চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে এখনো আতঙ্কের নাম অনলাইন জুয়া আর ক্যাসিনো। ভয়ঙ্কর এ জুয়ায় আসক্ত হয়ে পড়েছে কর্ণফুলীর শত শত তরুণ। নেশা ধরা এই ক্রিকেট-ফুটবল জুয়ায় জড়িয়ে প্রতিদিন হাজার থেকে লাখ লাখ টাকা খুঁইয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন অনেক তরুণ। আবার অনেকেই অল্প বয়সে কোটিপতি হয়ে জুয়ার টাকায় ঘুরছেন দেশ-বিদেশ।
হাতের মুঠোফোনে সর্বনাশা ক্রিকেট ও ফুটবল জুয়া এবং ইন্টারনেট বাজি খেলছে তারা। এসব উঠতি তরুণেরা কখনো কখনো জড়িয়ে পড়ছে চুরি, খুন খারাবি ও ভূমিদস্যুতার মতো ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ডেও। জুয়ার আসরে একাধিক মারামারির ঘটনাও ঘটেছে কর্ণফুলীতে।
ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এ জুয়া খেলা হচ্ছে বিধায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরাও সক্রিয়ভাবে কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না। ফলে, দিন দিন চক্রবৃদ্ধিহারে আশঙ্কাজনকভাবে বাড়ছে জুয়াড়িদের সংখ্যা। অনেক ভালো ঘরের ছেলেরাও জড়িয়ে পড়ছে এমন জুয়ার নেশায়। এতে তাদের সংসারে বাড়ছে অশান্তি। প্রায়শই এ নিয়ে জুয়াড়িদের মধ্যে হচ্ছে হাতাহাতি-মারামারি।
একাধিক সূত্র জানায়, কর্ণফুলীর শিকলবাহা বোর্ড স্কুলের সামনের মাঠ, শিকলবাহা মুন্নার দোকান, শিকলবাহা মন্নানের দোকান, কলেজ বাজারের বিল, আশিকের পানের দোকান, ইছানগরের বিএফডিসি গেইট, শিকলবাহা আমশা পাড়া মসজিদ রোড, কর্ণফুলী ঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, চরপাথরঘাটা তোতারবাপের হাট, আয়ুব বিবি কলেজ রোডের মেম্বার গলি, জুলধা মাতব্বর ঘাট, জুলধা পাইপের ঘোড়া বাজার, ফকিরন্নিহাট বাজারসহ একাধিক স্পটে এখনো প্রকাশ্যে চলছে অনলাইন জুয়া।
আর এ চক্রের প্রায় বেশির ভাগ সদস্যই শিকলবাহা ২ ও ৩ ওয়ার্ডের। রয়েছে চরলক্ষ্যা ও চরপাথরঘাটার ইছানগরের একাধিক জুয়াড়ি। যাদের এ টাকার কোন নির্ভরযোগ্য উৎস নেই। কিন্তু চাল চলনে ভিআইপি। স্থানীয়দের ভাষায় আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ। জানা যায়, বেটিং পরিচালনার এসব অর্থের লেনদেন করা হয় মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে (ই-ট্রানজেকশন)। কিন্তু এরা কখনো গ্রেপ্তার হননি। তাদের বিরুদ্ধে কোন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা মানি লন্ডারিংয়ের মামলা নেই। ফলে, বেপরোয়া।
এসব জুয়াড়িরা অনলাইন অ্যাপসে রাতে কিংবা দিনে সেফ জোনে দলবদ্ধভাবে বসে খেলছে জুয়া। নিষিদ্ধ এসব সাইটের অধিকাংশ পরিচালনা করা হচ্ছে দুবাই, রাশিয়া, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ থেকে। বিদেশ থেকে পরিচালিত এসব সাইট পরিচালনা করছেন দেশের এজেন্টরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনলাইন জুয়াড়িরা জানান, দেশে এই মুহূর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় অনলাইন জুয়ার সাইট ওয়ানএক্সবেট। এছাড়া বেটউইনার, বেট৩৬৫, মেলবেট, প্যারিম্যাচ সাইটও বেশ জনপ্রিয়। এগুলোর বিজ্ঞাপন নিয়মিত দেওয়া হয় ফেসবুকে। দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত এ সাইটগুলোতে ফুটবল, ক্রিকেটসহ বিভিন্ন খেলা নিয়ে বাজি ধরা যায়।
ক্রিকেটে প্রতি বলে বলে, ম্যাচের প্রথম ওভারের প্রথম বলে, প্রতি ওভারে, প্রতি ম্যাচের প্রথম ছয় ওভার, পরবর্তী ওভারে উইকেট যাবে কি না ও কোন দল জিতবে এমন করে জুয়ার ক্যাটাগরি সাজানো। এসব সাইট মূলত রাশিয়াকেন্দ্রিক। তবে ভারত ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকেও এগুলো নিয়ন্ত্রিত হয়। কিছু দেশি সাইটও রয়েছে।
অবাক করা বিষয়-রাশিয়া থেকে পরিচালিত জুয়ার সাইট বেটউইনার ও ওয়ানএক্সবেটসহ একাধিক সাইটে লেনদেনের জন্য মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশ, নগদ, রকেট ও উপায় যুক্ত। এছাড়া রয়েছে ব্যাংকের মাধ্যমেও পেমেন্ট করার সুযোগ। ৬টি ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে লেনদেন করা যায় এসব সাইটে। এমন তথ্য অনেকের।
জানা গেছে, এটি নেশার মতো। খেলতে শুরু করলে যতক্ষণ টাকা থাকে ততক্ষণ পর্যন্ত খেলতে ইচ্ছা করে। টাকা শেষ হলে আবারও টাকা ইনভেস্ট করে খেলা শুরু করতে ইচ্ছা হয়। কারণ জুয়া একটা নেশা।
তথ্য বলছে, অনলাইন ক্যাসিনোর মালিক কারা বা কোথা থেকে পরিচালিত হচ্ছে, সে বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে কোনো তথ্য নেই। এসব অ্যাপের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কারিগরি সক্ষমতার অভাব রয়েছে নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষের। তারা বলছে, বিদেশ থেকে অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালিত হওয়ায় এগুলো ঠেকানো সহজ নয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মোবাইল ব্যাংকিং খাতে দেশে নিবন্ধিত গ্রাহকের সংখ্যা ১১ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৩৩০। বর্তমানে আরো বেশি। জাতীয় বাজেটের দেড় গুণের বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে।
জুয়ার সাইট বন্ধ করেও মিলছে না সমাধান বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নির্দেশে ২০১৯ সালে বন্ধ করা হয় অনলাইনে জুয়া খেলার ১৭৬টি সাইট। এরপর সরকারের নির্দেশে ৩৩১টি অনলাইন জুয়ার সাইট বন্ধ করে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা সেল’।
এ বিষয়ে কর্ণফুলী থানার ওসি তদন্ত মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমাদের যেমন দায়িত্ব আছে তেমন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে অভিভাবকদেরও। তাঁদের সন্তানেরা কি করছে, না করছে, কোথায় যাচ্ছে, না যাচ্ছে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। কোনো অনৈতিক পথে পা বাড়ালে তাঁদের শাসন করতে হবে। ইতিমধ্যে আমাদের মোবাইল টিম আইপিএল জুয়াসহ অন্যান্য জুয়া বন্ধে কাজ করছে।’
চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের বন্দর জোনের ডিসি মোহাম্মদ আলী হোসেন বলছেন, ‘চক্রের সদস্যরা গ্রাহক জোগাড় করে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জুয়ার আসরের অবৈধ অর্থের লেনদেন করেন। আমরা নজরধারি চালাচ্ছি। শিগগিরই অভিযান চালানো হবে।’
সিএমপির কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের (সিটিটিসি) ইন্সপেক্টর সঞ্জয় দত্ত জানান, ‘সংঘবদ্ধ দেশি-বিদেশি প্রতারকচক্র বিভিন্ন ভার্চুয়াল কারেন্সি এবং পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবহার করে অনলাইন জুয়া পরিচালনা করে। তারা পেমেন্ট গেটওয়ে মেলবেট ও লাইনবেট-এর সরাসরি এজেন্ট। তারা মূলত মোবাইল ব্যাংকিং ও ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে অবৈধ অর্থের লেনদেন (ই-ট্রানজেকশন) করে।’
ক্রাইম ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি) পুলিশের ইন্সপেক্টর মোহাম্মদ হোসাইন শাজিন বলেন, ‘বেটউইনার মূলত অ্যাপসভিত্তিক একটি অনলাইন বেটিং (জুয়া) সাইট। রাশিয়া থেকে এটি পরিচালিত হয়। স্পোর্টস, বেটিং ও ক্যাসিনোর জন্য এটি বিখ্যাত। দেশের জুয়াড়িদের অন্যতম জনপ্রিয় ওয়েবসাইট এটি। মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ব্যবহার করে অনলাইন গ্যাম্বলারদের (জুয়াড়ি) সঙ্গে জুয়ার টাকা লেনদেন করে। পরে এসব টাকা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (বিন্যান্স মাধ্যম) রূপান্তর করে রাশিয়ায় পাচার করে।’
সিএমপি বন্দর জোনের উপ পুলিশ কমিশনার (ডিসি) শাকিলা সোলতানা বলেন, ‘অ্যাপে জুয়ার ফাঁদ যে শুধু শহরকেন্দ্রিক তা নয়। শহর ছাপিয়ে তা এখন আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে। অতি লোভে জুয়ার ফাঁদে পা দিয়ে সর্বস্ব হারাচ্ছে সাধারণ মানুষ। অনলাইনে জুয়া পরিচালনাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’