চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে মোট ১৭৩ জন প্রার্থী কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। এসব প্রার্থীদের মধ্যে ৬০ জনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলা রয়েছে। হিসেবে মোট কাউন্সিলর প্রার্থীর মাঝে ৩৪.৬৮ শতাংশ প্রার্থী মামলার আসামি। তবে এর মধ্যে ৮ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০২ ধারায় (হত্যা) মামলাও। আর ১১ জন প্রার্থী অতীতে এই ৩০২ ধারায় মামলার আসামি ছিলেন। ৭ জন মেয়র প্রার্থীর মাঝে কারো বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা নেই। তবে ৫৮ জন (নারী) সংরক্ষিত কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যেও একজন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ৩০২ ধারায় মামলা চলমান রয়েছে। গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন)। চসিক নির্বাচন-২০২১ উপলক্ষে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রার্থীদের তথ্য উপস্থাপন এবং অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্র্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের আহ্বানে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচন কমিশনে প্রার্থী কর্তৃক হলফনামায় প্রদত্ত তথ্যের ভিত্তিতে এসব তথ্য-উপাত্ত প্রস্তুত করেছে সুজন।
চট্টগ্রাম জেলা সুজন’র সভাপতি ও অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মু. সিকান্দর খানের সভাপতিত্বে সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী।
এতে আখতার কবির চৌধুরী বলেন, জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠায় সঠিক জনপ্রতিনিধি নির্বাচন তথা সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই। ভোট প্রদানে আগ্রহীরা নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে যাতে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে এবং সমগ্র নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ, কারসাজিমুক্ত ও বিশ্বাসযোগ্য করতে হবে। নির্বাচন পরিচালনার মূল দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকলেও অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের কার্যকর ভূমিকায় অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন হয়। নিকট অতীতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনসমূহে ঘটে যাওয়া ঘটনাপ্রবাহ থেকে সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করে যথোপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। সকল দল ও প্রার্থীর জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও কালো টাকা ও পেশিশক্তির প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের প্রিসাইডিং অফিসার, সহকারী প্রিসাইডিং অফিসার ও পোলিং অফিসার নিয়োগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ নির্বাচনী দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা।
সমপ্রতি অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে আঙুলের ছাপ না মেলায় কিছু কিছু ভোটারের ভোট না দিয়েই ফিরে যাওয়া, ভোটকেন্দ্রের বাইরে সরকারদলীয় কর্মী সমর্থকদের জটলা ও মহড়া, পাড়া-মহল্লা ও ভোটকেন্দ্রে সরকারদলীয় কর্মী সমর্থকদের পাহারা, বুথে প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা, একজনের ভোট আর একজন দিয়ে দেয়া, বিশেষ প্রার্থীকে ভোট দিতে চাপ সৃষ্টি করা, প্রিসাইডিং কর্মকর্তার ১%-এর ক্ষমতা থাকলেও তার চেয়ে বেশি ভোট দেয়া, প্রকৃত কাস্টিং-এর চেয়ে ভোট কাস্টিং বেশি দেখানো, বিএনপি’র এজেন্টদের ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে না দেয়া বা ভোটকেন্দ্র থেকে মারধর করে বের করে দেয়া, ইভিএম-এ হওয়া ভোটের ফলাফল মধ্যরাতের পর ঘোষণা, ফলাফল পাল্টে দেয়া ইত্যাদি অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি ভোটের মাঠে বিএনপিসহ অন্যন্য পক্ষসমূহের অনুপস্থিতিও প্রকটভাবে চোখে পড়েছিল।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়- বিভিন্ন অনিয়মের কারণে নির্বাচন ব্যবস্থার ওপর মানুষের আস্থাও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। নির্বাচনী প্রচারণার শুরু থেকেই কোনো কোনো প্রার্থী বাধাদানের অভিযোগ করে আসছেন। ইতোমধ্যে নির্বাচনের মাঠ আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। হামলা-মামলার ঘটনা এই উত্তাপকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। গত কয়েকদিনে হামলা, ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে বিএনপি’র শতাধিক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে চারটি মামলা হয়েছে। ১৪জন গ্রেফতারও হয়েছে। এসব ঘটনায় বিএনপি’র কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। প্রতিদ্বন্দ্বী কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যেও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। ঘটছে প্রাণহানির ঘটনাও। এঅবস্থায় নির্বাচনের দিন পর্যন্ত সকল প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মাঠে থাকতে পারবে কিনা, ভোটাররা কেন্দ্রমূখী হবে কি না, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ-সংশয় বাড়ছে। আমরা মনে করি, একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের প্রত্যয় নিয়ে নির্বাচন কমিশন যদি এখনই যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয়া সম্ভব। নির্বাচন কমিশনকে মনে রাখতে হবে, সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে’। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সরকারসহ নির্বাচনের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলেই নির্বাচন কমিশনের আইনানুগ নির্দেশনা মানতে বাধ্য। নির্বাচন কমিশন যদি আইনী ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, নৈতিকতা ও সাহসিকতার সাথে তার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, তাহলে অবশ্যই সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব।
আখতার কবির চৌধুরী বলেন- আমরা চাই না ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের নেতিবাচক অনুষঙ্গগুলো বা অভিযোগগুলোর পুনরাবৃত্তি এই নির্বাচনে ঘটুক। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনও ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে হচ্ছে। বুথ দখল করে একজনের ভোটের বাটন অন্য আর একজন টিপে দেয়ার ঘটনা অন্তত এই নির্বাচনে না ঘটুক। আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন, সরকার, রাজনৈতিক দল, মাননীয় মন্ত্রী ও মাননীয় সংসদ সদস্যগণ, প্রার্থী ও সমর্থক, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, গণমাধ্যম, নির্বাচন পর্যবেক্ষক, সচেতন নাগরিক এবং ভোটারগণ স্ব স্ব অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবেন। এর মাধ্যমে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করা হয় সংবাদ সম্মেলনে। মামলার আসামিদের মনোনয়ন দেয়ার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সংবাদ সম্মেলনে সুজন-চট্টগ্রামের সভাপতি প্রফেসর মুৃ. সিকান্দার খান বলেন- যাদের নামে মামলা রয়েছে, তাদের মনোনয়ন দানের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোর এসব বিষয় বিবেচনায় নেয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। কারণ, মনোনয়ন দানের জন্য দলে নিশ্চয়ই মামলাহীন দলীয় লোকজনের অভাব নেই। তবে দলগুলো মনোনয়ন দিলেও মামলার আসামিদের নির্বাচনে ভোট দেবেন কী না, সে বিবেচনাটুকু ভোটারদের। এখানে ভোটারদেরও দায়িত্ব আছে বলে আমরা মনে করি। চসিক নির্বাচনে মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীদের বার্ষিক আয়, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশাসহ বিভিন্ন তথ্য উপস্থাপন করা হয় সংবাদ সম্মেলনে।