর্তে যুদ্ধের সম্মুখীনও হতে হয়। আলোর যাত্রায় মা যতটা যুদ্ধ করে, সন্তানও ততটাই যুদ্ধ করে পৃথিবীতে আসে। তোমার আর আমাদের যুদ্ধ একই রথের সারথী। আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিতে হয়েছে, এই উপত্যকা আমার দেশ, আমার অধিকারও ততটা বেশি।
যদিও রাষ্ট্র ভাবনা স্বয়ং একটা মিথ, এই মিথের সৃষ্টি সীমানা। সীমানা মনে করিয়ে দেয় ক্ষমতা এবং পৈশাচিক অধিকার। তবুও রাষ্ট্র ভাবনা থেকে বেরিয়ে, আমরা তোমাকে মা ডেকেছি। মায়েদের সীমানা হয় না, মা তার প্রত্যেক সন্তানের প্রতি যেমন সহৃদ তেমনই নীতিতে বলিয়ান। তবুও ছবক নিতে তার সাধারণ সন্তানদের মাথা কাটা পড়া এখন নিত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তরুণদের প্রতি এখন ছুঁড়ে আসে বিদ্রোহের বাণী, তাদেরকে প্রশ্ন করে কেন তুমি তোমার মাকে ভালোবাসোনি, কেন পাড়ি দিতে চাও অন্যদেশে? সন্তান বড় হলে মায়ের আঁচল ফেলে আকাশ ছুঁতে চায়, রাত পোহালেই আঁচলে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকে। কিন্তু এখন সন্তানদের এমন কি হলো তারা আর মায়ের বুকে ফিরতে চায় না? প্রিয় স্বদেশ, আমার প্রশ্নগুলো শুনছো তো?
বর্তমানে তরুণেরা ছন্নছাড়া। শুরু থেকে যে শিক্ষাক্রমের ভেতর দিয়ে তারা যায়, তাদের কারো সুযোগ থাকে না নিজস্ব সৃষ্টিশীলতা, কারিগরি জ্ঞান প্রমাণ করার। তারা ভাগ হয়ে যায় অর্থনৈতিক কাঠামোতে। যেকোনো উপায়ে একটা চাকরি তো তাদের চাই। ফলত কোটার বিরুদ্ধে শত তরুণেরা এক হয়েছিল, যেমন মেধা ও শ্রম থাকা শর্তেও পাকিস্তান আমাদের ন্যায্য রাজস্ব দেয়নি, ব্রিটিশ সরকার দুইশত বছর শাসন করেছে। ঠিক তেমন। কোন আন্দোলন কতটা যৌক্তিক তা নির্ভর করে, তরুণদের সততার উপর কেননা তরুণেরাই আগামীর ভবিষ্যৎ। যদিও এখন কোটা পুনঃবহালের রায় বাতিল হয়ে ৯৩ শতাংশ মেধাকে দেওয়া হয়েছে। প্রিয় স্বদেশ, তোমার সন্তান আবু সাঈদের রক্তে যে পথ এখনো আগুনের উল্কায় ফুলে ফেঁপে আছে , সে পথে কোনো রায় কি তোমার প্রাণ জুড়াতে পারে কিনা জানিও।
গলির প্রতি মোড়ে মোড়ে কারফিউ। অনির্দিষ্টকালের জন্যে কারফিউর আজ কতঘণ্টা পেরিয়েছে হিসেব করতে পারছি না। ইন্টারনেট নেই, বলা যায় আমরা এখন সংযোগ বিচ্ছিন্ন। মায়ের সাথে সন্তানের, সন্তানের সাথে রাষ্ট্রের, রাষ্ট্রের সাথে মানবতার আর প্রেমিকের সাথে ভয়ার্ত প্রেমিকার এই বিচ্ছিন্নতা।
ভয় ঈশ্বরের জন্ম দেয়, দুঃখ ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি। কারফিউ শিথিলের বেলায় চড়া দামে পচা সবজি কিনতে ছুটেছিলাম, রাস্তায় গুমোট বাতাস। দমবন্ধ লাগছে, এর ভেতর পাশেই এক নারী বিবর্ণ মুখে ভাঙা ডিম থেকে বহু কষ্টে বেছে কিছু ডিম কিনছেন। প্রিয় স্বদেশ, ডিমগুলো যেন অবিকল আমাদের ভাঙ্গা অমানবিক মাথার মতন।
কচকচে পাঁচশ টাকার এক নোট। কিছু পুরানো সবজি, আর এক ডজন ডিম কিনেই ফুরিয়ে গেলো। এত দ্রুত বোধহয় আমাদের বিবেকও ফুরায় না। আমার সাথে এক মহিলা বাজার করছিলেন। হাতে তিনেক বাজার নিয়ে, হুট করে হাত পেতে বসলেন আমার সামনে। ভীষণ রাগ হলো, মানুষ মরে যাচ্ছে উনি আছেন ভিক্ষা নিয়ে। এক ঝাটকায় রিকশায় উঠে বাসায় চলে যাব, মনে পড়ল নয় মাসের গর্ভের সন্তান নিয়ে আমার প্রিয় বোন কিভাবে এই রুদ্ধশ্বাস পথ পাড়ি দেবে? হঠাৎ বিপদে কোনো রিকশা বা সি এন জি পাব তো? পরক্ষণেই মনে পড়লো আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত। চার ডিজিটের নাম্বার চেপেই এম্বুলেন্সে কল দেব। এম্বুলেন্সের এই এক সুবিধা, কৃত্রিম অক্সিজেন পাওয়া যায়। প্রিয় স্বদেশ, তোমার আঁচলে শ্বাস নিতে এত কষ্ট আগে হয়নি, তুমি সুস্থ আছো তো?
সুস্থতা দিয়ে মনে পড়লো, আন্দোলনে তোমার বেশ কিছু সন্তান আহত হয়েছে, নিহতের হিসাব মিলায়নি। তারা অনেকে হাসপাতালের করিডোরে পড়ে ছিল, ছাত্রীদেরকে ইজ্জতের ভয় দেখিয়ে হল থেকে বের করে দিয়েছে, ছাত্র হলে হামলা এবং রাস্তায় রাস্তায় আহতের সংখ্যাটা কত জানতে এক বন্ধুকে ফোন করব ভেবেছিলাম, কারফিউতে মোবাইলেও রিচার্জের সুযোগ নেই। প্রিয় স্বদেশ, তুমি খবর নিয়েছো কি? পরের পত্রে তুমিও জানিও, পরিস্থিতি ঠিক হলে বাংলার সেসব দামাল সন্তানদেরকে কত টাকা ভাতা দেওয়া হবে, তাদের পরিবারেরা বিলিন হলো কিনা! তাদের বিরুদ্ধে যে সমন জারি হয়েছে, সেগুলো সম্মানের সহিত তুলে নেওয়া হলো কিনা?
সকলে পালিয়ে যায়, এখন পালানোতে শান্তি। আগের মত কেউ অপেক্ষা করে না, ধৈর্য্য ধরে না। তবুও হাসপাতালের করিডোরে অপেক্ষা করেন মায়েরা। সন্তানপ্রতিম ভাতিজা আমার ভীষণ অসুস্থ ছিলো, পানিশূন্যতায় তার শরীরে কড়কড়ে ফাঁটা ধরা পড়েছে। যে মায়ের গর্ভে তার পালন, সেই এখন রাতে দিনে যত্নে পানিশূন্যতা কাটিয়ে তুলেছেন। তবুও এই কারফিউর দিনে মনে কেমন চিনচিন ব্যথা হচ্ছে, হুট করে আবার কিছু হলে, কিভাবে কাটিয়ে উঠব আমরা। প্রিয় স্বদেশ, তোমার শরীরেও পানিশূন্যতা দেখা দিয়েছে, সময় মতো মানবতার গেলাসে পানি পান করো। তোমার কর্কশ সন্তানদের কপালে নজর টিপ দেবে কিভাবে?
তোমাকে পত্র লিখতে আমার সময় আছে, কিন্তু অস্থিরতা আর ভয় আমাকে কুড়ে খাচ্ছে। এই মাসেই তৃতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা ছিলো, তোমার শরীরে এত ঘা নিয়ে পরীক্ষা হওয়া সম্ভব না, পিছিয়ে গেলো। প্রত্যেকবার মনে পড়ে, আমরা উচ্চ মধ্যবিত্ত হলেও পড়াশোনা ছাড়া আমাদের কোনো গতি নেই। তোমার শরীরে মলম লাগিয়ে সারিয়ে তুলতে সময় লাগবে নিশ্চয়, জেনে রাখো তোমাকে ভালোবাসি তবুও আমাদের যে ক্ষতি হয়ে গেলো, সময়ের ফেরে সে ঘা তুমিও কি সারিয়ে তুলতে পারবে? শত তরুণদের এই সেশন জট আরো দলা পাকিয়ে উঠছে, তাদের জীবনের এই জট খুলতে তোমার যথেষ্ট কষ্ট হবে। প্রিয় স্বদেশ, তোমার খনির তেল আর অপাত্রে দিও না, এবারের যাত্রায় সন্তানদের জটে সমস্ত তেল দিও? তাদের অসুখী দেখতে তোমারও ভালো লাগে না, জানি।
রাষ্ট্র ভাবনা যেমন মিথ, তেমনই ভালো মন্দ, পাপ–পবিত্র, সাদা–কালো সবই মিথ। তবুও তোমার সন্তানের পাপ হয়েছে। এ পাপ গোঁড়ায়, শুদ্ধ ইংরেজিতে বলে সিস্টেম। আমাদের মূল সমস্যা কিন্তু সিস্টেমে। তবুও সিস্টেমে থেকে সিস্টেমকে প্রশ্ন করে যেতে হয়। প্রশ্ন করার অধিকার ছিনিয়ে নিলে, মানুষের আর কিছু থাকে কি? ভুল বলাও যে অধিকার। তবে প্রিয় স্বদেশ, মায়ের মত কেবল তুমিই পারো শাসন করে, ভালোটা শেখাতে। সিস্টেমকে ভেঙ্গে নতুন সিস্টেম গড়তে।
হাতের পাশে এখন মানিকবাবু আছেন, প্রাগৈতিহাসিক গল্প শোনাচ্ছেন, ‘এ জগতে সবাই পাপী। অন্য পাপ যে করে না, মানুষের মনে ব্যথা তো অনন্ত সে দেয়, ইচ্ছায় হোক অনিচ্ছায় হোক, জানিয়া হোক, না জানিয়া হোক, মানুষের মনে ব্যথা দেওয়ার চেয়ে বড়ো পাপ মানুষকে খুন করাও নয়, মানুষকে যে দুঃখ দেয় না সে দেবতার চেয়ে বড়ো, কারণ, দুঃখই মানুষের দেবতাকে জন্ম দিয়াছে; সুখটা নিজস্ব কীর্তি, দুঃখের দায়িত্ব দেবতার’।
তবুও স্বদেশ তোমাকে মনে করিয়ে দিই, আমি তোমারই অংশ আর তুমি মূলত আমিই। কাল আমাদের কি হবে তা নির্ধারণ ফলত আমিই করতে পারি। আমিই সকল ক্ষমতার উৎস যেমন, আমিই সকল অসুরের বিনাশী। তুমি আমার শক্তি, সুখের ভাগটা আমি নিচ্ছি, দুঃখটাও তাই আমারই।
ইতি/ প্রিয় স্বদেশ