করোনাকালীন শিক্ষার্থীদের অর্জন : হত্যা ও পাশবিকতার কবলে সোনার দেশ

ডা. মোহাম্মদ ওমর ফারুক | মঙ্গলবার , ১৫ জুন, ২০২১ at ১০:২৪ পূর্বাহ্ণ

২০২০ সালের মার্চ থেকে শুরু হওয়া মহাপরাক্রমশালী, আকাশ-জমিনের একচ্ছত্র অধিপতি মহান আল্লাহতায়ালার পাঠানো করোনা সৈন্যের আবির্ভাব ঘটেছে এই দেশে। শুধু এদেশ নয়, পৃথিবীময় করোনা সৈন্যের তাণ্ডবে প্রাণ হারিয়েছেন ৩৫ লক্ষাধিক মানুষ। আক্রান্ত হয়েছেন ১৭ কোটির কাছাকাছি। বিশ্বময় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে করোনা সৈন্য। বর্তমান বিশ্বে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ, কোথাও আবার তৃতীয় ঢেউ চলছে। আমাদের দেশে চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। প্রথমদিকে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা ঊর্ধ্বগতি থাকলেও পরে ধীরে ধীরে তা কমে আসছে। এরপরও আশংকা থেকেই যাচ্ছে। করোনার ভারতীয় ধরণ শনাক্ত হয়েছে কয়েক জায়গায়। এটা আমাদের জন্য সুখবর নয়। ভয়ংকর প্রাণঘাতী ভাইরাস করোনার ভয়ে তটস্থ এদেশের আপামর জনতা। এরপরও স্বাস্থ্য সুরক্ষার যেন কোন বালাই নেই। কোথাও মানা হচ্ছে না স্বাস্থ্যবিধি। সবখানে মাস্কবিহীন পথচারীদের ছড়াছড়ি। করোনা আক্রান্ত পরিবারে যে বা যারা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন তাদের যে দৈন্যদশা তা হয়তো কোনদিন পুষিয়ে আনা সম্ভব হবে না। ক্ষতিগ্রস্তরাই শুধু এই কঠিন ব্যথা, এই কঠিন মর্ম বুঝতে পারবেন- যেটা পারে না অন্য কেউ। করোনাকালীন সময়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এদেশের কোটি কোটি শিক্ষার্থী। অলস জীবনকেই বেছে নিয়েছে অধিকাংশ শিক্ষার্থী। অনলাইন ক্লাসের নামে চলছে অবাধ প্রতারণা। যা কোমলমতি শিক্ষার্থীদের ঠকানোর নতুন কৌশল- এতে না হয় কোন মেধার চর্চা, না হয় কোন বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ। একজন শিক্ষার্থী স্কুল/ কলেজ/ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের সাথে আন্তঃসংলাপ, শিক্ষ্যণীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা, পারস্পরিক মত ও ভাব প্রকাশ ইত্যাদির মাধ্যমে মেধার চর্চাটা ভীষণভাবে জাগ্রত হয় প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি ক্ষণে। ক্লাস হোক আর না হোক মেধাবী শিক্ষার্থীরা ঠিকই তাদের শিক্ষ্যণীয় কৌশলগুলো নিমিষেই আত্মস্থ করে নেয় অবলীলাক্রমে। প্রকাশ্য ক্লাসের শিক্ষা আর অনলাইন শিক্ষা আকাশ-পাতাল ফারাক। অলস মুহূর্তগুলোতে বাসা বেঁধেছে অহেতুক গেমস, ভিডিও চ্যাট, দীর্ঘক্ষণ ঘুমিয়ে থাকা ইত্যাদি। এতে করে মানবিক জৈবকোষগুলো উত্তরণের উন্মেষ ঘটে না- ফলশ্রুতিতে মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে উঠে শিশু-কিশোররা। গত কয়েকদিন আগে চাঁদপুরের মতলব থানায় এক কিশোর ফ্রি ফায়ার নামে গেমসের এমবির টাকা না পেয়ে মায়ের সাথে অভিমান করে আত্মহত্যা করেছে। এই ধরনের ঝুঁিক সব পরিবারে কিছু না কিছু রয়েছে। মতান্তরে নৈতিক অধঃপতন যেন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে প্রতিটি ঘরে ঘরে। মানবজীবনের একমাত্র সমাধান আল-কোরানের শিক্ষা নেই বললেই চলে। অভিভাবকরা যদি নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হোন তাহলে সেই শিক্ষার ছিটে ফোঁটাও পাবে না তার সন্তানরা আর এর প্রভাব পড়বে একঘেঁয়েমি জীবনের কবলে পড়া কোমলমতি শিশু কিশোরদের উপর- যা আত্মহত্যার মত জঘন্য পন্থাকে ত্বরান্বিত করে। দীর্ঘ ১৪ মাস যেন বস্তাবন্দীর মতন ঘরবদ্ধ হয়ে আছে দেশের ভবিষ্যত প্রজন্ম। এই দীর্ঘছুটির যে কুপ্রভাব এখন চলমান তা ধীরে ধীরে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে দেশের প্রত্যেকটি সেক্টর যদি সুন্দর ও পরিশীলিতভাবে পরিচালনা করা যায়, তবে কেন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে তা সম্ভব হয় না? কেন ছাত্র-ছাত্রীরা আজ এ বৈষম্যের শিকার? এই আলোকিত মানুষগুলো এভাবে নিভে যাচ্ছে ধীরে ধীরে- শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত এসব শিক্ষার্থীরা মানসিক ও চারিত্রিক অধঃপতনে পতিত হতে বাধ্য- যার আভাস দেখা যাচ্ছে। আর এদিকে হত্যা- ধর্ষণ আর খুনের মহামারিতে যেন ব্যস্ত হয়ে উঠেছে এদেশের মানুষরুপী দুর্বৃত্তরা। লোমহর্ষক ঘটনার ছড়াছড়ি যেন সবখানেই। ঢাকার পল্লবীতে সাবেক এক এমপির নির্দেশে প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় মাহিন উদ্দিন নামের এক তরতাজা যুবককে, যা অনলাইন ভিডিওতে ঘটনাটি বিশ্ববাসী দেখেছে। পাশবিক কায়দায় এই হত্যাযজ্ঞ মানুষকে যেন পশুর পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। কোন পশু অন্য পশুকে এভাবে কচুকাটা করে হত্যা করেনা- যা মানুষ করে, ‘অবশ্যই আমি মানুষকে সুন্দরতম অবয়বে পয়দা করেছি, তারপর (অকৃতজ্ঞতার কারণে) আমি তাকে সর্বনিম্নস্তরে নিক্ষেপ করবো’ সূরা আত্‌ তীন-৫। আজ যদি বাংলার প্রতিটি ঘরে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিধান আল-কোরানের আয়াত পড়া হত এবং সে বিধান মতে নিজের পরিবার- পরিজন, সংসার পরিচালনা হত- তাহলে এই পাশবিক কায়দায় হত্যার চিন্তা কখনো কারো মাথায় আসত না। পিতা-মাতারা যদি সন্তানদের আল্‌-কোরানের শিক্ষায় শিক্ষিত করতেন তাহলে এরা বড় হয়ে এধরনের জঘন্য কর্মকান্ড অংশ নেওয়ার সাহস পেত না। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের দৃশ্য সারাদেশ তথা পুরো বিশ্বকে কাঁপিয়ে তুলেছে। একজন সাবেক আইন প্রণেতা যদি হত্যাকান্ডের মত নৃশংস কর্মকান্ডের সাথে জড়িত থাকতে পারে- তাহলে উনি কিভাবে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আইনপ্রণেতা হলেন? এটি এখন ভাববার বিষয়। দুনিয়ার খ্যাতি, লোভ লালসা আমাদের চরিত্রকে কলুষিত করছে দিন দিন। এই অবস্থায় পৃথিবীর মায়ার টানে যেন পুরো দেশ দৌঁড়াচ্ছে। ক্ষণিক আরাম আয়াশের আতিশয্যে বিলিয়ে দিয়েছে নিজেকে এদেশের কিছু বিপদগামী মানুষ। যুগে যুগে এই ধরনের অবাধ্য জাতিকে মহান আল্লাহতায়ালা ধ্বংস করেছে অত্যন্ত নির্মম ভাবে। একদিকে তরুণ প্রজন্ম শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যত কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে আর অন্যদিকে রক্ত পিপাসু হায়েনারা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র, এসব হায়েনাদের কাছে পুরো দেশ জিম্মি। পল্লবীর ঘটনায় শুধু নয়, চট্টগ্রামের নাজিরহাটেও ঘটেছে এক নির্মম ও ভয়ংকর হত্যাকান্ড। জনৈক গৃহবধূকে পূর্ব পরিচিত এক ইলেক্ট্রিশিয়ান কুপিয়ে হত্যা করেছে। এর চেয়ে আরো জঘন্য যে সংবাদ আমাদের সামনে এসেছে তা হল চৌকস পুলিশ অফিসার পরকিয়ার প্রেমে পড়ে নিজের স্ত্রীকে ভাড়াটে খুনি দ্বারা খুন করতে পিছ পা হননি। সেই আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আকতারের এহেন কর্মকাণ্ড সারাদেশকে করেছে বিস্মিত, হতবাক। এধরনের হাজার হাজার, লাখ লাখ সংবাদ আবহমানকাল থেকে হয়ে আসছে এই দেশের ভূ-খন্ডে। আমাদের জীবনটা অতীব সংকীর্ণ। ‘(কিনু্ত) কারো (নির্ধারিত) ‘সময়’ যখন এসে যাবে, তখন আল্লাহ তায়ালা কখনোই তাকে (এক মুহূর্ত) অবকাশ দেবেন না; তোমরা (দুনিয়ার জীবনে) যা কিছু করছো, আল্লাহ তায়ালা সে সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত রয়েছেন’ সূরা আল্‌-মোনাফেকুন-১১। এই অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবনের মায়া আমাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখেছে আল্‌-কোরানের আয়াত থেকে। যে আয়াতের মাঝে রয়েছে শান্তির ফল্গুধারা, মানবিক সমস্যাসংকুল জীবনের একমাত্র সমাধান। পরকালীন জীবনে আযাবের ভয় আমাদের কখনো চিন্তিত করে না। শুধুমাত্র এই বিধানকে অনুকরণ ও অনুসরণ না করার কারণে মানুষ পাশবিক হয়ে উঠে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে, হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠে- সবটুকু নৈতিক অবক্ষয়ের ফসল। আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেছে নৈতিকতার অদম্য আবহ, খোদাভীতি, সুস্থ মানবিকতা। আল্লাহর কালামের প্রতিটি হরফ গেঁথে দিতে হবে মানব দেহের প্রতিটি কোষে। প্রতিটি আয়াতকে রোপণ করতে হবে দুনিয়ার জমিনে। পুরো শরীরকে কোরানময় করার নিত্য প্রচেষ্টায় অবতীর্ণ হতে হবে- এটাই এই যুগের দাবি। আর এর ব্যত্যয় ঘটলে পুরোজীবনটাই হয়ে উঠবে দূর্বিষহ, সংঘাতময়। আখেরাতের জীবনে আর আফসোস করে লাভ হবে না। জাহান্নামের অগ্নি গহব্বরে নিক্ষিপ্ত হতে হবে এসব পাশবিক দুর্বৃত্তদের। আজ অভিভাবকদের প্রতি আমার একটি অনুরোধ, আপনার সন্তানদের নৈতিক বলয়ে সুশিক্ষিত করুন। আর সেটি সম্ভব পৃথিবীর আকাশের নিচে আর জমিনের উপর একমাত্র সত্য কিতাব আল-কোরানের আয়াতের মাধ্যমে আর সুবিন্যস্ত ভাবে বিড়বিড় করে আত্নস্থ করুন মহাকাশ আর মহাজগতের সর্বজ্ঞানী মহাপ্রতাপশালী, বিশ্ব নিয়ন্ত্রক আল্লাহ তায়ালার সেই অমোঘ বাণী, ‘হে ঈমানদার লোকেরা, তোমরা নিজেদের ও নিজেদের পরিবার পরিজনদের (জাহান্নামের সেই কঠিন) আগুন থেকে বাঁচাও, তার জ্বালানি হবে মানুষ আর পাথর, (সে) জাহান্নামের (প্রহরা যাদের) ওপর (অর্পিত) সেসব ফেরেশতা সবাই হচ্ছে নির্মম ও কঠোর, তারা আল্লাহর কোনো আদেশই অমান্য করবে না। তারা তাই করবে যা তাদের করার জন্য আদেশ করা হবে’ সূরা আত্‌ তাহরীম- ৬।
লেখক: সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রযুক্তিগত সুবিধার আওতায় আনা হোক সকল শিক্ষার্থীকে
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম পাহাড় সুরক্ষার হাল-হকিকত