পলিথিন একমাত্র বস্তু, পণ্য বহন বা প্যাকেটজাত করা ছাড়া আর কোনো উপকারিতা নেই। বিপরীতে রয়েছে অসংখ্য ক্ষতিকর প্রভাব। এমনকি পলিথিনই একমাত্র বস্তু, যার দ্বারা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে একটি দেশ। বাংলাদেশে অবাধে ব্যবহার হচ্ছে নিষিদ্ধ এই জিনিস। দেশে ফেলা দেওয়া পলিথিন সংগ্রহ, সংরক্ষণ কিংবা রিসাইক্লিংয়ের কোনো রকম ব্যবস্থা নেই। পরিবেশবিদ এবং কৃষিবিজ্ঞানীরা বলছেন, কৃষিখাত থেকে শুরু করে দোকান থেকে কিনে আনা সামান্য সিঙ্গারা সমুচাতেও পলিথিনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, পলিথিনের সবচেয়ে বড় ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে মাটির স্তরে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়- গ্রামের অনেক বাড়িতে কিংবা শহরের টং দোকানগুলোতে বৃষ্টির পানি আটকানোর জন্য উপরে প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যবহার করা হয়। কারণ, পলিথিন সহজে ফুটো হয় না। ঠিক তেমনি পলিথিন মাটিতে গেলে ক্ষয় হয় না বা মাটির সঙ্গে মিশে যায় না। মাটিতে পড়ার পর বা মাটির একটু নিচে চলে যাওয়ার পর সেই পলিথিনের মধ্য দিয়ে নিচের দিকে আর পানি যেতে পারে না। মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক পুষ্টি উপাদানের চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। পলিথিন কৃষি জমির উর্বরতা বৃদ্ধিতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়। যার ফলে মাটির স্বাভাবিক কাজ ব্যাহত হয়। মাটির গুনগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পায়। শস্যের ফলন কমে যায়। এমনকি শুধু মাটির নিচের ওসব পলিথিনের কারণে গাছও তার খাবার পায় না। গাছ দুর্বল হওয়া মানে কম অক্সিজেনের উৎপাদন। যার ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায়। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হিসেবে বলা যায়, জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ অসচেতনতায় ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট সব পলিথিন। জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বৃষ্টির পানি প্রথমত ভূগর্ভে শোষণ করে নেয়, বাকি পানি রান অব ওয়াটার হয়ে খাল, বিল ও ড্রেন দিয়ে নদীতে চলে যায়। কিন্তু চট্টগ্রাম শহরে এই দুই পথের সবই অকার্যকর। সিডিএর জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কারণে ৩৬ টি খাল নালায় উন্নয়ন কাজ চলছে। খালগুলোতে বাঁধ দেয়ার ফলে পানি নিষ্কাশন বন্ধ থাকায় নগরীতে যে ড্রেনগুলো আছে তা পলিথিন, গৃহস্থালি আবর্জনায় পূর্ণ হয়ে আছে। এ কারণে নগরীর জলাবদ্ধতা প্রকট আকার ধারণ করছে। পলিথিনের কারণে অন্যসব আবর্জনাও জট পাকিয়ে থাকে। আর পলিথিন তো কখনোই পচে না। ফলে একজন নাগরিক যখন একটি পলিথিন রাস্তায় ফেলছেন, ধরে নিতে হবে কয়েক বছর পরও সেই পলিথিন শহরের কোনো না কোনো ড্রেনে আটকে আছে কিংবা কর্ণফুলিতে গিয়ে জমা পড়েছে। শহরবাসী ওয়াসার পরিষ্কার পানি পায় না। অবাক হলেও সত্য যে এর পেছনেও পলিথিন অনেকাংশে দায়ী। পলিথিনসহ অপচনশীল বর্জ্যে ঢাকার বুড়িগঙ্গা মতো কর্ণফুলিও ভয়াবহ দূষণের শিকার। প্রতিনিয়ত নগরীর বিভিন্ন স্থানসমূহ হতে কলকারখানার বিষাক্ত অপরিশোধিত বর্জ্য খাল নালার মাধ্যমে পড়ছে বাংলাদেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে বঙ্গোপসাগরের মোহনায় মিলিত হওয়া নদী কর্ণফুলিতে। নগরীর আবর্জনা, পলিথিনের কারণে কর্ণফুলি নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে ৮ থেকে ১০ ফুট পুরু পলিথিন স্তর। কর্ণফুলীর দূষণ এবং এর প্রভাব সর্ম্পকে কয়েকজন অনুজীব বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং পরিবেশবিদরা বলছেন পুরু পলিথিনের স্তরের কারণে কর্ণফুলির তলদেশের পানি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, পলিথিন, পয়োবর্জ্য, মেডিকেলবর্জ্য ও কলকারখানার বিষাক্ত রাসায়নিকের কারণে কর্ণফুলির পানির গুণাগুণ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ও প্রাণিবিজ্ঞানীদের মতে মাছ ও জলজ প্রাণীর বসবাসের জন্য প্রতি লিটার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ ৫ মিলিগ্রাম বা তার বেশি থাকা প্রয়োজন। অপরদিকে দ্রবীভূত হাইড্রোজেন মাত্রা কমপক্ষে ৭ মিলিগ্রাম থাকা উচিত। অথচ কর্ণফুলী নদীর পানিতে অক্সিজেনের পরিমান ৩ মিলিগ্রামও থাকে না। যে কারণে নদীর কূল থেকে ৫০ গজের মধ্যে কোনো রকম মাছ পাওয়া যাচ্ছে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. মনজুরুল কিবরিয়ার মতে, কর্ণফুলীতে এখন ৮০ শতাংশ মাছ হ্রাস পেয়েছে। দূষণের কারণে ৩৫ প্রজাতির মাছ সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। কর্ণফুলীকে বাঁচাতে হলে দরকার পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা, প্রযুক্তিনির্ভর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সুয়্যারেজ সিস্টেম চালু ও খাল নালায় বর্জ্য ফেলা বন্ধ করা। চসিক মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. রেজাউল করিম চৌধুরী দায়িত্ব নেবার পর থেকে এ বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রেখে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কর্ণফুলি বাঁচাতে ও পরিবেশবান্ধব নগরী গড়তে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি নালা নর্দমা খালের পানি চলাচলের মূল প্রতিবন্ধকতা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে ১ জানুয়ারি ২০২২ থেকে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বাজার কাজীর দেউরী, চকবাজার ও চৌমুহনী কর্ণফুলী বাজারে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেন। এ উদ্যোগ বাস্তবায়নে গ্রহণ করা হয় মাইকিং, লিপলেট বিতরণ, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক প্রচারণা। ২৫ মার্চ থেকে নগরীর সকল বাজারে পলিব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তিনি পলিথিন ব্যবহাররোধে জনসচেতনতা সৃষ্টির পাশাপাশি আইনের কঠোর প্রয়োগের প্রয়োজন উল্লেখ করেন। মেডিকেল বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় জাইকার সহযোগিতায় ইন্সিনেরেটর (বর্জ্য পোড়ানোর পরিবেশবান্ধব চুল্লি) প্ল্যান্ট স্থাপন করা হয়েছে যাতে হাসপাতালের বিষাক্ত বর্জ্য পরিবেশে ছড়াতে না পারে। এ জন্য হাসপাতাল থেকেই বর্জ্য সংগ্রহ ও পৃথকীকরণের ব্যবস্থা যথাযথ করতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, পলিথিন থেকে সৃষ্ট এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া ক্যান্সার ও ত্বকের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে। ডায়রিয়া ও আমাশয় রোগও ছড়াতে পারে। এছাড়া রঙিন পলিথিন জনস্বাস্থ্যের জন্য আরো বেশি ক্ষতিকর। এর ক্যাডমিয়াম শিশুদের হাড়ের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়ায়। প্লাস্টিক ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি করে এবং প্রজনন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ধ্বংস করে, শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা এবং ক্যানসারের কারণ হিসেবে দেখা দেয়।
এছাড়া গরম খাবার পলিথিনে নিলে সেই খাবার মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক হতে পারে। ২০০২ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন সংশোধন করে পলিথিনের উৎপাদন ও বাজারজাত নিষিদ্ধ করা হয়। আইন বলছে, ‘সরকার নির্ধারিত পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি ও বাজারজাতকরণে প্রথম অপরাধের দায়ে অনধিক দুই বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক দুই লাখ টাকা জরিমানা। আবার উভয়দণ্ড হতে পারে। আবার পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের ক্ষেত্রে অপরাধী ন্যূনতম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ন্যূনতম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয়দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। বিক্রি, বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুদ, বিতরণ, বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে পরিবহন বা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের ক্ষেত্রেও রয়েছে শাস্তির বিধান। এক্ষেত্রে অনধিক এক বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। পরবর্তী প্রতিটি অপরাধের দায়ে ন্যূনতম দুই বছর, অনধিক ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ন্যূনতম দুই লাখ টাকা, অনধিক ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন অপরাধ। জাতিসংঘের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শহরের একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে চারটি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। সে হিসাবে প্রতিদিন প্রায় ৫০ লক্ষ পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার শেষে ফেলে দেওয়া হয়। ২০১৮ সালে বিশ্ব পরিবেশ দিবসেরও প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল- ‘প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা’। এ থেকে এর বিরূপ প্রভাব সর্ম্পকে ধারণা করা সম্ভব। এ ছাড়া প্রতিবছর ৩ জুলাই পালিত হয় ‘আন্তর্জাতিক প্লাস্টিক ব্যাগ মুক্ত দিবস’। প্লাস্টিকের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা দিবসটি পালনের প্রধান উদ্দেশ্য। বৈশ্বিক উঞ্চায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তন পরিবেশসংক্রান্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির একটি পজিশন পেপার থেকে জানা যায়, পলিথিন বা প্লাস্টিক উৎপাদন প্রক্রিয়ায় গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হয়, যা জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রতিবছর প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় ১৭ মিলিয়ন ব্যারেল তেল ব্যবহার করা হয়। এক কেজি প্লাস্টিক উৎপাদনে প্রায় দুই থেকে তিন কেজি পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গত হয়, যা বৈশ্বিক উষ্ণায়নে ভূমিকা রাখে। সরকার পলিথিন উৎপাদন, বাজারজাতকরণ এবং ব্যবহার রোধ করার জন্য সবসময়ই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে আইন করা হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু কিছু পণ্যের বাজারজাতকরণে পলিথিন ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া থাকলে, আর তা প্রস্তুতে কারখানা থাকলে, পলিথিন বন্ধ করা কঠিনসাধ্য হয়ে পড়বে। তাই এ বিষয়ে সমন্বিত সিদ্ধান্তের প্রয়োজন। তথাপি বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রাণস্পন্দন চট্টগ্রাম বন্দরকে পরিপূর্ণভাবে ব্যবহারযোগ্য ও টেকসই ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে কর্ণফুলির দূষণ রোধ ও নাব্যতা রক্ষায় এবং শহরের জলজটের ভোগান্তি দূরীকরণে চসিক মেয়র নিত্যব্যবহার্য পলিথিনের ব্যবহার সীমিতকরণে যে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন তাকে নগরীর সচেতন মহল সাধুবাদ জানিয়েছে। এমতাবস্থায় সাধারণ নাগরিকদের এ বিষয়ে আরো সোচ্চার হয়ে ‘পলিথিন বর্জন’কে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করতে হবে। আর এর মাধ্যমেই অর্জিত হবে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধে চূড়ান্ত সফলতা।
লেখক: শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক