অস্থির হয়ে উঠেছে রডের বাজার। স্ক্র্যাপ সংকটে বাড়ছে রডের দাম। সীতাকুণ্ডের শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে গড়ে ১৫ লাখ টনের মতো লোহার মজুদ থাকতো। গতকাল একেবারে সেই মজুদ এসে ঠেকেছে চার লাখ টনেরও কমে। মাস কয়েক আগে স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম ছিল টন প্রতি ২৮০ ডলার। গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে সেই একই মানের জাহাজ বিক্রি হয়েছে ৫০০ ডলারে। মাস কয়েক আগে প্রতিটন স্ক্র্যাপের দাম ছিল টন প্রতি ২৭ হাজার টাকা। গতকাল স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে প্রকারভেদে ৪৪ থেকে ৪৮ হাজার টাকা। এদিকে বিদেশ থেকে স্ক্র্যাপ আমদানিতেও দেখা দিয়েছে সংকট। প্রতিটন স্ক্র্যাপ ৫১২ ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। স্ক্র্যাপ সংকটে অস্থির লোহার বাজার। রডের দাম গিয়ে ঠেকেছে প্রতিটন প্রায় ৬৮ হাজার টাকা। ৪০ গ্রেডের রড বিক্রি হচ্ছে ৫৭ হাজার টাকা দরে। এতে দেশের সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড ব্যাহত হওয়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
সীতাকুণ্ডের ইয়ার্ডগুলোতে পুরনো জাহাজ থেকে বছরে ১৮ লাখ টনের মতো লোহা পাওয়া যায়। বাকি লোহার প্রয়োজন মেটাতে স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হয়। বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে ৪২ লাখ টনের মতো স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়। এগুলো থেকে দেশের প্রায় ৬০ লাখ টন লোহার চাহিদা মেটানো হয়। পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ শত শত প্রকল্পে দেশে উৎপাদিত রডের প্রায় ৬০ শতাংশ ব্যবহার হচ্ছে।
রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, দেশে ২০০টি স্টিল মিল রয়েছে। এরমধ্যে ৩৬টি মিল রয়েছে সর্বাধুনিক। প্রায় ৯০ লাখ টন উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন এসব কারখানা থেকে ৬০ লাখ টন রড উৎপাদন ও বাজারজাত করা হয়। বিএসআরএম, কেএসআরএম, জিপিএইচ, একেএস, গোল্ডেন ইস্পাতের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিশ্বমানের রড উৎপাদন ও বাজারজাত করছে।
গতকাল সীতাকুণ্ডের ইয়ার্ডগুলোতে প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে ৪৪ হাজার থেকে ৪৮ হাজার টাকায়। প্রতি টন প্লেট থেকে রড উৎপাদন করতে টনপ্রতি দশ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। এতে এক টন রড বিক্রি করতে হবে ৫৮ হাজার টাকায়। ৪০ গ্রেডের রড গতকাল বিক্রি হয়েছে ৫৭ হাজার টাকা দরে। ৬০ গ্রেডের দাম প্রায় ৬৭ হাজার টাকা। কয়েকদিন আগেও ৬০ গ্রেডের রড বিক্রি হয়েছে ৬২ হাজার ৫শ’ টাকায়। গতকাল তা ৬৭ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে ফ্যাক্টরীতে। দোকানে দোকানে রডের দাম ৬৮ হাজার টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
জানা যায়-ইউরোপ-আমেরিকার যেসব দেশ থেকে বেশি স্ক্র্যাপ আসতো করোনায় স্ক্র্যাপ পাওয়ার এসব উৎস কমে গেছে। বাড়িঘর ভাঙ্গা হচ্ছে না। পুরনো গাড়ি রেখে দেয়া হচ্ছে। অন্যদিকে চীনও স্ক্র্যাপ আমদানি শুরু করেছে। এতে সংকট তীব্র হয়েছে।
গতকাল বিএসআরএম স্টিলের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমাদের রড বিক্রি হয়েছে ৬৭ হাজার ৫শ’ টাকা দরে। স্ক্র্যাপ সংকট প্রকট হওয়ায় দাম বাড়ছে। তিনি স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম টন প্রতি ৫০০ ডলারে ঠেকেছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন-করোনার আগে আমাদের রডের দাম ছিল প্রতি টন ৬৮ হাজার টাকা। তখন স্ক্র্যাপের দাম ৩০০ ডলারের নিচে ছিল। ২৬/২৭ হাজার টাকার স্ক্র্যাপ ৪৮ হাজার টাকায় ঠেকেছে। ২৮০ ডলারের স্ক্র্যাপ জাহাজ ৫০০ ডলারের বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এর প্রভাব রডের বাজারে পড়েছে । তিনি বলেন, দাম বাড়লেও আমাদের উৎপাদন ঠিকভাবে চলছে। রড বিক্রিও স্বাভাবিক রয়েছে।
জিপিএইচ ইস্পাতের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, শনিবার স্ক্র্যাপের ব্যাপারে ৫০৯ ডলারে কথা বলেছিলাম। কিন্তু কনফার্ম করার জন্য ঘন্টা দুয়েক সময় চেয়েছিলাম। রোববার সকালে ওখানে বন্ধ। তবুও কথা বললাম। কিন্তু তারা বললো, ৫০৯ ডলার দরে আর দিতে পারবে না। সোমবারে ৫১২ ডলারে দিতে পারবে। ৩০০ ডলারেরও কমে যে স্ক্র্যাপ তা যদি ৫১২ ডলারে কিনতে হয় তাহলে রড উৎপাদন করে বাজারজাত করা অনেক কঠিন হবে। গতকাল জিপিএইচ কারখানায় প্রতি টন ৬৭ হাজার টাকা দরে বিক্রি হয়েছে বলেও তিনি জানান। আলমাস শিমুল বলেন, আসলে বাজার এত অস্থির যে আমরা কিছুই আগাম বলতে পারছি না। টাকা দিয়েও স্ক্র্যাপ না পাওয়ার এমন পরিস্থিতি একেবারে নজিরবিহীন।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও কেএসআরএম উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত গতকাল দৈনিক আজাদীকে বলেন, স্ক্র্যাপের এমন সংকট অতীতে দেখেনি। কোথাও স্ক্র্যাপ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পুরো খাতই অস্থির হয়ে উঠেছে। আমাদের স্ক্র্যাপের মজুদ পর্যাপ্ত নয়, কতদিন চালাতে পারবো তাও অনিশ্চিত। ৩০০ ডলারেরও কমে যেই স্ক্র্যাপ কিনতাম তা এখন কিনতে হচ্ছে ৫৩০ ডলারে। তাও পাওয়া যাচ্ছে না। স্ক্র্যাপের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে রডের দাম বাড়াতে বাধ্য হচ্ছি। তিনি বলেন, আমরা আজ ৬৮ হাজার টাকা দরে রড বিক্রি করেছি। এই দরেও কতদিন বিক্রি করতে পারবো ঠিক নেই। আসলেই কিছুই ঠিক নেই। দেশের স্টিল সেক্টর এক অস্থির সময় পার করছে।