কর্ণফুলী থেকে বেপরোয়া বালু উত্তোলন

নগরের ফিশারিঘাট থেকে বোয়ালখালী । অর্ধশতাধিক বালুমহাল, প্রতি রাতে ২শ গাড়িতে বালু ও মাটি পাচার । নদীর তীর, বাঁধ ও পরিবেশের ক্ষতি

হাসান আকবর | বুধবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৬ পূর্বাহ্ণ

কর্ণফুলী নদী ও আশপাশের এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বেপরোয়াভাবে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন ও বেচাকেনা। রাজনৈতিক প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে উঠেছে অর্ধশতাধিক বালুমহাল। ড্রেজারভলগেট দিয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার ঘনফুট বালু তোলা হচ্ছে। এতে নদী ও পরিবেশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ছে। হুমকির মুখে পড়েছে সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প, নদীর তীরবর্তী সড়ক, বসতি ও কৃষিজমি। প্রশাসন মাঝে মাঝে অভিযান ও জরিমানা করলেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের কারণে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড থামছে না। কর্ণফুলীর কালুরঘাট, চৌধুরীহাট, ফখিরাখালী ঘাট, চৌধুরী খালের মুখ, খরণদ্বীপজ্যৈষ্ঠপুরা এলাকায় রয়েছে অন্তত ৩০৩৫টি বিক্রয়কেন্দ্র। প্রতিদিন এখান থেকে শত শত ট্রাক ও ট্রাক্টরে বালু পাচার হচ্ছে। শুধু নদী নয়, পাহাড়ি ছড়াগুলোও রেহাই পাচ্ছে না। জ্যৈষ্ঠপুরা ভাণ্ডালজুড়ি খাল ও বিভিন্ন ছড়া থেকে ট্রাক্টরে বালু তুলে বিক্রি করছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা।

স্থানীয়দের অভিযোগ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতারা সমঝোতার মাধ্যমে এ অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। একসময় ক্ষমতাসীন দলের লোকজন এককভাবে বালু ব্যবসা চালালেও এখন ভাগাভাগি ভিত্তিতে চলছে এ বাণিজ্য। কোথাও ৬০৪০ শতাংশে, কোথাও সমান অংশীদারিত্বে বালু তোলার টাকা ভাগ হচ্ছে। ফলে প্রশাসনের কোনো উদ্যোগ কার্যকর হচ্ছে না।

নগরীর বাকলিয়াবলিরহাট থেকে ফিশারিঘাট পর্যন্ত এলাকার চিত্রও একই। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, এসব পয়েন্টে দিনেরাতে ড্রেজার বসিয়ে মাটি ও বালু তোলা হচ্ছে। প্রতি রাতে অন্তত ২০০ গাড়ি বালু ও মাটি পাচার হচ্ছে। এতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) শত কোটি টাকার প্রকল্প চাক্তাইকালুরঘাট সড়ককাম বাঁধ মারাত্মক ঝুঁকির মুখে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। নদীর তীর ঘেঁষে যেভাবে বালু কাটা হচ্ছে, তাতে বাঁধে বড় ধরনের ক্ষতির শঙ্কাও প্রকাশ করেছেন তারা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ড্রেজার বসিয়ে বালু তুলছে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। তাদের ভয়ে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ করতে পারছে না। বরং যারা ভিন্নমত প্রকাশ করছে তাদের ভয়ভীতি দেখানো হচ্ছে। সম্প্রতি বাকলিয়ার বলিরহাট এলাকায় স্থানীয়রা বালু তোলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হলেও তাদের দমাতে পারেনি।

বোয়ালখালী উপজেলার শ্রীপুরখরণদ্বীপ, কদুরখীল, চরণদ্বীপ এবং নগরীর কালুরঘাট এলাকায় নদীর দুই পাড়ে দেখা যায় বালুর রাজত্ব। স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রাজনৈতিক নেতারা সমঝোতার ভিত্তিতে ব্যবসা করছেন। প্রতিদিন এসব এলাকায় ২০টিরও বেশি ড্রেজার দিয়ে ৬০৮০ হাজার ঘনফুট বালু তোলা হয়। প্রতি ঘনফুটে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে এক টাকা হারে। শুধু চর খাজনার নামে প্রতিদিন প্রায় দেড় লাখ টাকা উঠছে, মাসে যা দাঁড়ায় ৪৫ লাখ টাকা।

প্রশাসনের দাবি, কর্ণফুলী নদীর বোয়ালখালী অংশে কোনো বৈধ বালুমহাল নেই। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের তালিকাতেও এ উপজেলায় কোনো অনুমোদিত বালুমহালের নাম নেই। অথচ দুইতিন দশক ধরে চলছে অবৈধ বালু উত্তোলন ও ব্যবসা। সরকার এ খাত থেকে এক টাকা রাজস্বও পাচ্ছে না। বরং নদী, প্রকল্প ও পরিবেশ পড়ছে ভয়াবহ সংকটে।

একাধিক স্থানীয় বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, অবৈধ বালু বাণিজ্যের কারণে কর্ণফুলী নদীর তীর ও বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আমাদের রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকারের কোটি কোটি টাকার প্রকল্পও পড়ছে ঝুঁকিতে। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের কঠোরভাবে দমানো না গেলে পরিবেশ এবং প্রকৃতির বিপর্যয় ঠেকানো কঠিন হবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধফাতেহা-ই-ইয়াজদাহম ৪ অক্টোবর
পরবর্তী নিবন্ধপ্রেম নিয়ে দুই কিশোরের দ্বন্দ্ব, একজনকে পিটিয়ে হত্যা