বৈশ্বিক করোনা সমস্যার কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনীতিতে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে যে অর্থনৈতিক ধাক্কা শুরু হয়েছে সেই ধাক্কায় একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের অধিকাংশই বেশী ক্ষতিগ্রস্ত। প্রয়োজনীয় মূলধনের অভাবে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা অনেকের জন্য কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আবার অনেকে বিভিন্নভাবে ঋণগ্রস্ত হয়ে অসহায় হয়েছে। আমাদের দেশের পোশাক খাতের অবদান অনস্বীকার্য। করোনাকালে দেশে গরিব লোকের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। দারিদ্র্যের হার সাড়ে ১২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়েছে। পরিবার প্রতি আয় কমেছে প্রায় চার (৪) হাজার টাকা, করোনার প্রভাবে অনেকে চাকরি হারিয়েছে। কর্মহীন হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। ৮০-৯০ শতাংশ ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে দিন দিন। ৫০ শতাংশ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। পণ্যের চাহিদাও কমেছে। শিল্প- কারখানায় বিনিয়োগ ও উৎপাদন কমেছে। সারা দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিল্প, কল-কারখানাগুলো হিমসিম খাচ্ছে। তৈরি পোশাকের উৎপাদন অর্ধেকের বেশি কমেছে। সারা বছর ধরে আমাদের বিপনী-বিতান গুলোতে কম বেশি কেনাবেচা হয়ে থাকে। কিন্তু করোনাকালে অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে কেনাবেচাতে ধস নামে। দিনের পর দিন বিপনী বিতানগুলো বন্ধ থাকে। অনেকেই চাকরিচ্যুত হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ দিয়ে ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিয়ে আসছেন। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর সময়োপযোগী দিক নির্দেশনা ও প্রণোদনামূলক সঠিক কার্যক্রম ব্যবসায়ীদের ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করেছে।
করোনা প্রাদুর্ভাবে প্রথম থেকে মানুষের মধ্যে এক ধরনের নৈতিক ও মানবিক চেতনা জাগ্রত হতে থাকে। মানুষ বিশ্বাস করত মানুষের ক্ষমতা সীমাবদ্ধ। সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছার উপর প্রতিটি ক্ষণ অতিবাহিত হয়। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হচ্ছে মানুষ। বিবেক ও বিচারবুদ্ধির জন্য মানুষকে এই মহান মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু মানুষই তার বিবেক বুদ্ধি বিচারের মত শ্রেষ্ঠ ক্ষমতার অপব্যবহার করে আসছে। ক্ষমতার সার্বভৌম অপব্যবহার করে নিজের গন্তব্যে পৌঁছতে চায়। আমাদের স্বাবলম্বী মানুষের সংখ্যা অনেক। করোনার কারণে যেখানে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে স্থবিরতা বিরাজ করছে সেখানে আমাদের দেশের কিছু কিছু ক্ষেত্রে অন্যায়ের চরম প্রতিফলন দেখা যায়। কৃত্রিম সংকটের মাধ্যমে নিত্য ব্যবহার ও খাদ্য দ্রব্যাদির দাম বাড়ানো হয়। যেখানে মানুষ দিনের পর দিন কর্মহীন ও উপার্জনহীন দিন কাটছে সেখানে বড় বড় ব্যবসায়ী দেশে কৃত্রিম সংকটে ব্যস্ত ছিল। অথচ যারা এই ধরনের তাদের নিজেদের জমানো অর্থ-সম্পদ সম্পর্কে তাদের নিজের হিসাব নেই তাদেরকে আরো লোভী ও স্বার্থপর করে তোলে। কিন্তু দারিদ্র্যপীড়িত এই সমাজের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের জীবন ও জীবিকা আরো বেশি অসহনীয় হয়ে উঠে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে অনেকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। মানবিক ও ধর্মীয় দিক বিবেচনায় অনেকে এগিয়ে আসে। কিন্তু এই বিশাল জনসংখ্যার জন্য সেই সাহায্য খুবই নগণ্য ছিল। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিও এই করোনাকালে একই রকম ছিল। দোষারোপের রাজনীতি ও দলীয় কর্মীদের অপতৎপরতা সঠিকভাবে ত্রাণ বিতরণে বাধাগ্রস্ত করে।
করোনার এই দুযোগপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশের মানুষের আস্থা দিন দিন বাড়তে থাকে। উন্নত দেশগুলোতে ব্যাপকহারে করোনা ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুহার দিন দিন বাড়তে থাকে। বিশেষ করে উন্নত দেশের মানুষের মৃত্যুর পরিমাণ সারা বিশ্বকে হতবাক করে দেয়। অনেক বেশি অর্থনৈতিক সক্ষমতা ও বৈজ্ঞানিক দক্ষতা উন্নত বিশ্বের মৃত্যুর মিছিলকে থামাতে পারেনি। সকল ধর্মের মানুষের মধ্যে এটা ছড়িয়ে পড়ে। দেশের পর দেশ জাতির পর জাতি ও বিভিন্ন ধর্মের মানুষ নিরাপদ টিকার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। নিরাপদ টিকার উদ্ভাবনের জন্য উন্নত বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সেই প্রথম থেকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক ট্র্যায়ালের পর এখনো নিরাপদ কোন টিকা অবিষ্কার করতে পারেনি। তবুও কেউ আশা ছাড়েনি। যথার্থতার উচ্চতম পর্যায়ে না পৌছলেও কিছু কিছু টিকাকে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা অনুমোদন দিয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা থাকলেও টিকার উৎপাদনকারী দেশগুলো বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষের জন্য টিকা উৎপাদন করতে উদ্যোগ নিয়েছে। এই করোনা কালে মানবিক দিক বিবেচনায় অনুন্নত দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য বিনামূল্যে ও স্বল্পমূল্যে টিকা দিতে রাজী হয়েছে। আবার অনেক দেশ নিজ উদ্যোগেই টিকা সরবরাহ করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কারণে এই বিশ্বকে করোনামুক্ত করতে হলে সবাইকে নিরাপদ রাখতে হবে। চীনের উহান প্রদেশে করোনার সৃষ্টি হলেও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বিশ্বকে করোনা মুক্ত করতে হলে সারা বিশ্বের মানুষের জন্য নিরাপদ টিকা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বের ইতিহাসে এই ধরনের মহামারী আগে অনেকবার হয়েছে। প্রায় ১০০ (একশত) বছর পর পর এই ধরনের মহামারী হয়ে থাকে। আমাদের পবিত্র কোরআন শরীফেও এর উল্লেখ আছে। সূরা বাকারাতে উল্লেখ আছে, যে যেখানে আছে সেখানে থেকেই মহামারী থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করার নিদের্শনা আছে। আর যারা মহামারীতে মৃত্যু বরণ করেছে তাদেরকে শহীদের মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। সব কিছু জানার পরেও মানুষ কোন কোন ক্ষেত্রে অবিবেচকের মত কাজ করে যাচ্ছে। মানুষ নিজেকেই সবচেয়ে বেশি ভালবাসে। তাই বেঁচে থাকার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যায়। এই করোনার ফলে নিকটতম পরম আত্মীয়ের বিপদে ও মৃত্যুতে তেমন কেউ এগিয়ে আসেনি। নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য সকলের মধ্যে চেষ্টা ছিল এখনো আছে। করোনা আক্রান্ত পরিবারগুলোকে কোন ধরনের ঘৃণা ও উপহাস না করে সহানুভূতি ও সমবেদনা প্রকাশ করা শ্রেয়। টিকা সরবরাহ ও প্রয়োগ সঠিকভাবে করতে পারলে আগামী দিনগুলোতে করোনার ভয়াবহতা কমে যেতে পারে। সব ধরনের ভয়ভীতি ছড়িয়ে এখন সবাই উৎসবমুখর পরিবেশে টিকা দিচ্ছে। টিকা নিয়ে কোন ধরনের অপরাজনীতি ও কৃত্রিম সংকট ভেজাল করোনামুক্ত বিশ্ব তৈরীতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। নিরাপদ ও সঠিক টিকা উৎপাদনকারী ১ম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশের জন্য উন্নত দেশগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল। উৎপাদনকারী ১ম দেশের মর্যাদা লাভের জন্য বিশ্বের উন্নত দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা বার বার নিজের দেশের অবস্থানকে দাবি করছে। অন্যদিকে ভেজাল টিকা সরবরাহ করার জন্য বিশ্বব্যাপী অসাধু ব্যবসায়ীরা তৎপরতা চালাচ্ছে। এমতবস্থায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বার বার সতর্ক করে যাচ্ছে। তবুও বিশ্ববাসী নিরাপদ বিশ্বের জন্য প্রার্থনা করে যাচ্ছে। একদিন বিশ্ব করোনা মুক্ত হবে। করোনার শিক্ষা নিয়ে নতুন বিশ্ব গড়বে। প্রকৃতি তার নিজের নিয়মে চলবে। অন্যথায় প্রকৃতি বার বার প্রতিশোধ নিবে।
লেখক : কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডাঃ ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম