শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডে কাটার জন্য আমদানিকৃত স্ক্র্যাপ জাহাজের দাম কয়েক মাস আগে ছিল টনপ্রতি ২৮০ ডলার। গতকাল আন্তর্জাতিক বাজারে একই মানের স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে ৪০৭ ডলারে। টনপ্রতি বেড়ে গেছে ১০ হাজার টাকা। এদিকে কয়েক মাস আগে সিঙ্গাপুর থেকে কিনে আনা জাহাজ সীতাকুণ্ডের শিপইয়ার্ডে স্ক্র্যাপ করে বিক্রি করা হয় টনপ্রতি ২৭ হাজার টাকা। গতকাল বিক্রি হয়েছে টনপ্রতি ৪০ হাজার ২০০ টাকায়। প্লেট বিক্রি হচ্ছিল ৪৮ হাজার টাকা দরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারীতে স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি না হওয়ায় রড তৈরির কাঁচামালের সংকট তৈরি হয়েছে। এতে প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকার বাজারে বিরাজ করছে অস্থিরতা।
সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীরা জানান, স্টিল সেক্টরের পুরোটা আমদানি নির্ভর। বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা পুরনো জাহাজ ও স্ক্র্যাপ ব্যবহার করে রড তৈরি করা হয়। পুরনো জাহাজ বা শিপইয়ার্ড থেকে বছরে সর্বোচ্চ ১৮ লাখ টনের মতো স্ক্র্যাপ ও প্লেট পাওয়া যায়। বাকি স্ক্র্যাপ আমদানি করতে হয়। বিশ্বের নানা দেশ থেকে বছরে ৪২ লাখ টন স্ক্র্যাপ আমদানি করা হয়। বর্তমানে দেশে মাথাপিছু লোহার ব্যবহার প্রায় ৩৮ কেজি। দিন দিন লোহার ব্যবহার বাড়ছে। এক সময় দেশের মোট ব্যবহৃত লোহার ৫ থেকে ১০ শতাংশ সরকারিভাবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমানে ৬০ শতাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। পদ্মা সেতু, কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, ঢাকার মেট্রো রেলসহ ১১টি মেগা প্রকল্পসহ শত শত প্রকল্পে দেশের উৎপাদিত রড ব্যবহার করছে। দেশে বর্তমানে ২০০টির মতো স্টিল মিল রয়েছে। এর মধ্যে ৩৬টি মিল সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রড উৎপাদন করে। প্রায় ৯০ লাখ টন রডের উৎপাদনক্ষমতা সম্পন্ন এসব কারখানা বর্তমানে ৫৫ থেকে ৬০ লাখ টন রড উৎপাদন এবং বাজারজাত করে। কিন্তু করোনার কারণে কাঁচামালের সংকট বেড়েছে। এতে রড উৎপাদনে সংকট তৈরি হয়েছে। সীতাকুণ্ডের দক্ষিণাঞ্চলে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ড দেশের স্টিল সেক্টরে বিপুল পরিমাণ স্ক্র্যাপের যোগান দেয়। তবে করোনাকালে তাতে ধস নেমেছে। করোনার কারণে জাহাজ আমদানি কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে বিশ লাখ টন লোহার মজুদ থাকে, সেখানে গতকালের হিসেবে ইয়ার্ডগুলোতে সর্বোচ্চ চার লাখ টনের মতো স্ক্র্যাপ ও প্লেট ছিল। ইয়ার্ডগুলোতে উল্লেখ করার মতো জাহাজ নেই। আন্তর্জাতিক বাজারে জাহাজের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় শিপইয়ার্ডের মালিকরা জাহাজ কেনা থেকে বিরত রয়েছেন।
একাধিক জাহাজ মালিক গতকাল বলেন, করোনাকালে মাস তিনেক আগেও প্রতি টন ২৮০ ডলার দরে জাহাজ বিক্রি হয়েছে। গতকাল তা বিক্রি হয়েছে ৪০৭ ডলারে। তা-ও জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না।
কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, এত দাম দিয়ে জাহাজ কিনে তা কেটে বিক্রি করতে হলে স্ক্র্যাপের দাম অনেক বাড়বে। তাতে রড উৎপাদন করে বিক্রি করা অসম্ভব। গতকাল শিপইয়ার্ডগুলোতে প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ২০০ টাকা দরে। প্লেট বিক্রি হয়েছে ৪৮ হাজার টাকায়। প্রতি টন প্লেট থেকে রড উৎপাদন করতে টনপ্রতি দশ হাজার টাকার বেশি খরচ হয়। এতে এক টন রড বিক্রি করতে হবে ৫৮ হাজার টাকারও বেশি দরে। ৪০ গ্রেডের রডের এই দাম বিক্রি করা অসম্ভব বলে একাধিক ব্যবসায়ী জানান। গতকাল ৪০ গ্রেডের রড টনপ্রতি ৫৪ হাজার টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে। বর্তমানে জাহাজ কিনে এনে লোহা বা স্ক্র্যাপ নিয়ে রড উৎপাদন করে বিক্রি করতে হলে এই দর আরো বাড়াতে হবে বলে মালিকরা জানিয়েছেন।
বিএসআরএম স্টিলের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেনগুপ্ত আজাদীকে বলেন, আজ (গতকাল) আমাদের রড বিক্রি হয়েছে ৬২ হাজার ৫শ টাকা দরে। দাম কিছুটা বেড়েছে। তবে তা করোনা শুরু হওয়ার আগের অবস্থা থেকে কম। তিনি বলেন, মার্চে যখন করোনা শুরু হয় তখন আমাদের রডের দাম ছিল টন ৬৩ হাজার টাকা। করোনাকালে চাহিদা কমে গিয়েছিল। কমে গিয়েছিল স্ক্র্যাপের দাম। ২৬ হাজার টাকায় স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে; যা আজ বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার ৫শ টাকায়। এর প্রভাব রডের বাজারে পড়বে। তবে এখনো বিএসআরএমের রডের দাম আগের অবস্থায় পৌঁছেনি বলে দাবি করেন তিনি।
জিপিএইচ ইস্পাতের উপ ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমাস শিমুল আজাদীকে বলেন, স্ক্র্যাপসহ কাঁচামালের তীব্র সংকট চলছে। ৬০ হাজার টাকা দরে রড বিক্রির কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, এই দরেও রড বিক্রি সম্ভব হবে না। কাঁচামালের যোগান যদি না থাকে তাহলে রড উৎপাদন করব কিভাবে? স্ক্র্যাপসহ কাঁচামালের যোগান সীমিত হওয়ায় পরিস্থিতি মিল মালিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে।
কেএসআরএমের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত আজাদীকে বলেন, বিশ্বে স্ক্র্যাপ লোহার তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে করে পুরো খাতই অস্থির। তিনি জানান, স্ক্র্যাপের দাম বেড়ে গেছে টনপ্রতি অন্তত দশ হাজার টাকা।
তিনি বলেন, আমরা আজ (গতকাল) ৬২ হাজার টাকা দরে রড বিক্রি করেছি। এটি করোনা শুরুর আগের দর। গত মার্চে এই দরে রড বিক্রি করতাম। করোনার সময় তা কমে ৫২ হাজার টাকা হয়েছিল। এখন স্ক্র্যাপের দাম বাড়ার পাশাপাশি চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় রডের দাম বেড়েছে। স্ক্র্যাপ সহজলভ্য না হলে এই সংকট কাটবে না।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে রডের বাজার প্রায় ত্রিশ হাজার কোটি টাকার। শীত মৌসুমে ব্যাপক হারে উন্নয়ন কাজ চলে। এই সময় রডের ব্যবহার বাড়ে। রডের বাজার অস্থির হওয়ায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা করছেন তারা।