কর ত্রাণ মহাপ্রাণ আন অমৃতবাণী

মহাত্মা গান্ধীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি

রীতা দত্ত | শুক্রবার , ২ অক্টোবর, ২০২০ at ৫:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অহিংসা, সত্যনিষ্ঠা, শুদ্ধতা, সমদর্শিতার মূর্ত প্রতীকমহাত্মা গান্ধী। তাঁর পুরো নাম মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। ১৮৬৯ এর ২ অক্টোবর ভারতের গুজরাতে পোরবন্দরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। গোন্দলের এক সংর্বধনায় পন্ডিত শ্রীজীবরাম কালিদাস তাঁকে সর্বপ্রথম “মহাত্মা” হিসাবে ঘোষণা দেন। মহৎ আত্মার অধিকারী যিনি তিনিই মহাত্মা। পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ অনেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে “মহাত্মা” সম্বোধন করেন। গান্ধীজী তাঁর জীবনীতে অহিংসা সম্পর্কে বলেন, আমি যখন হতাশ হই, আমি স্মরণ করি সমস্ত ইতিহাসে সত্য এবং ভালোবাসারই জয় হয়েছে।” অশনেবসনে অত্যন্ত সরল এবং অনাড়ম্বর জীবন যাপন করেছেন তিনি। আজীবন অহিংসা নীতি অনুসরণে গান্ধীজীর নিরলস প্রচেষ্টার জন্য জাতিসংঘ ২০০৭ সালের ১৫জুন মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিন ২ অক্টোবরকে আন্তর্জাতিক অহিংসা দিবস পালনের ঘোষণা দেন। হিংসায় উন্মত্ত এ পৃথিবীতে গান্ধীজীর অহিংসা নীতি আমাদের পথনির্দেশক হোক। তাঁর দেশপ্রেম, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, নির্ভীকতা সর্বোপরি মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসার জন্য তিনি ভারতের ‘‘জাতির পিতা” এ সম্মানে ভূষিত হন। পরাধীন ভারতবর্ষকে ইংরেজ শাসনমুক্ত করার জন্য তাঁর অনুসৃত অহিংসা নীতি, সত্যাগ্রহ,অসহযোগ আন্দোলন, আইন অমান্য আন্দোলন যা পরবর্তীতে তাঁকে ভারতের অবিসংবাদী নেতাতে পরিণত করেছিল। তিনি মনে করতেন স্বরাজ কেবল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়া নয়। সত্য পথে অহিংসার পথে ন্যায় নীতিতে নিষ্ঠ থাকায় প্রকৃত স্বরাজ। ন্যায়নীতি ও সত্য প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতে বেশ কয়েকবার তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছিল।

শৈশবে বাবা করমচাঁদ গান্ধীর কিনে দেওয়া দুটি নাটকের বই “শ্রবণের পিতৃভক্তি” এবং ‘‘রাজা হরিশচন্দ্র’’ নাটকের রাজা হরিশ চন্দ্রের সত্যনিষ্ঠার কাহিনী গান্ধীজীর জীবনে গভীর রেখাপাত করেছিল যা তাঁকে সামনের দিকে এগিয়ে যাবার প্রেরণা যুগিয়েছিল। মা পুতুলীবাঈ ছেলেকে রামায়নের গল্প শোনাতেন। রামচন্দ্র পিতৃসত্য পালনের জন্য ধন সম্পদ, রাজ সিংহাসন সব কিছু ত্যাগ করে বারো বছর বনবাসী হয়েছিলেন। রামচন্দ্রের এ ত্যাগ তিনি অনুসরণ করেছেন এবং আজীবন রামভক্ত থেকেছেন। রাজকোটে তাঁর বাড়িতে ঢুকতেই চোখে পড়ে এই লেখাটি, “রঘুপতি রাঘব রাজা রাম,পতিত পাবন সীতারাম। ঈশ্বর আল্লাহ তেরে নাম সব কো সুমতি দে ভগবান”। মা পুতুলীবাঈ ধর্মপ্রাণ ছিলেন কিন্তু তাঁর ছিল যুক্তিনিষ্ঠ মন। গান্ধীজী ম্যাট্রিকুলেশেন পাশের পর যখন বিলেতে গিয়ে ব্যারিস্টারী পড়ার সিদ্ধান্ত হয় তখন রক্ষণশীল পরিবারের আত্মীয় স্বজনেরা বাধ সাধলেন কিন্তু মা পুতলীবাঈ সানন্দে অনুমতি দিলেন এবং আশীর্বাদ করলেন ছেলেকে। মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন ধর্মের উদারতা। অল্প বয়স থেকে রামভক্ত হয়েও তিনি কখনো ধর্মীয় সংকীর্ণতার পরিচয় দেননি। তিনি বলতেন, রামকে ভালোবাসি বলে রহিম বা র‌্যামসেনকে দূরে সরিয়ে দেবো এমন দলে আমি ভিড়িনি। যিনি প্রকৃত ধার্মিক তিনি কখনো সংকীর্ণ হতে পারে না। ছোটবেলা থেকে তিনি জেনেছেন সব ধর্মের সত্য আছে, কোন ধর্মকে মানুষকে তুচ্ছ করা যাবে না। তাই তিনি হিন্দু সমাজে প্রচলিত প্রান্তিক অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে অস্পৃশ্য না বলে “হরিজন”আখ্যা দিয়েছেন। হরিজন অর্থাৎ ঈশ্বরের সন্তান। তিনি মনে করতেন এ অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজদেহের পচা অংশ, এ অংশকে বাদ দিতে হবে।

১৮৮৮ সালে ব্যারিস্টারী পড়ার উদ্দেশ্যে তিনি বিলাত গমন করেন। ১৮৯১ সালে ব্যারিস্টার হয়ে দেশে ফিরে আসেন। চির লাজুক নম্র স্বভাবের ছেলে গান্ধী ওকালতি পেশায় তেমন সুবিধা করতে পারলেন না। হঠাৎ একটা সুযোগ এলদাদা আবদুল্লাহ এন্ড সন্সের আইনজীবী হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকায় যেতে রাজী হলেন। ১৮৯৩ সালে তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় রওনা হলেন। শুরু হল তাঁর জনহিতকর কাজের অভিযান – ‘‘মহাত্মা’’ এবং ‘‘জাতির জনকে’’ রূপান্তরিত হবার সূচনা। ব্যক্তিগত জীবন, রাজনীতি, সমাজ, ধর্মীয় জীবন সর্বক্ষেত্রে তিনি অহিংস নীতি অনুসরণ করেছেন। তখন ইংরেজ শাসনদক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের উপর চলত অমানুষিক নির্যাতন, শোষণ আর গঞ্জনা। গান্ধীজী নিজেও অপমানের শিকার হয়েছেন। তাঁকে কুলিব্যারিস্টার হিসাবে আখ্যায়িত করা হোত। রেলগাড়ির প্রথম শ্রেণির টিকেট কিনেও তাঁকে তৃতীয় শ্রেণির কামরায় বসতে বাধ্য করা হয়েছে, হোটেলে থাকার জায়গা পাননি। সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকায় ভারতীয়দের ভোটাধিকার ছিল না। গান্ধীজী এ অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে অহিংস,শান্তিপূর্ণ নাগরিক আন্দোলনের আদর্শ প্রয়োগ করেন। ১৮৯৪ সালে নাটাল ইন্ডিয়ান কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এ সংগঠনের মাধ্যমে সেখানকার ভারতীয়দের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করেন । তিনি বিশ্বাস করতেন, হিংসার বদলে হিংসা নয়, অহিংস সত্যাগ্রহই হবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার একমাত্র অস্ত্র। ‘‘অহিংসা পরম ধর্ম’’ এবং ‘‘সত্যের জয় নিশ্চিত’’ এ দুটি শব্দ পরস্পরের পরিপূরক। দক্ষিণ আফ্রিকার অভিজ্ঞতা তাঁকেঅসমসাহসী এবং নির্ভীক করে তুলেছিল। ১৯১৮ সালে প্রায় একুশ বছর দক্ষিণ আফ্রিকায় কাটিয়ে গান্ধীজী ভারতে ফিরে আসেন। ভারতে ফিরে এসে দেশব্যাপী দারিদ্র দূরীকরণ, নারী স্বাধীনতা, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে সম্প্রতি স্থাপন, বর্ণবৈষম্য দূরীকরণ, অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা দূর করার জন্য প্রচার শুরু করেন। তখন ভারতে বৃটিশ শাসনদেশবাসীর উপর নিপীড়ন, অত্যাচার পুরোমাত্রায় চলছে। আর চলছে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন। বিপ্লবীদের কারাবরণ। ভারতবাসীর মুক্তির সংগ্রামে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরী করতে শুরু করলেন। ভারতবর্ষের সব নেতার সাথে যে গান্ধীজীর সব বিষয়ে মতৈক্য হোত তা নয় তবে দলমত নির্বিশেষে সবাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় আনত ছিলেন। ১৯২০ সালে বালগঙ্গাধর তিলকের মৃত্যুর পর গান্ধীজী কংগ্রেসের হাল ধরলেন। হিংসা এবং সত্যাগ্রহ এর আদর্শ নিয়ে আন্দোলন চালাতে লাগলেন। রবীন্দ্রনাথের গান গান্ধীজীর এগিয়ে যাবার প্রেরণা ছিল । ঈশ্বরের কাছে তাঁর প্রাথর্না “জীবন যখন শুকিয়ে যায়, করুণাধারায় এসো।” আর যে গানটি তাঁকে শক্তি যোগাতো এবং তিনি শুনতে পছন্দ করতেন সেইটি হোল “যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে, তবে একলা চলো রে ”।

সে সময় ভারতবর্ষে নীল চাষ হোত। বিহারের চম্পারণ জেলার নীলকর সাহেবদের অত্যাচারে নীল চাষীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠছিলো কিন্তু সেখানকার ইংরেজ ভক্ত শিক্ষিত সমাজ এ ব্যাপারে সচেতন ছিলেন না। গান্ধীজী চম্পারণ পৌঁছুলে সেখানকার জেলা প্রশাসক তাঁকে ফিরে যেতে বলেন। গান্ধীজী জানালেন, তিনি এখানে এসেছেন মানবিকতার চাপে, দেশ সেবার জন্য। গান্ধীজীর আহ্বানে হাজার হাজার চাষী ছুটে আসতে লাগলো। একদিকে গান্ধীজী আরেক দিকে হাজার হাজার নিপীড়িত মানুষ। শেষ পর্যন্ত সরকারের হস্তক্ষেপে চাষীদের অবস্থার পরিবর্তন হোল। অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের যে শক্তি দক্ষিণ আফ্রিকায় সফল হয়েছিল তা চম্পারণে প্রতিষ্ঠিত হোল। আত্মার শক্তিতে বলীয়ান গান্ধীজী সফল হলেন। ১৯১৯ সালে জালিওয়ানওয়ালা হত্যাকান্ড এবং রাউলাট আ্যাক্ট কে সরকারী নির্যাতনের প্রমাণরূপে চিহ্নিত করে এর প্রতিবাদে গান্ধীজী অহিংস সত্যাগ্রহ শুরু করেন। ১৯২০ সালে শুরু করলেন বৃটিশ সরকাররে বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন। গান্ধীজীর অহিংসা ও সত্যাগ্রহ হলো অন্যায় ,অবিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে শান্তিপূ্‌র্ণ বিদ্রোহ। অসহযোগ আন্দোলনের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে আরো একটি আন্দোলন। খিলাফত আন্দোলন। তুরস্কের মুসলমানদের সাথে ইংরেজ সরকারের বৈরিতা ভারতবর্ষের মুসলমানদের ক্ষেপিয়ে তুলেছিল। মুসলিম নেতারা খিলাফত আন্দোলনের ডাক দিলেন। আলীভ্রাতৃদ্বয় (মওলানা মুহম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলি) খেলাফত ইশতেহার ঘোষণা করলেন। যুক্ত হলেন আবুল কালাম আজাদ, . এম, এ আনসারী সহ আরো অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। (চলবে) লেখক : প্রাবন্ধিক; সাবেক অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযানজট নিরসন প্রসঙ্গে
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা