চট্টগ্রামের কর্ণফুলী ও আনোয়ারা উপজেলায় গত ১২ বছরে বন্যহাতির আক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ১৩ জনেরও অধিক। আহত আর সম্পদের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। কেননা, বন বিভাগ, কেইপিজেড ও স্থানীয় প্রশাসনের উদাসীনতায় বনের হাতি এখন আর বনে নেই। বন্যহাতি এখন জীবন-মরণ সমস্যা।
দুই উপজেলায় একদিকে হাতির আক্রমণ ও মানুষের মৃত্যুর আহাজারি, অপরদিকে নেই জানমালের কোনো নিরাপত্তা। ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাস করা মানুষজন। যতই দিন যাচ্ছে ততই বাড়ছে মানুষের মৃত্যুর মিছিল।
ফলে, চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে গোটা মানব সমাজে। জীবন বাঁচাতে কেউ এগিয়ে না আসায় দিশেহারা হয়ে চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে হাজার হাজার হতদরিদ্র মানুষ। অপরদিকে মানুষ ও হাতি রক্ষায় দায়সারা গোছের সব ব্যবস্থাও ভেস্তে গেছে। হাতির আক্রমণে লোকালয়ে একের পর এক মানুষের প্রাণহানি হলেও অতীতে বন বিভাগ কোন ব্যবস্থা নেয়নি।
ফলে, স্থানীয় সূত্রে তথ্য মিলে কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠানের দৌলতপুর, দক্ষিণ শাহমীরপুর এবং আনোয়ারার গুয়াপঞ্চক, বৈরাগ, মোহাম্মদপুর, ফকিরখিল, বটতলী, হাজিগাঁও, গুচ্ছগ্রামে বিগত বছরগুলোতে তিন শতাধিক পরিবারের বসতঘর ভাঙচুর ও হাতির পায়ে পৃষ্ট হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে বেশি।
অনুসন্ধান ও তথ্য বলছে, এ বছরের গত ১২ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদ ছৈয়দ (৫৭) নামে কৃষক, এর আগে ২৫ জানুয়ারি আনোয়ারায় বন্য হাতির আক্রমণে আহত যুবক মো. বদরুদ্দিনের (২৯) চমেকে মৃত্যু। তারও আগে বড়উঠান খিলপাড়া গ্রামের জালাল আহমদ (৭২), ২০১২ সালে মরিয়ম আশ্রম এলাকায় জুয়েল দাশ (৪৫), একই বছরের ১৩ জুলাই আনোয়ারা বৈরাগ ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর গ্রামের আবদুর রহমান (৭০), ২৬ জুন পুরাতন গুচ্ছগ্রামের মোমেনা খাতুন (৬৫), ১৪ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের মো. আকতার হোসেন চৌধুরী (৫০), ১৭ আগস্ট তৈলারদ্বীপ এলাকার মো. আবদুল মোতালেব বাবুল (৬৮), বরুমছড়া গ্রামের এক মহিলা নিহত হন।
এছাড়াও ২০২০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারীতে দক্ষিণ শাহমীরপুর গ্রামের বড়ুয়াপাড়ায় মায়া রাণী বড়ুয়া (৬০) নামে এক বৃদ্ধা, ১৫ জুলাই বৈরাগ ইউনিয়নের আখতার হোসেন চৌধুরী (৫০), আনোয়ারা উপজেলার বটতলী ইউনিয়নের নুর পাড়া এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ সোলায়মান (৭০), ২০২১ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি বটতলীতে আজিজ ফকির (৭০) সহ আনোয়ারায় ২০২৩ সালের ৫ জুলাই মারা যান মুহাম্মদ ছাবের আহম্মদ প্রকাশ রেনু (৭৮) নামে আরও এক বৃদ্ধ।
অপরদিকে, বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে গত বছরের ১৩ নভেম্বর পর্যন্ত মারা গেছে ৪৩ টি হাতি। যার মধ্যে ১৬টি চট্টগ্রামে এবং বাকিগুলো বান্দরবান ও কক্সবাজারে। এসব হাতির মধ্যে ১৯টি অসুস্থতাজনিত, পাঁচটি বার্ধক্যজনিত এবং অন্যগুলোর মৃত্যু হয়েছে মানবসৃষ্ট কারণে।
এছাড়াও পানিতে ডুবে কিংবা পাহাড় থেকে পড়েও বেশকিছু হাতি আহত হয়েছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, গত তিন বছরে ৯টি হাতি মারা হয়েছে। যার মধ্যে ৪টি চট্টগ্রামে একটি বান্দরবানের লামায়, বাকি ৪টি হাতি হত্যা করা হয়েছে কক্সবাজারে।
আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) জরিপ অনুযায়ী, ২০১৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে বন্যহাতির সংখ্যা ছিল ২৬৮টি। এ ছাড়া ব্যক্তি মালিকানাধীন ৮২টি, চিড়িয়াখানায় তিনটি ও দেশের দুটি সাফারি পার্কে ১১টি হাতি রয়েছে। এরসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে কিছু হাতির প্রজনন হয়েছে বলে মনে করেন বন বিভাগের কর্মকর্তারা। এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে হাতির করিডোর রক্ষায় হাইকোর্টে রিটও হয়েছে।
কর্ণফুলীতে হাতির আক্রমণে বেশির ভাগ মানুষ মারা গেছে রেড জোন বড়উঠানে। এ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ দিদারুল আলম বলেন, ‘হাতির আক্রমণে একে একে নিহত হচ্ছে মানুষ। ঘরবাড়ি ভেঙে দিচ্ছে হাতি। বন বিভাগকে বার বার বলেছি বড়উঠানের গ্রামবাসীকে হাতির আক্রমণ থেকে বাঁচান। কিন্তু নজরে পড়ার মতো কারো কোন পদক্ষেপ নেই।’
কোরিয়ান এক্সপোর্ট প্রসেসিং জোনের (কেইপিজেড) এর প্রশাসন ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক মঈনুল আহসান জানান, ‘কেইপিজেডের ২৩টি কারখানায় কাজ করেন প্রায় ২২ হাজার শ্রমিক। সন্ধ্যায় ঘরে ফেরার জন্য বের হতেই তাঁরাও হাতি আতঙ্কে থাকেন।’
এ বিষয়ে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘মানুষের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি যাতে না হয়, সেজন্য সব সংস্থার সমন্বয়ে জরুরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। বিষয়টি খুবই মর্মান্তিক এবং উদ্বেগজনক। এ বিষয়ে বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ ও কেইপিজেড কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করা হয়েছে। বন বিভাগ কর্তৃপক্ষ জানালেন কর্ণফুলী উপজেলায় বন বিভাগের কোন জমি নেই।’
ইউএনও আরও জানান, ‘কেইপিজেড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন এ বিষয়ে জেলা ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে বন্যহাতি রিলোকেট করার বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। উক্ত ওয়ার্কিং কমিটির মাধ্যমে যাতে বন্যহাতি রিলোকেট করার বিষয়ে কার্যকর সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করছি।’
চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে সরকার তিন লাখ টাকা করে দিচ্ছেন। আবার কেউ আহত হলে এক লাখ টাকা করে দেবেন। একইভাবে ক্ষেত, ঘরবাড়ি কিংবা অন্য সহায় সম্পদের ক্ষতিসাধন করলেও বন বিভাগ ন্যায্য ক্ষতিপূরণ দেবেন।’
চট্টগ্রাম অঞ্চলের বন সংরক্ষক ড. মোল্যা রেজাউল করিম বলেন, ‘চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ বন বিভাগ, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামে এক সময় বন্য হাতির পদচারণা ছিল উল্লেখ করার মতো। এসব পাহাড় নিয়ে ১৯৯৯ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ৫ হাজার ৪৬৪ একর বনভূমিতে কাপ্তাই ন্যাশনাল পার্ক, ১৯৮৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ৪২ হাজার ৮৭ একর বনভূমিতে গঠন করা হয় পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। এই দুটি স্থানকে হাতিসহ বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হয়নি। সঙ্গত কারণে এই দুই উপজেলায় হাতি ও মানুষ মুখোমুখি হয়ে প্রাণ হারাচ্ছে বেশি।’
এ প্রসঙ্গে বন ও পরিবেশবিদ ড. সুপ্রিয় চাকমা বলেন, ‘হাতির করিডোরগুলোতে মানুষের ঘরবাড়ি নির্মাণ ও খাদ্য সঙ্কটের কারণেই মূলত সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। হাতির গতিবিধি নিয়ন্ত্রণে বন বিভাগকে সোলার ফেন্সিং সিস্টেম করতে হবে। তাতে হাতি লোকালয়ে আসার চেষ্টা করলে শক খাবে। যদিও এ বিষয়ে গবেষণা জরুরি। বিশেষজ্ঞ মতামত ছাড়া এ উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না।’