কর্ণফুলী নদীর প্রায় ৬০ ফুট গভীর থেকে দেড়শ বছরের পুরনো একটি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করা হয়েছে। একই সাথে জাহাজটি থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ওই সময়কার মুদ্রাসহ নানা সামগ্রী। ব্রিটিশ শাসনামলে বাণিজ্য করতে চট্টগ্রামে এসে জাহাজটি ডুবে গিয়েছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমতি নেওয়ার পর নিজস্ব খরচে জাহাজটি উদ্ধার করে হিরামনি নামের একটি বেসরকারি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলসহ কর্ণফুলীর তলদেশে ডুবে থাকা এসব জাহাজের কারণে জাহাজ চলাচলে হুমকি ছাড়াও ড্রেজিং খাতে প্রতি বছর বন্দর কর্তৃপক্ষকে কোটি কোটি টাকার যোগান দিতে হচ্ছিল। বন্দর সূত্র জানায়, নদীতে ডুবে থাকা জাহাজের কারণে পলি জমে চর সৃষ্টি হচ্ছে বহু বছর ধরে। এসব ডুবোচরে ড্রেজিং করে মাটি সরাতে বন্দর কর্তৃপক্ষকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা খরচ করতে হয়। ইতোমধ্যে তিনশ কোটি টাকা খরচ করে সম্পন্ন করা হয়েছে ক্যাপিটাল ড্রেজিং। নদীর তলদেশে ডুবে থাকা জাহাজগুলোর জন্য ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের পর চর জাগছিল। এই অবস্থায় চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কয়েকটি বেসরকারি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠানকে ডুবে থাকা জাহাজগুলো উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মোতায়েন করে। এক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষ কোনো আর্থিক যোগান দেবে না। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেরা খরচ করে জাহাজ উদ্ধার করে নিজেরাই নিয়ে লোহা বিক্রি করবে। এতে বন্দর কর্তৃপক্ষের কোনো দাবি থাকবে না।
বন্দরের শর্ত মেনে হিরামনি নামের একটি বেসরকারি উদ্ধারকারী প্রতিষ্ঠান ডুবে থাকা জাহাজ উদ্ধারের কাজ শুরু করে। তারা চট্টগ্রাম বন্দরের ৬ ও ৭ নং জেটির মধ্যবর্তী স্থানের বিপরীত পাশে ডাঙ্গার চর এলাকায় একটি ডুবে থাকা জাহাজ শনাক্ত করে এবং প্রায় ৮ মাস আগে উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করে। তারা কর্ণফুলী নদীর ৩০ ফুট গভীরে গিয়ে অন্তত আরো ৩০ ফুট মাটি খনন করে তার নিচ থেকে জাহাজটির ধ্বংসাবশেষ উদ্ধার করে।
হিরামনি স্যালভেজ লিমিটেডের কর্ণধার মোহাম্মদ আবুল কালাম ডুবুরি বলেন, আমরা এই জাহাজটিসহ তিনটি জাহাজ নিজস্ব অর্থায়নে উদ্ধার ও অপসারণ করে বন্দর তথা দেশের অর্থনীতির জন্য অবদান রাখতে চাই। আমরা নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছি, যার ধারাবাহিকতায় আমাদের প্রতিষ্ঠানও দেশ ও জাতির স্বার্থে বন্দর চ্যানেলে যেসব ডুবন্ত জাহাজ দীর্ঘ দিন ধরে বন্দরের ক্ষতি করছে আমরা সেগুলো উদ্ধার ও অপসারণ করে চ্যানেলকে ঝুঁকিমুক্ত এবং নিরাপদ করতে চাই।
তিনি বলেন, জাহাজটি ১৫০ বছর আগের এবং কয়লা ইঞ্জিনের ব্রিটিশ শিপ হওয়ায় এটির প্রত্নতাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। জাহাজটিতে আমরা ১৫০ বছর পুরনো মুদ্রা, তামা–পিতল ও রূপার তৈষজপত্র যেমন, প্লেট, হাঁড়ি–পাতিল, গ্লাস, পানির পাত্র, চামচ ইত্যাদি পাওয়া গেছে। এছাড়া বিভিন্ন নকশা করা শৌখিন জিনিস যেমন মোমবাতির দানি, ফুলের টব, আলমারির নকশা, হারিকেন ও কুপি, হাতির দাঁত, দূরবীনসহ নানা সামগ্রী পাওয়া গেছে। উদ্ধারকৃত জিনিসগুলো দেখে স্পষ্ট হয় জাহাজটি ব্রিটিশ সময়কালের। তিনি বলেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারত উপমহাদেশে বাণিজ্য করতে এসে কর্ণফুলীতে জাহাজটি ডুবে যায়।
জাহাজটির উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সিনিয়র ডুবুরি মোহাম্মদ জহির আহমেদ বলেন, এই জাহাজটি নদীর ৬০ ফুট গভীরে ছিল। নদীর এখানে গভীরতা ৩০ ফুট। এরপর আরো ৩০ ফুটের চর জেগেছিল। ড্রেজিং করে জাহাজটির উপর জাগা চর সরিয়ে সেটিকে উন্মুক্ত করা হয়। পরে দক্ষ ডুবুরিদের মাধ্যমে জাহাজের মাঝখানে ওয়্যার সলিং করে কেটে দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়। জাহাজটি অর্ধেক অংশ আমরা উদ্ধার করার জন্য ৪টি স্যালভেজ বার্জ নিয়োজিত করি। বার্জের মাধ্যমে উদ্ধারকৃত অংশটি কিনারে আনার পর বিভিন্ন জিনিসপত্র দেখে নিশ্চিত হই এটি ব্রিটিশ আমলের জাহাজ।
হিরামনি স্যালভেজ লিমিটেডের ডিরেক্টর মোহাম্মদ জিহাদ হোসেন বলেন, ডাঙ্গারচরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে ডুবে থাকা জাহাজটি বন্দর চ্যানেলে জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে হুমকি ছিল। প্রতি বছর বন্দর চ্যানেলে যে পরিমাণ টাকা ড্রেজিং করতে খরচ হয় ডুবে থাকা জাহাজগুলো উদ্ধার করা হলে এই খাতে খরচ বহুলাংশে কমে যাবে। এছাড়া ডুবে থাকা এসব জাহাজের কিছু অংশ উপরে থাকায় বড় জাহাজ চলাচলেও সমস্যা হয়। ডুবন্ত জাহাজগুলোকে যত দ্রুত সম্ভব সরিয়ে নেওয়ার জন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ নিলে জাতি উপকৃত হবে। এক্ষেত্রে আমাদের পক্ষ থেকে যা করার তার সবটুকুই করব।
এ বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, বহুদিন আগে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজের বেশ কিছু অংশ উদ্ধার করা হয়েছে। এটি ভালো কাজ। ডুবে থাকা এসব জাহাজ কর্ণফুলীতে ডুবোচর সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে, যা জাহাজ চলাচলের জন্য হুমকি। জাহাজটি কত পুরনো জানতে চাইলে তিনি বলেন, এই ধরনের কোনো তথ্য বন্দরে নেই। তবে এটি অনেক পুরনো জাহাজ। ধারণা করা হচ্ছে এটি দেড়শ বছর আগেকার।