কর্ণফুলী শুধু চট্টগ্রামবাসীর নয়, এটি সমগ্র দেশের প্রাণভোমরা। কর্ণফুলীর স্রোত, নাব্যতা ও পানি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ।এ নদীর প্রতি দায়িত্বশীল হওয়া, নদীকে জীবন্ত রাখা দেশের সমৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত জরুরি। যেকোনো মূল্যে কর্ণফুলীকে দখল–দূষণমুক্ত করে তার প্রবাহ বহমান রাখতে হবে।
পত্রিকান্তরে প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, নগরীর ৩৭টি খাল ও নালা দিয়ে প্রতিদিন দুই হাজার টনের বেশি বর্জ্য কর্ণফুলী নদীতে পড়ে। তবে কর্ণফুলী নদী অভিমুখে নগরীর ৫২টি খাল ও নালার মুখ রয়েছে। দখল, দূষণ ও ভরাট হয়ে এসবের মধ্যে ১৫টি ইতোমধ্যে অস্তিত্ব হারিয়েছে। বর্তমানে বাকি ৩৭টি খাল দিয়ে প্রতিনিয়ত কর্ণফুলীতে বর্জ্য পড়ছে। নগরীর ৭০ লাখ মানুষের বর্জ্য, পলিথিন জমে কর্ণফুলীর তলদেশে বিশাল পলিথিন পাহাড় তৈরি করছে। আর তা নদী ও নদীর জীববৈচিত্র্যকে চরম হুমকির মুখে ফেলছে। নগরীর শাহ আমানত সেতু এলাকা ও চাক্তাই খালের মুখে ২০১৪ সালে কর্ণফুলীর প্রস্থ ছিলো প্রায় ৯শ’ মিটার। দশ বছরের ব্যবধানে বর্তমান সময়ে এসে নদীর প্রস্থ দাঁড়িয়েছে ৪৩০ থেকে ৫১০ মিটার। নদীর দু’পাড়েই যুগ যুগ ধরে ধরে চলে আসছে অবৈধ দখলদারত্ব। প্রশাসনের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর দু’পাড়ে অন্তত দুই হাজার অবৈধ স্থাপনা রয়েছে। নদী দখল করে তৈরি করা হয়েছে এসব স্থাপনা–অবকাঠামো। এর ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিশীলতা ও প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে। কর্ণফুলী ভরাট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। এই কর্ণফুলীকে বাঁচাতে অবশেষে ড্রেজিংয়ে নামে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। কর্ণফুলী নদীর নাব্য ধরে রাখতে ড্রেজিং চলমান রয়েছে বলে পত্রিকান্তরে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক ও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চিফ হাইড্রোগ্রাফার কমান্ডার মোহাম্মদ শামসিত তাবরীজ। তিনি বলেন, ‘২৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে কর্ণফুলী ড্রেজিং প্রকল্পের কাজ চলছে। কর্ণফুলী নদীর নাব্য ধরে রাখার জন্য ড্রেজিং ও খাল খনন চলমান। নদীর চার কিলোমিটার অংশ জুড়ে খনন কাজ চলবে। ইতোমধ্যে নদীর তলদেশে জমে থাকা সাত মিটার গভীর পলিথিনের স্তর অপসারণ করা হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে এই ড্রেজিং প্রকল্প শেষ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে তা কার্যকর ভূমিকা রাখবে।’
কর্ণফুলীর বেহাল দশা দেখে চট্টগ্রামবাসীর উদ্বেগ উৎকণ্ঠার সীমা নেই। আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা হয়েছে বারবার। কার্যকর কোনো ভূমিকা নেয়নি প্রশাসন, বরং নীরব ভূমিকা পালন করেছে। কর্ণফুলীকে দূষণ ও দখলমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় কোনো উদ্যোগ চোখে পড়েনি। নদীর যেন কোনো মালিক নেই। মানব সৃষ্ট দূষণ, শিল্পকারখানার বর্জ্য এবং অবৈধ দখলদারিত্বে কর্ণফুলী দিন দিন হয়ে পড়ছে খর্বকায়। গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে জীর্ণ শীর্ণ কর্ণফুলীর দুরবস্থা। বলা হয়েছে, প্রাণসঞ্চারণী ১৩টি খালসহ ৫৪টি ছোট–বড় খালের বেশির ভাগই দখল অথবা নানা অত্যাচারে বিলীন হয়ে গেছে। কর্ণফুলীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শিল্পাঞ্চল। শিল্প কারখানাগুলোর ৯০ শতাংশ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ইউনিট বা বর্জ্য নিষ্কাশনের পরিবেশবান্ধব কোনো ব্যবস্থা নেই।
অন্যদিকে, কর্ণফুলী নদী গবেষকরা বলছেন, কর্ণফুলী সুরক্ষায় এ মুহূর্তে দু’টি বিষয় জরুরি। এক. দূষণরোধ এবং দুই. অবৈধ দখলকৃত স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ। অভিযোগ উঠেছে, কর্ণফুলী ভরাট করে ভূমির ব্যবসা চলছে। চট্টগ্রাম মহানগরীতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও জমির দাম বৃদ্ধির সুবাদে জমির ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় এই অপতৎপরতাও বেড়ে গেছে। গবেষকদের অভিযোগ, কর্ণফুলীকে জীবন্ত সত্তা ঘোষণা দিলেও সেই আদেশ লঙ্ঘন করে নদীকে হত্যা করা হচ্ছে। এই নদীর সঙ্গে দুই কোটির বেশি মানুষের জীবন–জীবিকা জড়িত। শহরের সকল বর্জ্য এসে পড়ছে নদীতে। এটি জলজ বাস্তুসংস্থানের জন্য ক্ষতি। উন্নত শহরে এসব নেই। চসিক, সিডিএ, ওয়াসা, বন্দর ও জেলা প্রশাসনকে দিয়ে এই নদীকে রক্ষা করা এখন সময়ের দাবি। বিশেষজ্ঞদের দাবি, কর্ণফুলীর দুই পাড়ে যেসব বেসরকারি অবৈধ স্থাপনা চিহ্নিত করা হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে নদীর জায়গা নদীকে ফিরিয়ে দিতে হবে। খালগুলো দিয়ে যাতে গৃহস্থালি বর্জ্য, পলিথিন নদীতে পড়তে না পারে, বেলে মাটির পাহাড় বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাতে নদীতে পলি জমতে না পারে সে জন্য মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী সিলট্রেপ তৈরি করতে হবে।