পাকিস্তানের করাচির সাথে চট্টগ্রামের সরাসরি জাহাজ চলাচল দেশের আমদানিকারকদের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রামে আসা জাহাজে আমদানি পণ্য ছিল ৩২৮ টিইইউএস। ৩৮ দিনের মাথায় দ্বিতীয় ভয়েজে তা প্রায় তিন গুণের কাছাকাছি ঠেকেছে। গতকাল দ্বিতীয়বারের মতো করাচি থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে আসা জাহাজটিতে ৮২৫ টিইইউএস কন্টেনার রয়েছে। এর মধ্যে সরাসরি করাচি থেকে আসে ৭১২ কন্টেনার। এসব কন্টেনারে রয়েছে ভোগ্যপণ্য, গার্মেন্টস এক্সেসরিজসহ বিভিন্ন ধরনের মালামাল।
করাচি–চট্টগ্রাম সরাসরি জাহাজ চলাচল পাকিস্তান থেকে পণ্য আনা–নেওয়া অনেক সহজ ও স্বস্তিদায়ক করেছে বলে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, একটি নতুন সোর্স তৈরি হওয়ায় আমদানিকারকদের মাঝে উৎসাহ দেখা দিয়েছে। এই রুটে জাহাজ বাড়ানোর কথাও ভাবছে শিপিং কোম্পানি। দ্বিতীয় জাহাজ চলাচল শুরু হলে ৩৮ দিনের পরিবর্তে প্রতি ২০ দিনে করাচি–চট্টগ্রাম ভয়েজ সম্পন্ন হবে।
জানা যায়, দুবাই থেকে পাকিস্তানের করাচি হয়ে আসা এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং নামের কন্টেনার জাহাজটি গত রাতে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পৌঁছেছে। আজ রোববার সকালের জোয়ারে জাহাজটিকে নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালের দুই নম্বর বার্থে বার্থিং দেওয়া হবে। দেশের ইতিহাসে এমভি ইউয়ান জিয়ান ফা ঝং প্রথম জাহাজ, যেটি পাকিস্তানের করাচি থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে এসেছিল গত ১১ নভেম্বর। ৩২৮ টিইইউএস পণ্য নিয়ে আসা জাহাজটি ১২ নভেম্বর বন্দর ছেড়ে গিয়েছিল। প্রথম ভয়েজে জাহাজটি সংযুক্ত আরব আমিরাত হয়ে প্রথমে পাকিস্তান এবং পরে সেখান থেকে সরাসরি চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছে। ওই সময় জাহাজটিতে সোডা অ্যাশ, ডলোমাইট চুনাপাথর, ম্যাগনেশিয়াম, ভাঙা কাচ, গার্মেন্টসের কাঁচামাল, কাপড়, রং, গাড়ির যন্ত্রাংশ, পেঁয়াজ, আলু, খেজুর, জিপসাম, পুরনো লোহার টুকরা, মার্বেল ব্লক, কপার ওয়্যার, রেজিন, হুইস্কি, ভদকা ও ওয়াইন নিয়ে এসেছিল।
গতকাল জাহাজটি দ্বিতীয়বারের মতো চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছায়। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের জন্য ১১৩ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে জাহাজটি প্রথমে পাকিস্তানের করাচি বন্দরে পৌঁছে। ওখান থেকে ৭১২ টিইইউএস কন্টেনার নিয়ে জাহাজটি গত ১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের পথ ধরে।
এবার জাহাজটিতে প্রথমবারের চেয়ে প্রায় তিন গুণ কন্টেনার রয়েছে উল্লেখ করে শিপিং এজেন্সি সূত্র জানিয়েছে, জাহাজটিতে থাকা ৮২৫ টিইইউএস কন্টেনারের মধ্যে ২৮৫ টিইইউএস কন্টেনারে পরিশোধিত চিনি, ১৭১ টিইইউএস কন্টেনারে ডলোমাইট, ১৩৮ টিইইউএস কন্টেনারে সোডা অ্যাশ, ৪৬ টিইইউএস কন্টেনারে গার্মেন্টসের কাপড়ের রোল, ২০ টিইইউএস কন্টেনারে আখের গুড়, ১৮ টিইইউএস কন্টেনারে আলু এবং ২০ টিইইউএস কন্টেনারে পুরনো লোহার টুকরা, রেজিন ও কাপড় রয়েছে। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জাহাজটিতে বোঝাই করা কন্টেনারে খেঁজুর, লুব অয়েল, মার্বেল পাথরসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে। জাহাজটি আজ বন্দরের নিউমুরিং কন্টেনার টার্মিনালে বার্থিং নেবে। পণ্যগুলো খালাসের পর জাহাজটি ফিরতি পথে ১২শ টিইইউএস পণ্য বোঝাই ও খালি কন্টেনার নিয়ে আগামী ২৪ ডিসেম্বর বন্দর ছেড়ে যাবে।
পাকিস্তান থেকে সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় ব্যাপক আলোচনা হয়। অনেকে বিষয়টি নিয়ে মিথ্যা প্রচারণা চালায়। পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্য চলে আসছে অনেক আগে থেকে। তবে এতদিন দুই দেশের মধ্যে সরাসরি কোনো জাহাজ চলাচল ছিল না। ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্ট হয়ে তৃতীয় কোনো দেশ থেকে পণ্য আনা–নেওয়া করা হতো। এতে ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে জাহাজ ধরার বিষয় ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের উদ্বেগের বড় কারণ ছিল। ট্রান্সশিপমেন্ট পোর্টে চার দিন থেকে এক মাস পর্যন্ত পণ্য আটকা পড়ে থাকার ঘটনা ঘটত। এতে গার্মেন্টস ব্যবসায়ীদের বড় ধরনের ক্ষতির কবলে পড়তে হতো।
সরাসরি জাহাজ চলাচল শুরু হওয়ায় এখন করাচি থেকে কোনো কন্টেনার বোঝাই করা হলে তা চট্টগ্রামে নির্দিষ্ট দিনে পৌঁছার এবং চট্টগ্রাম থেকে ফিরতি পথেও নির্ধারিত সময়ে করাচি পৌঁছা নিশ্চিত হওয়ায় ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের অস্বস্তি কেটে গেছে বলে মন্তব্য করেছেন একাধিক ব্যবসায়ী। তারা বলেন, গার্মেন্টস এক্সেসরিজ বা ভোগ্যপণ্য আমদানির জন্য একটি নতুন সোর্স তৈরি হলো; যা প্রতিযোগিতামূলক দরে পণ্য আমদানির ক্ষেত্র প্রসারিত করবে।
দুবাইভিত্তিক কন্টেনার জাহাজ পরিচালনাকারী সংস্থা ফিডার লাইনস ডিএমসিসি এমভি ইউয়ান জিয়াং ফা ঝং জাহাজ দিয়ে দুবাই থেকে পাকিস্তান হয়ে চট্টগ্রাম পর্যন্ত নতুন রুট তৈরি করে সেবা প্রদান শুরু করে। তারা দুবাই, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের মুন্দ্রা বন্দরকে এই রুটে সংযুক্ত রেখেছে। মুন্দ্রা বন্দর থেকে পণ্য নিতে হলে জাহাজটির এক ভয়েজে ৪২ দিন সময় লাগবে। ভারতের পণ্য না থাকলে সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাত–করাচি–চট্টগ্রাম রুটে চলাচল করলে প্রতি ভয়েজে সময় লাগবে ৩৮ দিন। এক্ষেত্রে অপর একটি জাহাজ বহরে যুক্ত হলে প্রতি ২০ দিনেই এক ভয়েজ সম্পন্ন হবে বলে শিপিং এজেন্সি সূত্র জানিয়েছে।
পানামার পতাকাবাহী ১৮২ মিটার দৈর্ঘ এবং ৩০ মিটার প্রস্থের ৮.১ মিটার ড্রাফটের জাহাজটির স্থানীয় এজেন্ট কর্ণফুলী লিমিটেডের সহযোগী প্রতিষ্ঠান রিজেন্সি লাইনস লিমিটেড। গ্রুপটির নির্বাহী পরিচালক আনিস উদ দৌলা গতকাল আজাদীকে বলেন, করাচি–চট্টগ্রাম জাহাজ চলাচল ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি বৃদ্ধি পেয়েছে। ব্যবসায়ীরা আরো খোঁজখবর নিচ্ছেন। তাদের অতীতের ভোগান্তি এই একটি জাহাজ চলাচলের মাধ্যমে দূর হয়েছে। পাকিস্তান থেকে পণ্য আমদানি করে সময়মতো হাতে পাওয়ার যে অনিশ্চয়তা ছিল সেটি কেটে গেছে। আমাদের প্রিন্সিপ্যালের সাথে কথা হয়েছে। পণ্য আমদানি বাড়লে এই রুটে তারা দ্বিতীয় জাহাজের চলাচল শুরু করবে। তাতে আরো কম সময়ে করাচি–চট্টগ্রাম রুটে পণ্য আনা– নেওয়া সম্ভব হবে। এতে ব্যবসায়ীদের খরচ আরো সাশ্রয় হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, জাহাজটি বহির্নোঙরে পৌঁছেছে। এটিকে আজ বন্দরের এনসিটিতে বার্থিং দেওয়া হবে।