তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার ১৯৫৬ সালে আমেরিকার অর্থায়নে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণ শুরু করে, যা ১৯৬২ সালে শেষ হয়। ইন্টারন্যাশনাল ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি এবং ইউতাহ ইন্টারন্যাশনাল ইনকর্পোরেট ৬৭০.৬ মিটার দীর্ঘ ও ৫৪.৭ মিটার উচ্চতার এ বাঁধটি নির্মাণ করে। এই বাঁধের পাশে ১৬টি জলকপাট সংযুক্ত ৭৪৫ ফুট দীর্ঘ একটি পানি নির্গমন পথ বা স্পিলওয়ে রাখা হয়েছে। এ স্পিলওয়েটি প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে। প্রকল্পটির বাজেট ধরা হয়েছিল ২৫ কোটি ৪০ লাখ টাকা, পরে তা ৪৮ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। কাপ্তাই বাঁধ রাঙামাটি জেলার কাপ্তাই উপজেলায় অবস্থিত।এটি চট্টগ্রাম হতে ৬৫ কিলোমিটার (৪০ মাইল) উজানে কর্ণফুলী নদীর উপর নির্মিত। ‘কাপ্তাই হ্রদ’ নামে পরিচিত এটি একটি কৃত্রিম জলাধার, যার আয়তন ১৭২২ বর্গ কিলোমিটার। তবে ভরা বর্ষায় আরও প্রায় ৭৭৭ বর্গ কিমি এলাকা প্লাবিত হয়। লুসাই পাহাড় থেকে শুরু করে কাপ্তাই পর্যন্ত এর দূরত্ব ২২৫ কি.মি। পানির গড় গভীরতা ১০০ ফুট (৩০ মিটার) ও সর্বাধিক গভীরতা ৪৯৫ ফুট (১৫১ মিটার)। বাঁধ ও হ্রদটি নির্মাণের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল জল বিদ্যুৎ উৎপাদন করা।এখানে বাঁধের সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়।এই কেন্দ্রে প্রথমে ৪০ মেগাওয়াট/প্রতিটি ক্ষমতা সম্পন্ন ১ ও ২ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হলেও পরে ১৯৬৯ সালে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ৩ নম্বর ইউনিট স্থাপন করা হয় এবং ১৯৮৭-৮৮ সালে আরো দু’টি ইউনিট স্থাপন করা হয়। বর্তমানে মোট পাঁচটি ইউনিট চালু আছে যার মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। যদিও পানির স্তর ১০৮ ফিটের বেশি থাকলে ২৪২ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়।এটি দেশের বৃহত্তম বাঁধ ও একমাত্র জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র। কাপ্তাই লেক বাংলাদেশ এমন কি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ্য সৃষ্ট বৃহত্তম স্বাদু পানির হ্রদ। তবে এই বাঁধের কারণে ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি ডুবে যায়, যা ঐ এলাকার মোট কৃষি জমির ৪০ শতাংশ।এছাড়া সরকারি সংরক্ষিত বনের ২৯ বর্গ মাইল এলাকা ও অশ্রেণিভুক্ত ২৩৪ বর্গমাইল বনাঞ্চলও ডুবে যায়। প্রায় ১৮ হাজার পরিবারের এক লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়।
প্রধানত জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য এটি সৃষ্টি করা হলেও, এ জলাধারে প্রচুর পরিমাণে মিঠাপানির মাছচাষ করা হয়। নৌবিহার, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও কৃষি আবাদ ইত্যাদিতেও এর অবদান উল্লেখযোগ্য। মূলত রাঙামাটি জেলাতেই জলাধারটি সীমিত যার অন্তর্ভুক্ত উপজেলাসমূহ হচ্ছে রাঙামাটি সদর, কাপ্তাই, নানিয়ারচর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, বরকল, জুরাছড়ি ও বিলাইছড়ি। স্থানীয় লোকজন হ্রদ টিকে ঘিরে রাখা প্রতিরক্ষামূলক গাছপালা উজাড় করে ফেলায় এর সব শিলাপাথর বর্ষাকালে বৃষ্টির পানিতে সহজেই ক্ষয়িত হচ্ছে। ফলে হ্রদটি দ্রুত ভরাট হয়ে যাচ্ছে। নব্বইয়ের দশকের প্রথম দিকে যখন হ্রদটির বয়স ৩০ বছর তখনই হ্রদটির প্রায় ২৫% ভরাট হয়ে গিয়েছিল।
জলবিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াও হ্রদটি অন্যান্য দৃষ্টিকোণ থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। লেকটির মাধ্যমে একটি বৈচিত্র্যপূর্ণ ও দীর্ঘ জলপথের সৃষ্টি হয়েছে। আগে যেখানে অনেক জায়গায় যেতে সারাদিন বা তারও বেশি সময় লাগতো, এখন সেখানে স্পিড বোট বা লঞ্চে যেতে লাগে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। পাহাড়ব্যাপি বনজঙ্গলে বনজ সম্পদ অনুসন্ধানে অনেক দুর্গম অঞ্চলেও এখন সহজে ঢোকা সম্ভব হচ্ছে। সমগ্র হ্রদটি পর্যটকদের জন্য একটি আকর্ষণীয় স্থান। যদি এখানে পর্যটক আর্কষণের জন্য লেকের মাঝে বিভিন্ন উঁচু পাহাড়ের মধ্যে রোপওয়ে ও তাতে মানসম্পন্ন রিসোর্ট তৈরি করা হয়। বিভিন্ন বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানের আয়োজন ও উপজাতীয় সংস্কৃতির বিকাশ ও লেকে রিভার ক্রুজের ব্যবস্থা করা হয়, তবে এটি দেশের সেরা পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে।
কৃষি ও মৎস্য সম্পদ উন্নয়নেও হ্রদটির অবদান উল্লেখযোগ্য। বছরের বিভিন্ন মাসে হ্রদে পানির উচ্চতা ভিন্ন ভিন্ন হওয়ায়, হ্রদ তীরবর্তী এলাকা এক ধরনের স্বয়ংক্রিয় সেচ সুবিধা লাভ করে যা চাষাবাদের জন্য জমিকে খুব উর্বর করে তুলছে। হ্রদটির আনুমানিক আয়ুষ্কাল ৯০ বছর, এরপরে এর তলদেশ পলি পাথরের আস্তরণে সম্পূর্ণ মজে যাওয়ার কথা। তখন বিদ্যুৎ কেন্দ্রেটির উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে, উপজেলাগুলোর মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাবে, পর্যটন খাতে ধস নামবে, আশেপাশে চাষাবাদ ব্যাহত হবে ও লেকের মাছ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। ড্রেজিং করে যদি এর পানি ধারন ক্ষমতা বাড়ানো যায়, তবে এর আয়ুষ্কাল আরো দীর্ঘ হবে এবং এতে হ্রদটি হ্যাচারি ও মৎস্য উৎপাদনের মূল্যবান আধার হিসেবে চালু থাকবে। জলাধারের উৎপাদিত মাছ স্থানীয় চাহিদা মিটিয়েও দেশের অন্যান্য এলাকায় চালান করা যাবে। বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশন,ফ্রেশ ওয়াটার রিসার্চ সাব-স্টেশন এবং অ্যাকুয়াটিক রিসার্চ গ্রুপ-এর ব্যাপক মাঠ পর্যায়ের পর্যবেক্ষণের দেখা গেছে, ১৯৮৫ সালে হ্রদে মাছের প্রধান প্রজাতি রুই এর উৎপাদন দারুণভাবে কমে যায়, যা ছিল কাপ্তাই লেকের মৎস্য উৎপাদন ইতিহাসে সবচেয়ে কম। অত্যধিক রুই মাছ তুলে নেওয়ার কারণে এটা ঘটেছিল। রুই মাছের উৎপাদনের অনুপাত ধীরে ধীরে কমে আসায় সামুদ্রিক ক্লুপিডের (চবষধমরপ ঈষঁঢ়বরফং) প্রজনন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। এখন যে দুই প্রজাতির মাছ সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তা হলো চাপিলা ও কাচকি। বর্তমানে ধৃত মাছের মধ্যে এই দুই প্রজাতির অনুপাত ৫০%। প্রাপ্ত মাছের তালিকায় আট প্রজাতির মাছের বাণিজ্যিক গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। এগুলি হচ্ছে কাতলা, মৃগেল, রুই, কালিবাউস, ঘনিয়া, চিতল, বোয়াল এবং চাপিলা। বর্তমানে লেকের বার্ষিক মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ ৭,০০০ টনের বেশি। তবে সামপ্রতিককালে লেকের চারপাশে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহারের কারণে পানি দূষিত হওয়ায় জলজ প্রাণীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
১৯৬৬ সালে যেখানে মোট মাছ উৎপাদনের মধ্যে বড় মাছের অংশ ছিল ৭৮%। ১৯৯৩ সালে তা মাত্র ২% নেমে এসেছে। এছাড়াও প্রতিদিন লেকটিতে ৫ টনেরও বেশি মনুষ্য বিষ্ঠা ও অন্যান্য বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। লেকের চার পাশের ৮৫ শতাংশ মানুষই পানীয় জল, রান্না, ধোয়া-মোছা, গোসল ইত্যাদির জন্যে এ লেকের পানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি ভয়ানকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ রাঙামাটি শহরে যে পানীয় জল সরবরাহ করছে তাতে জীবাণুর অনুপাত গ্রহণযোগ্য মাত্রার ১০ গুণেরও বেশি।
তবে এই বাঁধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন।এখানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ মাত্র ৫৪ পয়সা। দেশে গ্যাস চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ ২.৫ টাকা/ইউনিট ও ফার্নেস ওয়েল চালিত কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন খরচ ২০ টাকা/ইউনিট। যদিও পিডিবির গড় মূল্য ৫.৮৪ টাকা/ইউনিট। তবে এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের সবগুলো ইউনিট চালাতে হলে পানি রিজার্ভ থাকতে হয় ১০৮ ফিট কিন্তু বর্তমানে আছে মাত্র ৭৫ ফিট পানি। যাতে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে। যদি সবগুলো ইউনিট পুরোদমে চালানো যায় তবে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে ২৪২ মেগাওয়াট। যার কস্টিং (২৪২ী১০০০ী২৪) = ৫৮,০৮,০০০ ইউনিট ী ০.৫৪ = ৩১,৩৬,৩২০ টাকা। পিডিবির গড় মূল্যে এর মূল্য হলো = ৩,৩৯,১৮,৭২০ টাকা। অর্থাৎ শুধু ২৪ ঘন্টায় এই কেন্দ্র হতে সরকারের সাশ্রয় হবে ৩,০৭,৮২,৪০০ টাকা। আর বছরে সাশ্রয় হবে ১১২৩.৫৫ কোটি টাকা। শুধু এক বছরের সাশ্রয়ের টাকা দিয়ে ড্রেজিং করে লেকের নাব্যতা বৃদ্ধি ও পানির রিজার্ভ বাড়ানো সম্ভব। অথচ গত ৫৯ বছরে এক বালতি মাটিও ড্রেজিং করে উঠানো হয়নি। তাই অতি দ্রুত এটি খনন করে লেক ও বিদ্যুৎ কেন্দ্রটিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত। এখানে উল্লেখ্য যে, পানির উচ্চতা ১১০.৫ ফুটের বেশি হলে তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে জলকপাটের উপর দিয়ে চলে যায়। এখানে টারবাইনের প্রফেলরগুলো হলো লেকের তলা হতে ৭০ ফিট উপরে, তাই পানির উচ্চতা ৭০ ফিটের নিচে নামলে টারবাইন বন্ধ রাখতে হয়। ১৯৮৭-৮৮সালে জাপানের মারুবেনী কোম্পানি ৪ ও ৫ নং ইউনিট স্থাপন করার সময় ভবিষ্যতে আরো দুইটি ইউনিট বসানোর জন্য স্পেস করে রাখে। যা খুব অল্প সময়ের মধ্যে বসানো সম্ভব। সে জন্য ১৯৯৬ সালে জাপানের মারুবেনী আবারো ৬ ও ৭ এই দুইটি ইউনিট বসানোর জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে স্থানীয় আদিবাসীরা এতে আপত্তি দেয়। পরে সরকার ২০০২-০৩ সালে ৬ ও ৭ ইউনিট স্থাপনের সম্ভবতা যাচাইয়ের জন্য একটি বিদেশি কোম্পানিকে দিয়ে সমীক্ষা চালায়। এতে উক্ত বিদেশি কোম্পানি বিদ্যমান বাঁধের সাহায্যে মে হতে নভেম্বর পর্যন্ত যে অতিরিক্ত পানি আসে তা দিয়ে ৬ ও ৭ নং ইউনিট অনায়াসে চালানো যায় বলে এটিকে আর্থিকভাবে সফল বলে মতামত প্রদান করে। যদিও এরপর এই প্রকল্প নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয়নি। তাই সামগ্রিক বিষয় বিচার বিশ্লেষণ করে কাপ্তাই হ্রদের বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আর্কষণ করছি।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক