সিনহা হত্যা মামলায় ২০২১ সালের ২৭ জুন ১৫ আসামির বিচার শুরুর আদেশ দিয়েছিলেন কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল। সাত মাস পর গতকাল সোমবার তিনি রায় ঘোষণা করলেন। বেলা ২টা ২৪ মিনিটের দিকে তিনি রায় ঘোষণা শুরু করেন। শুরুতেই তিনি বলেন, “রায় প্রায় ৩০০ পৃষ্ঠার। শেষের কিছু অংশ আমি পড়ছি। মূলত খোঁজার চেষ্টা করেছি, ঘটনাস্থল এপিবিএন চেকপোস্টে কেন এই দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ড ঘটে। একটি প্রশ্নের উত্তর জবানবন্দি এবং আদালতে সাক্ষ্য-জেরা চলাকালেও বারবার খোঁজার চেষ্টা করেছি- এপিবিএন সদস্যরা স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলার পরও কেন আবার মেজর সিনহার গাড়ি থামানো হল? কেনই বা গুলি করা হল।’ খবর বিডিনিউজের।
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘এপিবিএন সদস্যরা স্যালুট দিয়ে চলে যেতে বলার পরও কেন হত্যার ঘটনা থামাতে পারলেন না? এ বিষয়ে এপিবিএন সদস্য এসআই শাহাজাহান আদালতে প্রশ্নের জবাবে উত্তর দেয়, পাশেই একটা গাছের নিচে লিয়াকত দাঁড়িয়ে ছিল। কিছু বুঝে উঠার আগেই ১০-২০ সেকেন্ডের মধ্যে গুলি করে দেয়। কেন লিয়াকত গুলি করে তা সাক্ষী ও আসামিদের সাক্ষ্য ও জবানবন্দিতে জানার চেষ্টা করি।’ এরপর বিচারক ইসমাইল হোসেন বিভিন্ন সাক্ষী ও আসামির জবানবন্দি থেকে উদ্ধৃত করে কীভাবে সেদিনের রাতে ঘটনা ঘটে, কার কী ভূমিকা ছিল, আসামিরা কখন কে ঘটনাস্থলে আসে, ঘটনার রাতে কোন আসামি কী মন্তব্য করেছিল- সেসব বিষয় তুলে ধরেন। পরে বেলা ৪টা ২০ মিনিটের দিকে সাজা ঘোষণা করেন বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল।
বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে বলেন, ‘ষড়যন্ত্রমূলক ও পূর্ব পরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় লিয়াকত ও ওসি প্রদীপ আগাগোড়া নেতৃত্ব দান করায় ৩০২, ২০১, ১০৯, ১১৪, ১২০ ও ৩৪ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের দুজনকে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হল।’ লিয়াকতের সাজার কারণ ব্যাখ্যা করে বিচারক বলেন, ‘সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সাথে ষড়যন্ত্র করে, উপর্যপুরি গুলি করে আসামি লিয়াকত আলী। মৃত্যু নিশ্চিত করতে বিলম্বে হাসাপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে ও হত্যার আলামত ধ্বংস করতে মেজর সিনহা ও তার সঙ্গী সিফাতের বিরুদ্ধে দুটি মিথ্যা মামলা করে সে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।’
আর প্রদীপের সাজার কারণ জানিয়ে বিচারক বলেন, ‘সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যার উদ্দেশ্যে আসামি প্রদীপ কুমার দাশ অপর আসামিদের সাথে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করে পূর্ব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে অপর আসামিদের সহায়তায় সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খানকে হত্যা করে, বুকে লাথি মেরে পাঁজরের দুটি হাড় ভেঙে, গলা চেপে মৃত্যু নিশ্চিত করে, হাসপাতালে পাঠাতে দেরি করিয়ে, হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য এবং ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে মামলার আলামত ধ্বংস করে, দুটি মিথ্যা মামলা করে শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।’
প্রদীপের আইনজীবীরা শুনানিতে যুক্তি দিয়েছিলেন, টেকনাফের সাবেক এই ওসি সেই রাতে ঘটনাস্থলে গিয়েছিলেন ঘটনার ‘অনেক পরে’। সে বিষয়ে বিচারক তার রায়ে বলেন, ‘টেকনাফ থানা থেকে রওনা হওয়ার সময় ওসি প্রদীপ একটি জিডি করে থানা থেকে বের হন এবং ফিরে থানায় আরেকটি জিডি করেন। যাওয়ার সময় জিডিতে শামলাপুর চেকপোস্টে গোলাগুলি হচ্ছে উল্লেখ করেন। এই মামলার সাক্ষী এমনিক আসামিরাও ঘটনায় ওসি প্রদীপ কুমার দাশের সম্পৃক্ততার বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন। পূর্বাপর বিবেচনা করে তার ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে।’
যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া তিন পুলিশ সদস্য নন্দ দুলাল রক্ষিত, সাগর দেব ও রুবেল শর্মা তাদের ঊর্ধ্বতনের আদেশ অসৎ উদ্দেশ্যে অপরাধ সংঘটনের জন্য জেনেও অন্য আসামিদের সহায়তা করে, প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করে, ঘটনাস্থলে উপস্থিত থেকে হত্যার দায় থেকে বাঁচার জন্য আলামত ধ্বংস করে এবং সিনহা ও তার সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করার অপরাধে দণ্ডিত হয়েছে বলে জানান বিচারক।
এছাড়া মারিশবুনিয়া এলাকার তিন বাসিন্দা আয়াজ উদ্দিন, নুরুল আমীন ও নিজাম উদ্দিন নিজেদের এলাকায় মাইকিং করে ‘ডাকাত’ আখ্যায়িত করে গণপিটুনিতে সিনহা ও তার সঙ্গীকে হত্যার চেষ্টা করায়, ব্যর্থ হয়ে তাদের গতিবিধির বিষয়ে টেলিফোনে হত্যাকারীদের জানিয়ে দিয়ে ‘অপরাধ বাস্তবায়নে সহযোগিতা করায় এবং মাদকের মিথ্যা মামলায় সাক্ষী হয়ে অপরাধ করায় তাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন বিচারক। তিনি বলেন, অন্য সাত আসামির বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সাক্ষ্য প্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণিত না হওয়ায় তাদের বেকসুর খালাস দেওয়া হল।