করোনাকে পরাস্ত করতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলতে হবে

অধ্যাপক (ডা.) ইমরান বিন ইউনুস | বৃহস্পতিবার , ১৫ জুলাই, ২০২১ at ১০:৩৫ পূর্বাহ্ণ

করোনা হল এ পর্যন্ত আবির্ভূত সবচেয়ে স্মার্ট ভাইরাস। জানার চেয়ে অজানা বেশী, দারুণ সংক্রামক, কার্যকর প্রতিষেধক নাই, জটিলতায় জীবন হানি অনেক বেশী, জটিলতার চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা দক্ষ জনশক্তি ও প্রযুক্তি এবং উপকরণ নির্ভর, বেশীর ভাগ লক্ষণহীন ভাবে রোগ ছড়ায়। কাশি বা শ্বাসের সাথে বাতাসে মুখ ও নাক দিয়ে বের হওয়া ক্ষুদ্র পানি কনার সাথে ভাসতে থাকে এবং ছয় ফুট পর্যন্ত দূরত্বের যে কাউর নাক ও মুখ দিয়ে দেহে প্রবেশ করতে পারে। বারবার রূপ বদলাতে পারঙ্গম। চলমান জীবন ও জীবিকার সার্বিক সব কিছুতেই তা প্রত্যক্ষ ও অপ্রত্যক্ষ ভাবে অপূরণীয় ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। ক্ষতিকর প্রভাবের একটার পর একটা দুষ্ট চক্র তৈরী করে যাচ্ছে। নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণের বেশ অপারঙ্গতার পাশাপাশি মারাত্মক আর্থসামাজিক মানবিক সমস্যার সৃষ্টি করছে যা আগামীতে আরও বাড়তে থাকবে। বিশ্বমারীর ধাক্কার ঢেউ আমাদের অতিমারীকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলবে।
অন্যদিকে করোনা ভাইরাসের দুটো মারাত্মক দুর্বলতা আছে। যাকে কাজে লাগিয়ে নিয়ন্ত্রনের পন্থা বের করা হয়েছে। ১. কারো দেহে করোনা ভাইরাস ১৪ দিন পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তবে বিরল ক্ষেত্রে ৩ মাস পর্যন্ত থাকতে দেখা যায়। ২. দেহের বাইরে সাধারণত ৭২ ঘন্টার বেশী বাঁচে না। ৩. বাতাসে ভেসে ৬ ফুটের বেশী যেতে পারে না। ৪. ভাইরাস হলো অসম্পূর্ণ জীবন, তাই তার জন্য জীবন্ত দেহ কোষ প্রয়োজন। সেজন্যই ঐ সময়ের মধ্যে যদি নতুন জীবন্ত দেহ কোষ না পায় তাতেই ভাইরাস নষ্ট বা ইনএকটিভ হয়ে যাবে। এই তথ্যের ভিত্তিতে মাঙ লাগানো, বার বার হাত ধোয়া আর ৬ ফুট দূরে দূরে থাকা। এগুলোই হলো তথাকথিত স্বাস্থ্যবিধি।
এ স্বাস্থ্যবিধি মানানোর জন্য নিম্নমুখী বহু নির্দেশনা, বিধিবিধান, হুমকি দামকি দেয়া হচ্ছে যা পুরোপুরি কাজ করছে না। মানুষের পাশ কাটানোর বা টপকানোর অভ্যাস বা বুদ্ধিবৃত্তি চিরন্তন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিভক্ত বার্লিনের দেয়াল জীবন বাজী রেখে টপকানোর ইতিহাস অজানা নেই। পরিসংখ্যান বলে যেকোন নির্দেশনা এক তৃতীয়াংশ জনগণ বিনাবাক্যব্যয়ে মানবে। এক তৃতীয়াংশ মানবে না। আর এক তৃতীয়াংশ যেদিক দলে ভারী সে দিকে ঝুঁকবে। এটা একটা দারুণ মানবিক মনস্তাত্ত্বিক প্রবৃত্তি। তাছাড়া এসব স্বাস্থ্যবিধি মানার সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত জীবন ও জীবিকা। তাই স্বাস্থ্যবিধি মানানো সহজ সরল না যেমনটা শীর্ষে বসা আমলারা মনে করছে। যেকোন ফলন ধর্মী কাজের জন্য তিন ই এর ভারসাম্যমূলক প্রয়োগ করতে হয়। ই গুলো হল। এডুকেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং ও এনফোর্সমেন্ট।
স্বাস্থ্যবিধির সাথে জীবন জীবিকার সরাসরি সম্পর্কযুক্ত। অনাহারে না রোগে মৃত্যু। রোগে মৃত্যুর হার পাঁচ শতাংশের কম। কিন্তু অনাহারে কত, আমরা কি হিসাব রাখতে পারছি। পরস্পর বিরোধী সকল ব্যাপার গুলিকে সমষ্টিতে প্রয়োগ করার জন্য গোষ্ঠী ও ব্যক্তিকে একই বৃত্তে আনতে হবে। ইচ্ছা, লক্ষ্য, ধারণা ও কাজে। বৃত্তে আনার কাজগুলো জনমতাধিকারিকদের। আমলাদের কখনও নয়। ‘তেড়েমেড়ে ডাণ্ডা করে দেব ঠাণ্ডা’ নীতি বা প্রক্রিয়া দিয়ে হবে না। বিশাল জনারণ্যের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আইন ও বিধিনিষেধ কখনও পুরোপুরি পৌঁছাতে পারবে না। জীবিকা এবং স্বাস্থ্যবিধিকে একই সূত্রে গাথতে পারবে জনমনে ত্যাগ ও অংশীদারত্ব তৈরী করে। এটা করতে এলাকা ভিত্তিক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও জননেতাদের নিয়ে করোনা নিরাময় ও নিয়ন্ত্রণ কমিটি গঠন করতে হবে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল চেয়ারমেন, উপজেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান এবং জেলায় জেলা কাউন্সিল চেয়ারম্যান স্তর অনুযায়ী নেতৃত্ব দিবেন। ইউনিয়নের নীচে ওয়ার্ড মেম্বার বা কাউন্সিলর।
সকল সাংসদগণ উপদেষ্টা কাউন্সিল গঠন করে জেলার তৃণমূলের সকল কর্ম সমূহ পরিবীক্ষণ, পর্যালোচনা, নিরীক্ষণ, উপদেশ ও নির্দেশনা দিবেন। আমলাগণ সহায়তা দেবেন ও বিশেষজ্ঞগণ তথ্য ভিত্তিক তত্ত্ব দিবেন। সব কাজ সমূহ পরিচালিত হবে এলাকা ভিত্তিক সুনির্দিষ্ট কর্ম পরিকল্পনা, কর্ম কৌশল ও কর্ম প্রণালী অনুযায়ী। নিরাময় ও নিয়ন্ত্রন কমিটি স্বেচ্ছাসেবক বাছাই করে নেবেন ও প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে নিয়োজিত করবেন। মন্ত্রণালয় সবকিছুর সহায়তা সহ সার্বিক সমন্বয় ও নীতি নির্ধারণের কাজ করবে। স্বেচ্ছাসেবকদের জরিমানা করার অধিকার দিতে হবে, যারা বিধি ভঙ্গকারীদের যথাযথ রশিদ দিয়ে জরিমানার অর্থ গ্রহণ করবে। ভারতের বড় বড় শহরে প্রকাশ্যে নিষিদ্ধ স্থানে ধুমপান করলে মিউনিপাল করপোরেশন কর্তৃক নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবকগণ জরিমানা করে রশিদ দিয়ে অর্থ গ্রহণ করে। এর জন্যে বিরাট আয়োজনের মোবাইল কোর্টের প্রয়োজন নেই। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, খারাপ আর অন্যায় না করার জন্য মানুষের মনের মধ্যে শক্ত প্রতিরোধ তৈরী করে দিতে হবে। তেমনি ভালো কাজের জন্য ইচ্ছা শক্তি। তখন মানুষ বিধি ভাঙবে না আর স্বতঃস্ফূর্ততায় ভালো কাজে জড়াবে। একজনের ভালো প্রভাব আরেকজনের উপর পড়বে। ক্রমে ক্রমে এটা চিরগতিশীল সামাজিক আন্দোলনে পরিণত হয়ে দেশকে আমলায়ন মুক্ত করবে এবং জনগণ জনমতাধিকারিকদের তত্ত্বাবধানে নিজেদের স্বশাসনের জন্য ক্ষমতায়িত করবে। নিজেরা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে নিজেদের সমস্যা নিজেরা সমাধান করতে পারবে।
জাতির পিতা স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে নির্দেশ দিয়েছিলেন, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়’। যার ফলশ্রুতিতে নয় মাসে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আর মুজিব বর্ষের প্রবহমান করোনাক্রান্তির এই সময়ে জাতির পিতার সেই কালোত্তীর্ণ নির্দেশ আরো বেশী তাৎপর্যময়। করোনাকে পরাস্ত করতে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়তে হবেই।
লেখক : বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধএইসব দিনরাত
পরবর্তী নিবন্ধকাল আজকাল