জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করার অনেক উপায় আছে। তবে জনসম্পদে পরিণত করার সহজ উপায় হলো শিক্ষা। শিক্ষার মাধ্যমে মানুষ কর্ম উপযোগী হয়ে ওঠে। অফিস আদালত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতা বিবেচনা করা হয়। যদিওবা এসব চাকরির কাজের ধরণ শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে খুব একটা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তারপরও কর্তৃপক্ষ একটা মাপকাঠি বিবেচনা করে পরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই বাছাই করে নিয়োগ প্রদান করে থাকে। এর বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠীর যারা সরাসরি কাজের সাথে যুক্ত তাদের বেশির ভাগের তেমন কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতা থাকে না। তারা কোন না কোনভাবে যে কোন কাজের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। কাজ ছাড়া তাদের একদিনও চলে না। কাজের মধ্য দিয়ে তাদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ হয়। তাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বা প্রশিক্ষণ কোনটাই থাকে না। তারপরও তারা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিরাট অবদান রাখে। যদিওবা তাদের হিসাব কেউ রাখে না। এরাও শ্রমজীবী মানুষের অন্তর্ভুক্ত।
শ্রমজীবী মানুষের বেশির ভাগই শিক্ষার সুযোগ পায় না। এমনকি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষাও পায় না। জনগোষ্ঠির বড় একটি অংশ শ্রমজীবী। অর্থনীতিতে তাদের অবদান কোন অংশে কম নয়। বিশেষ করে কৃষির মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে যারা কাজ করে তাদের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানিক শিক্ষা পায় না। মিল কারখানায় শ্রমিকেরাও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। গার্মেন্টস সেক্টরেও ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষেরাই শিল্প প্রতিষ্ঠানের মূল চালিকা শক্তি। কৃষির কাজটা কৃষক ভালো করে জানে। কল কারখানার শ্রমিক নিজের কাজটার জন্য উপযোগী। একইভাবে গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত শ্রমিকেরা তাদের কাজের দক্ষতা দিয়ে প্রতিযোগিতামূলক এ খাতটিকে টিকিয়ে রেখেছে। শিল্প কল কারখানা গার্মেন্টস এসব সেক্টর পরিচালিত হয় শিক্ষিত জনবলের মাধ্যমে। অর্থাৎ শ্রমজীবীদেরকে শিক্ষিত বা প্রশিক্ষিত জনগোষ্ঠি পরিচালিত করে। তবে কৃষিক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম। এখানে কৃষক তার কৃষিতে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগায়। তারপরও আধুনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদের জন্য শিক্ষিত জনগোষ্ঠির প্রয়োজন। অধিকতর ফসল উৎপাদন, রোগ মাড়াই ও বিনষ্টকরণ থেকে ফসল রক্ষার জন্য শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।
কৃষি সবচেয়ে পুরানো খাত। অনেকে আদি খাতও বলে থাকে। এ দেশের বেশির ভাগ মানুষই এক সময়ে কৃষির সাথে সম্পৃক্ত ছিল। অর্থাৎ কৃষি কাজই ছিল মানুষের অন্যতম পেশা। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে পাঠ্য বই রয়েছে। শিক্ষার্থীরা যেন কৃষি সম্পর্কে সার্বিক ধারণা পায় সে বিষয়ে বইগুলোতে পাঠ্যসূচি রয়েছে। শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকেরা কৃষির নানা দিক ছাত্র–ছাত্রীদের কাছে তুলে ধরে। পরীক্ষায়ও তারা ভালো নম্বর পায়। সহজে পাশ করে যায়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তেমন কেউ কৃষি কাজ করতে পারে না। অথচ গ্রামে গঞ্জের স্কুলের পাশেই ফসলি জমি থাকে যেখানে চাষাবাদ হয়। আবার যে ছেলেটি স্কুলে আসে না সে কৃষি কাজকে অনায়াসে আয়ত্ত করে ফেলে। হয়তো তার বাবা বা ভাইয়ের সাথে এ কাজটা করে থাকে। কৃষিতে যারা ডিগ্রি নেয় তারাও খুব ভালো চাষ দিতে পারে না। শিক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ম পদ্ধতি শেখানো হয়। বিশেষ করে আধুনিক ও যুগোপযোগী কৃষি ব্যবস্থা সম্পর্ক শিক্ষা দেয় হয়। কিন্তু তারা প্রচলিত কৃষিশ্রমিক ছাড়া কৃষিকাজ সম্পন্ন করতে পারে না। করলেও একেবারে সীমিত আকারে। যা কৃষিজ উৎপাদনে তেমন কোন প্রভাব ফেলতে পারে না।
মৎস্য খাতও কৃষির অর্ন্তভূক্ত। খাল বিল হাওড়ের পাশাপাশি পুকুরের মাছ আমিষের চাহিদা মেটাতো। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে মাছের চাহিদাও ব্যাপক হারে বেড়ে যায়। আবার খাল বিলে আগের মতো মাছ পাওয়া যায় না। তার কারণ অনেক। আমিষের চাহিদা মেটাতে এদিকে পুকুরে মাছ চাষ শুরু হয়। পুকুরে মাছের পোনা ছেড়ে এদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। এতে করে এক বছর বা দেড় বছর পরে যে ওজনের মাছ পাওয়া যেতো তা ছয় মাসে পাওয়া যায়। মাছের চাষে সহজে লাভবান হওয়া যায়। পুকুরে জলাশয়ে ব্যাপকভাবে মাছের চাষ শুরু হয়ে যায়। বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর আমিষের চাহিদা পূরণ সম্ভব হয়। মাছের চাষেও কৃষি কাজের মতো দেখে শুনে শেখা এমন লোকজনের অধিক্য বিরাজ করে। প্রশিক্ষিত লোকজনের চেয়ে যারা উদ্যোগী উদ্যমী তারা আরও বেশি এগিয়ে চলতে পারে। স্বল্প পুঁজিতে মৎস্য চাষ করা যায়। এজন্য মৎস্য চাষে অনেকে আগ্রহী হয়। পুকুরে মাছ চাষ অনেকটা সহজ। পোনা ছেড়ে সময় মতো খাবার দিলে হয়ে যায়। কয়েক মাসের মধ্যে পোনা বড় হয়ে খাওয়ার উপযোগী হয়ে যায়। গ্রামে গঞ্জে প্রায় পুকুরে এখন মাছের চাষ হয়। স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত বেকার যুবকেরা অনেকে মৎস্য চাষ করে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার চেষ্টা করে। এতে করে এসব যুবকেরা স্বাবলম্বী হয়ে উঠার সুযোগ পায়।
গৃহস্থালী একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কাজ। দৈনন্দিন কাজের মধ্যে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। এমন কোন পরিবার নেই যারা এ কাজের সাথে যুক্ত নয়। বিশেষ করে নারীরা এ কাজ অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করে থাকে। গ্রামীণ জনপদে গৃহস্থালী কাজের ধরন অনেক বিস্তৃত। গ্রামের প্রতিটি ঘরে গৃহস্থালী কাজে মেয়েরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাড়ির আশে পাশে ঘরের পেছনে বা আঙিনায় ফলমূলের গাছ লাগানো থেকে শুরু করে পরিচর্যা সবকিছু মেয়েরা করে থাকে। পরিবারের তরিতরকারি শাকসবজি নিজেরাই উৎপন্ন করে থাকে। হাঁস মুরগি পালায় না যে এমন ঘর নেই। এদের ঠিকমত খাওয়ানো, ঘর থেকে ছেড়ে দেয়া, আবার ঘরে ফিরিয়ে আনা এসব কাজ মেয়েরা করে থাকে। গরু ছাগলও পালায় অনেক পরিবার। বিশেষ করে একটা গাভী অনেকে রাখে। গ্রামীণ নারীরা অর্থনীতিতে পরোক্ষভাবে বড় অবদান রাখে।
ঘর গেরাস্থালি ছাড়াও রান্না বান্নার কাজটা নারীরা করে থাকে। রান্না বান্নাটা অনেক বড় কাজ এটা ছাড়া পরিবার অচল। কিন্তু এ কাজটার জন্য নারীরা কোন মূল্য পায় না। এমনকি সম্মানও পায় না। এটা যেন বিনা পারিশ্রমিকের কাজ। এর যেন কোন ধরনের বিনিময় মূল্য নেই। কাজের স্বীকৃতিও নেই, আছে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য। শহরে বুয়ারা কাজ করলে তার বেতন নির্ধারিত হয়। গ্রামে এখনো সেরকম বুয়া পদ্ধতি চালু হয়নি। আশে পাশের গরীব মেয়েরা এসে কাজ করে দিলে তাদের কিছু টাকা দেয়া হয়। প্রায় সর্বত্র গ্রামে কি শহরে রান্না বান্নার সব কাজ করে নারীরা। বাড়ি ঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার কাজটাও মেয়েরা করে থাকে। দিনে অন্তত এ কাজটা একবার করতে হয়। ঘর মোছা হাড়ি পাতিল বাসন কোসন ডেক্সি ধোয়া এ ধরনের বহু কাজ মেয়েদের করতে হয়। এসব কাজের কোন বিনিময় কেউ হিসাব করে না। এমনকি কাজও বলে মনে করে না। ডমেস্টিক অর্থনীতিতে এসবের প্রভাব কোন অংশে কম নয়। তবে এসব কাজ করতে তাদের কোন শিক্ষা নিতে হয় না। ঘরের মাঝেই করতে করতে তাদের প্রশিক্ষণ হয়ে যায়।
রান্না বান্নার জন্য শহর অঞ্চলে কোথাও কোথাও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে যারা রান্না শিখে তারা সখের বশে রান্না করে থাকে। ঘরের মধ্যে দৈনন্দিন যে রান্না হয় তা আর সেভাবে পারে না। কোন মেহমান আসলে সেখানে একটা বিশেষ আইটেম তৈরি করে। প্রতিদিন যে রান্না হয় তা ঘর থেকে শিখতে হয়। স্কুলেও মেয়েদের রান্না শিখানোর কিছু পাঠ রয়েছে। শারীরিক শিক্ষার গার্হস্থ্য বিজ্ঞানের মতো রান্না বান্না সম্পর্কে ধারণা দেয়া হয়। গার্হস্থ্য বিজ্ঞান পড়ে মেয়েরা তেমন স্বাস্থ্য সচেতন হয় না। পড়ার জন্য পড়া, পরীক্ষা পাশের জন্য পড়া। ঠিক একইভাবে স্কুলে রান্না বান্নার পাঠ নিয়েও এরা কিছু শিখতে পারে না। ঘর থেকে তাদেরকে নানা রকম খাবার রান্না করে নিয়ে স্কুলে শিক্ষকদের খাওয়াতে হয়। এতে তারা ভালো নম্বর পেয়ে যায়। ঘরের রান্নাটি নিশ্চয় শিক্ষার্থীর মা করে দেয়। অর্থাৎ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণে কিছু সুযোগ থাকলেও তা মেয়েদেরকে কাজ করার মতো উপযোগী করে তোলে না। এসব বিষয়ে কর্মমুখী শিক্ষা ছাড়া শিক্ষার্থীদেরকে যথাপযুক্তভাবে গড়ে তোলা যায় না।
শিক্ষার মধ্য দিয়ে তারা কর্ম উপযোগী হতে না পারলে এ শিক্ষা তাদের তেমন কাজে আসে না। শিক্ষা গ্রহণ করে তারা আবার যেন তেন কাজে যোগ দিতে পারে না। কাজ কাজই, কোন কাজই ছোট না– এ ধরনের মানসিকতা এখনো গড়ে ওঠেনি। তার চেয়ে বড় কথা যে কাজটা করুক না কেন, কাজটা কীভাবে করতে হয় তা ভালো করে না জানলে মান সম্পন্ন কাজ পাওয়া যায় না। এজন্য যে কোন ধরনের কাজ করতে হলে কাজটা আগে হাতে কলমে শিখতে হয়। প্রাথমিকভাবে জানলে তাকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে কাজের সম্পর্ক না থাকলে প্রশিক্ষণে খুব একটা ফলাফল পাওয়া যায় না। এজন্য শিক্ষার্থীদের কাজের উপযোগী করে গড়তে হলে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এছাড়া শিক্ষার সুফল কখনো কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলিত হবে না। অর্থাৎ শিক্ষার সাথে কাজের সম্পর্ক গতে তুলতে হবে। কর্মবিহীন শিক্ষা শুধু বেকারত্বকে বাড়িয়ে দেবে।
লেখক : কথাসাহিত্যিক ও ব্যাংক নির্বাহী