কর্ণফুলী নদীর জল ছুঁয়ে দেখেনি শিলক গ্রামের এমন কোন শিলকের অধিবাসী খুঁজে পাওয়া যাবে কি? নদী পারাপারে নদীর বুকেতে হাত আর জলের মিথস্ক্রিয়ায় কত অব্যক্ত উচ্ছ্বাস অবচেতন মননে আমরা জমিয়েছি স্মৃতির উপখ্যান আমাদের মনে পড়ে কি? দায়ভারের ক্লান্ত যাপিত জীবনে ঠাসবুনোটের ভীড়ে বসে আজ এক মায়ার কথা বলছি। এক নদীর কথা বলছি। আমাদের নদী–শিলকবাসীর নদী। নদীর নাম কর্ণফুলী!
যখন ছোট ছিলাম সারাদিনের মধ্যে কোন না কোন এক সময় এসে নদীর পাড়ে দৌড়ে চলে আসতাম। যেন নদীটাই আমাকে টেনে নিয়ে আসতো। একটা বিশেষ দৃশ্য দেখার জন্য। ঐ সময়ে নদীর জলের সাথে জলের উপর দিয়ে ভেসে ভেসে সফেদ শুভ্র ফেনা বয়ে যেতো। (ওগুলোকে আমরা কাষ্টিকের ফেনা বলতাম। কর্ণফুলী পেপার মিল থেকে প্রক্রিয়াজাত শেষে এই ফেনাগুলো নদীর জলে এসে মিশতো আর জলের স্রোতের সাথে ভেসে ভেসে চলে আসতো)। এই সফেদ শুভ্র ফেনাগুলোর দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতাম। ফেনাগুলোর নদীর জলে ভেসে যাওয়া দৃশ্য আমাকে আকর্ষিত করতো। ইচ্ছে করতো একটি রঙিন কাগজে কাগজের নৌকা বানিয়ে সেই নৌকাটা সফেদ শুভ্র কাষ্টিকের ফেনার উপর বসিয়ে দিয়ে আসতে। আর ভাবতাম নদীর জলের সাথে সফেদ শুভ্র ফেনার উপর বসে আমার রঙিন নৌকাটাও ভেসে যাবে দূরে বহুদূরে।
সফেদ শুভ্র ফেনার উপর রঙিন নৌকা ভাসানোর ইচ্ছেটা আমার আর কখনো পূরণ হয় নি। কোনদিনই পূরণ হয় নি। ইচ্ছে! আহা আমার ইচ্ছেরা! ইচ্ছের গায়ে শিশিরের শব্দের মতো টুপ করে নিরবতা নেমেছিলো একদিন খুউব গোপনে।
কোন কোন নদীও নাকি মরে যায় করুণ অভিমানে। না আমাদের নদীটা মরে যায় নি। তবে নিজের মতো করে নাম না জানা কোন অভিমানে নিজের কিছু অস্তিত্ব মুছে নিয়েছে অজানা দুঃখবোধে। পাকিয়ারটিলা সোজা রাস্তা ধরে যে পথটা নদী পর্যন্ত এসেছে সেখানে বড়ুয়া পাড়া সংলগ্ন একটি ফুলতলি ঘাট ছিলো। সেই ফুলতলি ঘাট সোজা কিছুটা দূরে নদীতে একটা চর ছিলো। নদীতে যখন ভাটা নামতো ফুলতলি ঘাট নিয়ে পূর্বে পশ্চিমে অনেকাংশ জুড়ে পানি একেবারে কমে বালুচর বেরিয়ে আসতো। তখন শৈশবের বন্ধুরা মিলে বালুচর হেঁটে নদীর চরে যেতাম । বাউন্ডুলে ছুটাছুটি,উদ্দেশ্যহীন ঘুরাঘুরি কখনো দল বেঁধে ফুটবল খেলতাম। কত কোলাহল মুখরিত সময়। আহা!।নদীটা যেন বলতো তোমাদের সব কোলাহল আমার বুকে রেখে যাও। আমরাও আমাদের বালুকাবেলার সব কোলাহলমুখর পদচ্ছাপ নদীটার চরে রেখে আসতাম।
একদিন নদীর চরে ফুটবল খেলতে খেলতে নদীতে কখন জোয়ার এসে গেছে বুঝতেই পারি নি। খেলা শেষ করে দেখি সন্ধ্যা আসন্ন। জোয়ারের কারণে পানি বেড়ে গিয়েছে। কোন নৌকাও নেই। (ফুলতলি ঘাটে তেমন নৌকা, বোট কখনো থাকতো না) আমি তখন ভালো সাঁতারও জানতাম না। সবাই সাঁতরে পার হওয়া শুরু করে দিয়েছে। সবাই শুধু বলছিলো– স্রোতের দিকে গা ভাসিয়ে দিতে। আমিও কোন কিছু না ভেবে একহাতে শার্ট উপরে ধরে আরেক হাতে সাঁতার কাঁটার চেষ্টায় গা ভাসিয়ে দিয়েছি। পানি বেশ বেড়েই গিয়েছিলো। গন্তব্য পৌঁছানোর জন্য কিনারা থেকে কিছুটা দূরত্ব বাকি। আমি ডুবতে শুরু করছিলাম। কয়েকবার পানিও খেয়ে ফেলেছি। একটা হিম শীতলতা আমাকে গ্রাস করে নিচ্ছিলো। কয়েকবার ডুবছি আর উঠছি আর কেবল একটা তরল অন্ধকার অনুভব করছিলাম। বেঁচে থাকার তীব্র এক ব্যকুলতায় নিজেকে কেবল ভাসিয়ে রাখতে চেষ্টা করছিলাম। এমন ঘোরের মধ্যেই একটা সময় পায়ের নিচে মাটির স্পর্শ অনুভব করলাম। কোনরকমে পাড়ে উঠে বসলাম– এরপর অনুভব করলাম– এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকাটা তীব্র এক আনন্দময় ঘটনা।
কেউ যখন পাহাড় সমুদ্রের গল্প বলে আমি তখন আমাদের কর্ণফুলী নদীর গল্প বলি। নদীর জলে বৃষ্টির জল পড়ার শব্দের ঘোর লাগা অনুভূতির কথা বলি। নদীর জলে যখন “সূর্যের শেষ আলোক বর্ণটা গোধূলির রংয়ে নেমে আসে। এই আলোটা ঠিক লাল না গোলাপি, নীল আছে কি নেই বোঝা যায় না।” নদীর চারপাশটা এক অদ্ভুত মায়াময় রঙিন করে তুলে– এই সময় নদীর বুকে নৌকার পাটাতনে বসে সেই ঐশ্বরিক দৃশ্য অবলোকনের গল্প বলি। কর্ণফুলির বুকে মাঝরাতে মাঝিরা যখন হারিকেনের মিটমিট আলোয় মাছ ধরতে ব্যস্ত সেই দৃশ্যপট দেখতে দেখতে প্রিয় মানুষকে অনুভব করার গল্পটাও বলি।
কর্ণফুলী নদী–নৌকা–মাঝি–নোঙর–স্পিটবোট আর ইঞ্জিনের শব্দের সাথে আমাদের শিলকবাসীর এক প্রেম প্রেম সর্ম্পক আছে। যেখানে আমাদের ব্যক্তিজীবন ও কর্ণফুলী নদীর জলের প্রবাহ যেন সমান্তরালেই বয়ে গেছে এক অবিচ্ছেদ ইতিহাসের পথে অমোঘ সত্য হয়ে।
আজ শিলকের অধিবাসীরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই নিঃশ্বাস নিয়ে থাকুক না কেন বুকের গহীনে কর্ণফুলীর জলের শব্দ ঢেউ তোলে মননজুড়ে।