কানের পর্দা প্রতিস্থাপন : যুগান্তকারী মাইক্রোসার্জারী

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | সোমবার , ১৭ মে, ২০২১ at ৫:০২ পূর্বাহ্ণ

আমরা জানি কান মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ বিশেষ। কানে শোনা এবং শরীরের ভারসাম্য রক্ষার পাশাপাশি কান আমাদের শারীরিক সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আমাদের কানের ৩টি অংশ রয়েছে- ক) বহিঃকর্ণ খ) মধ্যকর্ণ ও গ) অন্তকর্ণ। বহিঃকর্ণ ও মধ্যকর্ণের মধ্যে একটি তিন লেয়ারের পর্দা থাকে যার নাম Tympanic membrane বা কানের পর্দা। এটাকে আমরা বাসার ছাদের সাথে তুলনা করতে পারি। এটির বাইরের লেয়ার skin, ভিতরের লেয়ার mucous ও মধ্যের লেয়ার fibrous বা মাকড়সার জালের মত থাকে, যা বাহিরের ও ভিতরের লেয়ারকে সাপোর্ট দেয়- যেমনটা ছাদের ইঞ্জিনিয়ারিং এ আমরা মধ্যখানে রড ব্যবহার করে থাকি। মাইক্রোইয়ারসার্জারীর সাহায্যে কানের পর্দা জোড়া লাগানোকে myringoplasty বলা হয়। এই সার্জারীর মাধ্যমে মধ্যকানের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন কর্ণপ্রদাহ, কানে কম শোনা ইত্যাদির সমাধান করা হয়ে থাকে। পাকা কানে এই অপারেশন করা সম্ভব নয়। এই অপারেশনের ফলে কানে শ্রবণশক্তি বৃদ্ধি পায়, কান পাকা রোগ সম্পূর্ণরূপে দূরীভূত হয়, কান শুকনা থাকে এবং ঘন ঘন কান পাকার জন্য শ্রবণশক্তির ক্ষতি হয় না। কানের পর্দায় যদি কোন কারণে ছিদ্র হয়ে যায় (ইনফেক্‌শন, কানে চড় মারা, কটনবাড বা অন্যান্য সূচালো দ্রব্য দিয়ে খোঁচানো ইত্যাদি কারণে) তিন থেকে ৬ মাসের মধ্যে নিজ থেকে জোড়া না লাগলে অপারেশনের মাধ্যমে জোড়া লাগানোটাকে মূলতঃ myringoplasty বলা হয়। এখানে শুধুমাত্র কানের পর্দাটাকে জোড়া লাগনো হয়, মধ্যকর্ণের হাড়গুলোকে কিছু করা হয় না। যাদের ছোটবেলা থেকে কানে পুঁজ বা পানি আসার কারণে কানের পর্দায় স্থায়ীভাবে ছিদ্র থেকে যায় অথবা পরবর্তীতে accident এর কারণে পর্দা ছিদ্র হয়ে যায়, তাদের মাঝেমধ্যে কান দিয়ে পুঁজ অথবা পানি আসতে পারে এবং এক্ষেত্রে কানে কম শোনাও থাকতে পারে। বারবার ইনফেকশনের কারণে শোনার আরো অবনতি ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র কানের পর্দাটাকে জোড়া লাগিয়ে দিলেই হয়ে যায়। এতে কান স্থায়ীভাবে শুকনো থাকে এবং শোনারও কিছুটা উন্নতি হয়।
অপারেশনের আগে কি করবেন?
কানের পর্দা ছিদ্র আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে অপারেশনের পূর্বে কানটাকে পুরোপুরি শুকনো করে নিতে হবে। কমপক্ষে ০৩ (তিন) মাস শুধুমাত্র নিয়ম মেনে কান শুকনো থাকলে myringoplasty করা যায়। অনেক সময় এলার্জিজনিত কারণে কান কোনভাবে শুকায় না। সেক্ষেত্রে এলার্জি নিয়ন্ত্রণে এনে অপারেশনটি করতে হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে নাকের হাড়, নাকের পলিপ, গলায় টনসিল বা বাচ্চাদের ক্ষেত্রে adenoid এর অপারেশনটা আগে করে নিতে হবে। কানের ছিদ্র বন্ধের জন্য এই অপারেশনে সাধারণত কানের উপর থেকে temporalis fascia বা কানের সামনে tragus থেকে perichondrium বা cartilage ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আকারের উপর নির্ভর করে কানের পর্দা ছিদ্র ০৩ (তিন) প্রকার ছোট, মাঝারি এবং বড়। কানের canal এর আকার অনুযায়ী canal এর ভিতর দিয়ে, কানের পিছনে থেকে অথবা সামনের দিকে কেটে এই অপারেশনটি করা যায়। বিভিন্ন পদ্ধতির সাহায্যে এই অপরেশনটি করা হয়ে থাকে। যেমন microscope, loop অথবা endoscope এর সাহায্যেও অপারেশনটি হয়ে থাকে। এই অপারেশনে রোগীকে সম্পূর্ণ অজ্ঞান করা হয় না। শুধুমাত্র বাচ্চা কিংবা mon-cooperative রোগীদের ক্ষেত্রে অজ্ঞানের প্রয়োজন হয়। কোন কোন রোগীর দুই কানের পর্দাই ছিদ্র থাকে। সেক্ষেত্রে এক কান সম্পন্ন করার পর অন্ততপক্ষে ১ থেকে ২ মাস পর অন্য কানের অপারেশন করা যায়। সমপ্রতি কিছু স্টাডিতে দেখা গেছে, এক সাথে দুই কানের পর্দা জোড়া লাগানো সম্ভব। একটা কানের উপর থেকে একটু বেশি পরিমাণে temporalis fascia graft নিয়ে অপর কান না কেটে কানের canal ও পর্দার ছিদ্রের ভিতর দিয়ে জোড়া লাগানো সম্ভব। অপারেশন পরবর্তী কিছু বিধিনিষেধ অবশ্যই মেনে চলা দরকার। দুই/এক দিনের মধ্যে রোগী তার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারবেন। এটি একটি ডে-কেয়ার কেইস্‌। অপারেশনের পর ৬ সপ্তাহ পর্যন্ত প্লেনে ট্রাভেল করা নিষেধ।
সাধারণ সর্দি কাশিতে অপারেশনের পরবর্তীতে কোন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু প্রচন্ড সর্দি কাশি, দিনের পর দিন নাক, কান ও গলা সমপূর্ণ বন্ধ হয়ে থাকলে আবার কানে ইনফেকশন দেখা দেওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, এমনকি জোড়া লাগানো পর্দা অনেক সময় ফেটে যায়। এক্ষেত্রে রোগীর সচেতনতা অত্যন্ত জরুরি, রোগীদের খামখেয়ালীর কারণে পর্দা লাগানো কানে আবারও ইনফেক্‌শন হয়ে যেতে পারে- সেক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ অবশ্যই মানা উচিৎ। যেমন: হাঁচি কাশি না দেওয়া, জোরে নাক না ঝাড়া, এলার্জি জনিত খাদ্য-দ্রব্য পরিহার করা, ঠান্ডাজনিত পরিবেশে বেশিক্ষণ না থাকা ইত্যাদি। কানের পর্দা প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে শ্রবণশক্তি লোপ পাওয়া অনেক রোগী সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন আবারও ফিরে পায়, শব্দময় পৃথিবীতে আবারও অভিষেক ঘটে সামাজিক সুবিধা বঞ্চিত এই সব অসহায়দের। তারা ফিরে পায় নতুন হারানো পৃথিবী, শব্দ মূর্চ্ছনায় একাকার হয় অন্য সময়, অন্যখানে।
লেখক: সভাপতি-রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙামাটি, জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্য : যা মানুষের মনোজগতকে রাঙিয়ে তোলে
পরবর্তী নিবন্ধবহমান সময়