উজানের পানিতে কাপ্তাই হ্রদ টইটম্বুর। জেলাজুড়ে বৃষ্টিপাত থামলেও উজানের পানির হ্রদের পানি বিপৎসীমায় পৌঁছায় চাপ কমাতে গতকাল মঙ্গলবার দুই ধাপে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট আরও ১২ ইঞ্চি করে খুলে দেওয়া হয়েছে। গত রোববার সকালে খোলা হয়েছিল ছয় ইঞ্চি। তিন দিনেও হ্রদের পানির চাপ না কমে উল্টো বাড়ায় মোট ১৮ ইঞ্চি জলকপাট খোলা হয়েছে। এতে করে বর্তমানে জলকপাট দিয়েছে ৩০ হাজার কিউসেক পানি প্রতি সেকেন্ডে নির্গম হচ্ছে কর্ণফুলী নদীতে। এদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে একই সঙ্গে আরও ৩২ হাজার কিউসেক পানি যাচ্ছে কর্ণফুলীতে। বাঁধ ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের টারবাইন দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ৬২ হাজার পানি নির্গম করা হচ্ছে। এতে করে রোববার থেকে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী এলাকায় এর প্রভাব না পড়লেও এবার পানি বাড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে কর্ণফুলী পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক (তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী) এটিএম আব্দুজ্জাহের জানান, কাপ্তাই হ্রদে পানিপ্রবাহ বাড়ায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে দেড় ফুট অর্থাৎ ১৮ ইঞ্চি করে ১৬টি স্পিলওয়ে (জলকপাট) খুলে দেওয়া হয়েছে। এতে প্রতি সেকেন্ডে ৩০ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলী নদীতে নির্গম হচ্ছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটে গড়ে ২১৫–২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে আরও ৩২ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলী নদীতে যাচ্ছে টারবাইন হয়ে। মোট ৬২ হাজার কিউসেক পানি কর্ণফুলীতে ফেলা হচ্ছে। সন্ধ্যা ৬টায় কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা ১০৮ দশমিক ৮৮ মিনস সি লেভেল (এমএসএল)। হ্রদে ধারণ সক্ষমতা ১০৯ এমএসএল।
এর আগে রোববার সকাল ৮টায় কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি জলকপাট ৬ ইঞ্চি করে খুলে দেওয়ার পর দুপুর ২টায় বন্ধ রাখা হয়। বিকালে হ্রদে পানিপ্রবাহ বাড়ায় ৫ ঘণ্টা পর ফের সন্ধ্যা ৭টা থেকে চার ইঞ্চি করে খুলে দেওয়া হয়। সোমবার সকাল থেকে আবারও ৬ ইঞ্চি করে পানি ছাড়া হয়। এর মাঝেও হ্রদে পানি বাড়ায় গতকাল সকালে ১২ ইঞ্চি এবং সর্বশেষ দুপুরে ১৮ ইঞ্চি করে জলকপাট খুলে দেওয়া হয়েছে। কর্ণফুলী অববাহিকায় কাপ্তাই হ্রদের এই পানির শেষ গন্তব্য বঙ্গোপসাগর।
ডুবে আছে বসতঘর–রাস্তাঘাট, ফসলি ক্ষেত : রাঙামাটিতে রোববার থেকে বৃষ্টিপাত থেমে গেলেও পাহাড় ও উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢলে কাপ্তাই হ্রদের পানি ক্রমাগত বাড়ছে। জেলার নদ–নদীগুলোর পানি প্রবাহিত হচ্ছে। নানিয়ারচর উপজেলার চেঙ্গী নদী, লংগদুর মাইনী, বাঘাইছড়ি কাচালং, জুরাছড়ির শলক নদ ও বিলাইছড়ির রীংক্ষ্যং নদী দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়ে আসছে কাপ্তাই হ্রদে। নদ–নদীর পানি বেড়ে যাওয়ার ফলে রাঙামাটি জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতি হচ্ছে ফসলি জমির। ডুবে যাচ্ছে রাস্তাঘাট ও বসতবাড়ি। এছাড়া বাঘাইছড়ি উপজেলায় ছয়টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। লংগদুর দুটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী না আসায় পাঠদান বন্ধ রয়েছে।
রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার বাসিন্দা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রপ্তদ্বীপ চাকমা বলেন, জুরাছড়িতে পানি বেড়ে আটটি গ্রামের নিম্নাঞ্চল পানিতে ডুবেছে। রাস্তাঘাট–বসতঘরে পানি উঠেছে। এখন চলাচলের একমাত্র উপায় হচ্ছে নৌকা। পানি বেড়ে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে আছে শিক্ষার্থীরা।
বিলাইছড়ির উপজেলা বাসিন্দা অসীম চাকমা বলেন, বিলাইছড়ি উপজেলা সদরের বিভিন্ন এলাকায় বসতবাড়ি ডুবেছে। উপজেলার বাজার এলাকা, দীঘলছড়ি, ধুপ্পারচরসহ অন্যান্য নিচু এলাকায় কাপ্তাই হ্রদের পানি বেড়ে ঘরবাড়ি, কৃষি জমি, সবজি ক্ষেত ও গবাদিপশুর চারণ ভূমি ডুবে আছে।
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোশারফ হোসেন খান বলেন, কাপ্তাই হ্রদে পানি বাড়ায় মঙ্গলবার দুপুর থেকে দেড় ফুট করে কাপ্তাই বাঁধের জলকপাটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। রাঙামাটি শহর এলাকাসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে।
কাপ্তাইয়ে তলিয়ে গেছে কাঁচা ঘরবাড়ি : কাপ্তাই প্রতিনিধি জানান, পানি বৃদ্ধির কারণে কাপ্তাই হৃদের তীরবর্তী অনেক বাড়িঘর পানিতে ডুবে গেছে। কাপ্তাই–রাঙামাটি সড়কের আসামবস্তি এলাকায় একটি ঘর পানিতে ডুবে থাকতে দেখা গেছে। মো. বজলু মিয়া বলেন, তার মতো অনেকের ঘরবাড়ি কাপ্তাই লেকের পানিতে ডুবে আছে। বাড়িঘর ছেড়ে আমরা এখন বিভিন্ন স্থানে কষ্টে দিনাতিপাত করছি।
কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক প্রকৌশলী এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, কাপ্তাই লেকে পানি ধারণ ক্ষমতা ১০৯ ফুট এমএসএল। এই লেভেলের নিচে কাউকে ঘরবাড়ি নির্মাণ না করার জন্য বারবার বলা হলেও শুষ্ক সময়ে অনেকে লেকের জেগে ওঠা জমিতে কাঁচাঘর তৈরি করেন। ভবিষ্যতে কাউকে লেকের নিচু এলাকায় কাঁচা ঘরবাড়ি নির্মাণ না করার জন্য আহ্বান জানান তিনি।