কমেছে এলসি খোলার পরিমাণ

আজাদী প্রতিবেদন | বৃহস্পতিবার , ২১ জুলাই, ২০২২ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

বিভিন্ন ব্যাংকে এলসি (লেটার অব ক্রেডিট বা ঋণপত্র) খোলার পরিমাণ কমে গেছে। ডলার সংকটে বিভিন্ন ব্যাংক এলসি খুলতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। একই সাথে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর চাপ কমাতে অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণেও এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে। গাড়িসহ বিলাসদ্রব্য আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিন করে দেয়ার পর এসব পণ্য আমদানি কার্যতঃ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পথে। অপরদিকে ডলারের অভাবে বিভিন্ন ব্যাংক এলসি খুলতে অনাগ্রহ দেখিয়ে ছয় মাসের সময় নিয়ে ইউপাস এলসি খোলার পরামর্শ দিচ্ছে। এলসি খোলার পরিমাণ কমে যাওয়ায় স্বাভাবিক ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বব্যাপী ডলার সংকট প্রকট। ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধ এবং আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাসহ নানা প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বিশ্বের অর্থনীতিই টালমাটাল। মারাত্মক রকমের নাজুক পরিস্থিতিতে প্রায় প্রতিটি ব্যাংকই ডলারের অভাবে রয়েছে। গত বছরের আগস্ট মাস থেকে দেখা দেয়া এই সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক নানাভাবে চেষ্টা করে। কিন্তু গত মার্চ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের উপর থেকে নিয়ন্ত্রণ তুলে নেয়। এরপর থেকে বাড়তে থাকে ডলারের দাম। ডলারের বিনিময়ে দফায় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন ঘটতে থাকে। প্রতিটি ডলারের বিনিময় হার একশ টাকা ছাড়িয়ে যায়। অবশ্য পরবর্তীতে ডলারের দাম একশ টাকার নিচে নেমে এলেও স্বাভাবিক প্রবাহ ফিরেনি। ব্যাংকগুলো ডলারের অভাবে ভুগতে থাকে।

ডলার না থাকার কারণে বিভিন্ন ব্যাংক এলসি খোলার ব্যাপারে অনাগ্রহী হয়ে উঠে। এতে করে এলসির পরিমাণ কমতে থাকে। সাম্প্রতিক সময়ে এই সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের এলসি নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। ৫০ লাখ ডলারের বেশি মূল্যের এলসিগুলোর ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক সরাসরি নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে। এই ধরনের এলসির ক্ষেত্রে যাবতীয় কাগজপত্র চব্বিশ ঘণ্টা আগে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠাতে হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ওই পণ্য আমদানি দেশের স্বার্থে জরুরি কিনা, পণ্যের দামসহ আনুষঙ্গিক বিভিন্ন বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে অনুমোদন দেয়ার পরই কেবল এলসি খোলা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অনুমোদন না দিলে ওই এলসি খোলা সম্ভব হচ্ছে না। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এই ধরনের বেশ কিছু এলসি আটকে দিয়েছে। বিশেষ করে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের বেশ কিছু এলসি আটকা পড়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

অপরদিকে সরকার বিলাস দ্রব্য বা জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানিতে শতভাগ এলসি মার্জিন বাধ্যতামূলক করেছে। অর্থাৎ পণ্যের মূল্য পুরোটাই আমদানিকারককে পরিশোধ করেই এলসি খুলতে হবে। ব্যাংক কোনো ধরনের অর্থায়ন করবে না। ব্যাংক সাপোর্ট ছাড়া শতভাগ মূল্য পরিশোধ করে গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করার মতো ব্যবসায়ী হাতে গোনা। এতে করে এসব পণ্য আমদানির এলসি খোলাও বন্ধ হয়ে গেছে।

বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এলসি না খুলে ইউপাস এলসি খোলার জন্য আমদানিকারকদের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। যাতে আমদানিকারক ৬ মাস বা ১ বছর পর মূল্য পরিশোধ করবে মর্মে অঙ্গীকার করে। তবে এক্ষেত্রে একটি বিদেশি ব্যাংক জড়িত থাকে। কিন্তু আমদানিকারকেরা ইউপাস এলসি খোলার ব্যাপারে আগ্রহী নয়। তারা বলছেন, ডলারের যেই পরিস্থিতি তাতে ইউপাস এলসি খোলা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। একজন আমদানিকারক বর্তমান মূল্যে পণ্য আমদানি করে ডলারের বর্তমান দর হিসেব করে পণ্য বিক্রির মাধ্যমে ব্যবসা করবেন। কিন্তু ইউপাস এলসির পেমেন্ট ৬ মাস পরে দেয়ার সময়কার ডলারের দাম হিসেব করে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। এতে বর্তমানের ডলারের দাম ৬ মাস পরে একই থাকবে কিনা সেটি একটি বড় প্রশ্ন। যদি ডলারের দাম বেড়ে যায় তাহলে বাড়তি অর্থের পুরোটাই সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে লোকসান দিয়ে বিদেশি ব্যাংকের পাওনা পরিশোধ করতে হবে। যা ব্যবসায়ীদের জন্য বেশ বড় ঝুঁকির সৃষ্টি করবে বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, এই অবস্থায় এলসি করা সম্ভব হচ্ছে না। গাড়ি, শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের জাহাজসহ বিভিন্ন খাতের বড় বড় এলসি খোলা প্রায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। একইসাথে ফল, কোমল পানীয়, চকলেট, প্রসাধন সামগ্রী, আসবাবপত্র প্রভৃতির এলসি খোলার হার আগের তুলনায় কমে গেছে বলেও একাধিক ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। গত অর্থবছরের কিছু তথ্য উপাত্তের বর্ণনা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে এলসি খোলার পরিমাণ কমেছে। তবে এলসি খোলা কমলেও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর আমদানি বেড়েছে। বেড়েছে আমদানি ব্যয়ও। বিশ্ববাজারে পণ্য মূল্য বৃদ্ধি এবং জাহাজ ভাড়া বাড়তি হওয়ায় আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭৮৭ কোটি ডলার। আগের অর্থবছরের যার পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। এক বছরের ব্যবধানে ৩৩ শতাংশ বেশি পণ্য আমদানি হয়েছে। টাকার অংকের ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার ২৩২ কোটি ডলার। অপরদিকে ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানি হয়েছে ১৩ কোটি ৯৪ লাখ টন। আগের বছরে (২০২০-২১ অর্থবছর) পণ্য আমদানির পরিমাণ ছিল ১৪ কোটি ৫০ লাখ। পণ্য আমদানি কমে গেছে ৫৬ লাখ টন বা ৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ। ২ হাজার ২৩২ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় করেও পণ্য আমদানি ৫৬ লাখ টন কমে যাওয়ার পেছনে বিশ্ববাজারে পণ্যমূল্য বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়েছে।

আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে বিলাসপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি, ঋণপত্রের মার্জিন শতভাগ করে দেয়াসহ সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার কোনো বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা বলেছেন, পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত লাগামহীন আমদানির সুযোগ দেয়া যাবে না। বিশেষ করে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ পরিস্থিতির উপর শুধু বাংলাদেশেরই নয়, আগামী বিশ্বের অর্থনীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্য নির্ভর করছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচবিতে ছাত্রী হেনস্তার ঘটনায় মামলা, শিক্ষার্থীদের মানববন্ধন
পরবর্তী নিবন্ধউৎপাদন বন্ধ সিইউএফএলে