চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনীতির স্নায়ুকেন্দ্র। দেশ ও জাতির সমৃদ্ধির ভরকেন্দ্রও চট্টগ্রাম। দেশের সুস্থ ও সবল অর্থনীতির কথা উঠলেই চট্টগ্রামের নাম সবার আগে মুখে মুখে ঘোরে। স্বাভাবিক, জাতীয় বা স্থানীয় নেতৃত্ব, কর্পোরেট বডি, অর্থনীতিবিদ, সুশীল, মিডিয়া, বিশেষায়িত পেশাজীবি সবখানেই চট্টগ্রামের অবস্থান ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা বিস্তর। বন্দরের সক্ষমতা ও গতি বিশ্বমানে তুলে আনতে কারো আগ্রহের খামতি নেই বরং আকাঙ্ক্ষাটা তীব্র। তবুও কোথায় যেন অদৃশ্য বাধার দেয়াল! বৈশ্বিক কর্পোরেট বাণিজ্যিক জোয়ারটা সমুদ্র পথ তথা পরিবহন ঘিরেই আবর্তিত। কারণ সমুদ্র পথে অতিকায় জাহাজে এক সাথে হাজার হাজার মেট্রিক টন মালামাল পরিবহন সম্ভব। এতে পরিবহন খরচ যেমন সাশ্রয় হয়, তেমনি অনেকটা নিরাপদে পণ্য পরিবহন সম্ভব। স্বাভাবিক কারণে বৈশ্বিক বাণিজ্যের ৮০% এর বেশি সমুদ্র পথে পরিবাহিত হয়। চট্টগ্রাম বন্দর হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী সমুদ্র বন্দর। কর্ণফুলী তীরে গড়ে উঠা বন্দরটি এক সময় বিশ্ব বাণিজ্যের কেন্দ্রে ছিল। বিদেশি বেনিয়া দখলদাররা চট্টগ্রামকে সবার আগে বেছে নিত বাণিজ্য ও ঔপনিবেশিক দখল বিস্তারের কাজে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সুবর্ণ ইতিহাস সবার জানা। কিন্তু এরমাঝে চট্টগ্রাম বন্দর বৈশ্বিক বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারিয়ে শীর্ষ থেকে অবস্থান অনেক নিচে নেমে গেছে। নতুন গড়ে উঠা সিঙ্গাপুরের মাদার ভেজেলের ফিডার সার্ভিস সেবায় বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর। কলম্বোসহ পাশের দেশগুলোর সব বন্দর গতি ও সেবায় চট্টগ্রামের অনেক উপরে। বন্দর অবনমনের মূল কারণ কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা সঙ্কট। কর্ণফুলী দিনে দিনে ভরাট হওয়ার পাশাপাশি দখল, বেদখলে প্রশস্ততা অর্ধেকে নেমে গেছে। একদিকে মামলা জট ও প্রভাবশালীর দখল ঠেকানো সম্ভব হচ্ছেইনা। অন্যদিকে জোয়ারের পলি জমে নদীর ছোট্ট বুকেও জাগছে অসংখ্য ছোট বড় চর। ফলে ৭/ ৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজও বন্দরে ভিড়তে পারেনা। বে- টার্মিনালসহ কিছু সাাপোর্ট স্থাপনা করে জাহাজের চাপ ও জট সামালের কাজ চললেও তা স্থায়ী সমাধান নয়। এরশাদ আমলে দ্বিতীয় কর্ণফুলী সেতু চালু হয়। কিন্তু সেতুর বড় বড় পিলার ঘিরে জোয়ারের পলি আটকে সেতুর ভাটিতে বড় বড় চর তৈরি হয় দ্রুত। এতে নদীর নাব্যতার পাশাপাশি বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম গতি হারায়। বেশ ক’বছর এভাবেই চলে বন্দর। ক্যাপিটাল ড্রেজিংএ শত শত কোটি টাকা খরচ করে নদীর তলের পলি ও বালি অপসারণ করা হলেও আবার তা দ্বিগুণ দ্রুততায় ভরে যায়। আবার ড্রেজিংর নামে চলে বালি বিক্রি ও নদী ভরাটের নতুন ব্যবসা ও অনিয়ম। বেগম জিয়ার আমলে চালু হয় তৃতীয় কর্ণফুলী শাহ আমানত সেতু। পিলার সেতুর বদলে নদীর নাব্যতা সুরক্ষায় ভাসমান বা ঝুলন্ত সেতু গড়ার দাবিতে তদানিন্তন সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাঁর এবং নদী এবং নদী প্রশাসন বিশেষজ্ঞের মতামত ছিল, পিলার সেতু বন্দরের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনবে। জোয়ার ভাটার পলি দ্রুত পিলার ঘিরে আটকে নদীর তলদেশ ভরাট করার পাশাপাশি চর জেগে উঠবে। যা বন্দর অচল করার পাশাপাশি জোয়ার ও বানের জলে নগরকেও ভাসাবে। কিন্তু তদানিন্তন সরকারের দায়িত্বশীল এমন কী সরকারের চট্টগ্রামের প্রতিনিধিরাও এসব যুক্তি পাত্তা দেন নি। জবরদস্তি পিলার সেতু গড়ে চট্টগ্রাম উন্নয়নের জয়ঢাক বাজাতে থাকেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মহিউদ্দিন চৌধুরী এই মর্মবেদনায় পুড়েছেন। এরশাদ আমলের সেতুটি ডেনিশ সাহায্যে প্রাপ্ত পুরোনো সেতু। এটি বাতিল হলেও তৃতীয় সেতুটি কর্ণফুলী এবং বন্দরকে দ্রুত গ্রাস করছে। ক্যাপিটাল ড্রেজিংএর নামে হাজার কোটি টাকা উড়ছে। কিন্তু নদীর প্রশস্ততা ও গভীরতা ফিরছেনা। এর মাঝে আজাদীর একটি শীর্ষ প্রতিবেদনে বন্দর ও কর্ণফুলী অসুস্থতার ভয়াল উপসর্গ উঠে আসে। বলা হয়েছে, কর্ণফুলী পিলার সেতুর পিলার ঘিরে নদী ভাটিতে বিশাল চর গড়ে উঠেছে। নাব্যতা ফেরাতে এবং রাজাখালী খালের মুখ খোলা রাখতে চর থেকে পাঁচ লাখ ঘনফুট পলি ও বালু উত্তোলন করা হবে। পিলারের অনুর্ধ ২০০ মিটার দূর থেকে চর কেটে নাব্যতা ফিরানো হবে। কিন্তু পুরো চর কাটা সম্ভব না, পিলারের ২০০ মিটার পর্যন্ত ওটা সরু অবস্থায় থাকবে। থাকলেও বিপদ, দ্রুত জোয়ার ভাটার টানে আবার বড় চর ভাসবেই। এর মাঝে নানা জটিলতায় ক্যাপিটাল ড্রেজিং বন্ধ। বিকল্প চালু হয়েছে ‘সদরঘাট টু বাকলিয়া চর ড্রেজিং প্রকল্প’। নৌবাহিনীর সহায়তায় চিনা কোম্পানি এটা বাস্তবায়ন করছে। কাজও এগুচ্ছে দ্রুত। পিলার সেতুর চর কেটে ৫ লাখ ঘনমিটার মাটি ও বালু তোলার কাজ যুক্ত হওয়ায় প্রকল্প ব্যয় ৬৩ কোটি টাকা বেড়ে ৩০২ কোটি করা হয়েছে। প্রথমে ৪২ লাখ ঘনমিটার মাটি তোলার প্রকল্পটির বরাদ্দ ছিল ২৫৮ কোটি টাকা।
টাকার বরাদ্দ বড় কথা না, কিন্তু এতে সমাধান কই? সমস্যা হচ্ছে, পিলার ঘিরে জমা মাটি বা চর অপসারণ সম্ভব না, সেতু সুরক্ষার কারণে। তাহলে কীভাবে কর্ণফুলীর নাব্যতা ফিরবে? এদিকে মিরসরাই বঙ্গবন্ধু শিল্পপার্ক চালু হলে বন্দরের উপর চাপ দ্বিগুণ বাড়বে। পায়রা সমুদ্র বন্দর চালু করেও চট্টগ্রাম বন্দরের চাপ কমানো সম্ভব না। পায়রা বা মংলা বন্দর কখনো চট্টগ্রামের বিকল্প হতে পারবেনা। এগুলো চট্টগ্রাম বন্দর সহায়ক হবে মাত্র। সহায়ক দিয়ে বিশাল সমুদ্র অর্থনীতি বা চট্টগ্রাম বন্দরের ক্রম বর্ধমান চাহিদা কমানোর চিন্তা কখনো স্বাস্থ্যকর হতে পারেনা। তাই জাতীয় অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক প্রবাহ গতিশীল রাখতে দফায় দফায় ড্রেজিংএর নামে বিপুল অর্থ নাশের বদলে দ্রুত কর্ণফুলীর দখল উচ্ছেদ ও স্বাভাবিক গতি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ জরুরি হয়ে পড়েছে। বৃহত্তর জাতীয় প্রয়োজনে পিলার সেতুও উচ্ছেদ হোক। মনে রাখা উচিত, হেলাফেলায় সময়ক্ষেপনের সুযোগ একদম নেই। এতে জাতি পিছিয়ে পড়বে অনেক দূর।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক, কলামিস্ট