চট্টগ্রামে বন্যা কবলিত ফটিকছড়ি, হাটহাজারী ও মীরসরাইয়ের পরিস্থিতি ক্রমে উন্নতি হচ্ছে। তিন উপজেলায় পানি কমছে। কিন্তু দুর্ভোগ মানুষের পিছু ছাড়ছে না। পানি নামার সাথে সাথে বেড়েছে দুর্ভোগ। আছে খাবার ও সুপেয় জলের সংকট। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় অনেককে মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
ফটিকছড়িতে ক্ষতিগ্রস্ত ৮ হাজার বসতঘর : ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে সবকিছু। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় ফটিকছড়িতে শতকরা ৩৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। প্রায় সাড়ে ৮ হাজার বসতঘর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
বন্যার পানি কিছুটা কমলেও বাড়িঘর সবচেয়ে বেশি বিধ্বস্ত হওয়ায় এখনও বিপুল সংখ্যক মানুষ নিজের ঘরে ফিরতে পারছেন না। এতে শ্রমজীবী ও দরিদ্র মানুষেরা চরম বিপাকে পড়েছেন। এছাড়া সড়ক, চাষের পুকুর ও গৃহপালিত প্রাণির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি হিসাবে বন্যায় এক লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
উপজেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ অফিসের প্রাথমিক তথ্যমতে, ফটিকছড়িতে ৭টি ইউনিয়ন এবং ১টি পৌরসভায় ৬০০টি বসতঘর সম্পূর্ণ ও ৭ হাজার ৫০০টি বসতঘর আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি সম্পূর্ণ কমে গেলে চূড়ান্ত ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আবুল হোসেন। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো উপজেলার বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি ও ত্রাণ তৎপরতা সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এ তথ্য উল্লেখ করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।
সুয়াবিলের তাহেরা খাতুন বলেন, হালদা নদীর ভাঙনে আমার ঘর পুরোপুরি ভেঙে গেছে। ৫ দিন আমি তাবুতে রাত কাটাচ্ছি। ঘর মেরামত করবো সে টাকাও নেই। আমরা আশ্রয় চাই। আরেক ভুক্তভোগী মো. মিজান বলেন, বন্যার পানিতে ঘরের বেশিরভাগ অংশ ভেঙে পড়েছে। সবগুলো দেয়ালে ফাটল ধরেছে। যেকোন সময় ঘরটি ভেঙে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এ মুহূর্তে ঘর করার মত কোনো অর্থ নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, উপজেলার সকল ইউনিয়ন পরিষদ সচিবদের আগামী ২ দিনের মধ্যে নিজ নিজ ইউনিয়নে যাদের ঘর বাড়ি বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাদের ঘরের ছবিসহ তালিকা প্রদান করতে বলা হয়েছে। তালিকা হাতে পেলেই উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ হতে ক্ষতিগ্রস্ত প্রত্যেক পরিবারকে ঘর মেরামত ও পুনর্বাসনের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে প্রাপ্ত অর্থ থেকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হবে।
হাটহাজারীতে খাবার পানির সংকট : হাটহাজারী প্রতিনিধি জানান, উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তবে বন্যার পানিতে নলকূপ তলিয়ে যাওয়ায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। উপজেলার আওতাধীন অর্ধশতাধিক সড়কে গতকাল সোমবারও গাড়ি চলাচল স্বাভাবিক হয়নি। এছাড়া নিম্নাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আশানুরূপ উন্নতি হয়নি। উপজেলার পূর্ব ফরহাদাবাদ, পূর্ব ধলই, সেকান্দর পাড়া, পূর্ব এনায়েতপুর, মাইজপাড়া, মনোহর পাড়া, উত্তর ছাদেক নগর, পেস্কারহাট, গুমানমর্দ্দন, বালুখালী, সিকদার পাড়া, মুৎসুদ্দি পাড়া, মাস্টার পাড়া, রুদ্রপুর, জিলানী বাজার, কাজিরখীল, মোহাম্মদপুর, মোজাফফরপুর, ভাগিরঘোনা, রহুল্লাপুর, রহিমপুর, মেখল হুজুরের বাড়ি, দক্ষিণ মেখল, ভবনীপুর, হেলাল চৌধুরী পাড়া, মধুরঘোনা, ইছাপুর, গড়দুয়ারা, লোহারপোল, উত্তর ও দক্ষিণ মাদার্শা, রোসাংঙ্গীয়া ঘোনা, বুড়িশ্চরসহ বিভিন্ন গ্রামে এখনো প্রায় লক্ষাধিক লোক পানিবন্দি রয়েছে।
এদিকে উপজেলার গুরুত্বপূর্ণ প্রায় ২০টি সড়ক বন্যা ও ঢলের কারণে ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। জনস্বার্থে এসব সড়ক জরুরি মেরামতের জন্য দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের প্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন স্থানীয়রা।
মীরসরাইয়ে দুই লাখ মানুষ এখনো পানিবন্দি : মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, মীরসরাইয়ে টানা পাঁচ দিনের বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে প্রায় দুই লাখেরও বেশি মানুষ। গতকাল সকাল থেকে কিছু এলাকায় কয়েক ফুট পানি কমেছে। ১১টি ইউনিয়নের শতাধিক গ্রাম এখনো সংকটের মধ্যে।
তবে অনেক গ্রামে এখনো পানিবন্দী প্রায় লাখো অসহায় মানুষ। ফেনী নদীর ভাটিতে অবস্থিত দেশের বৃহত্তর সেচ প্রকল্প মুহুরীর দুটি গেট পানির তোড়ে ভেঙে গেছে। অকেজো আছে আরও দুটি গেট। ফলে একদিকে জোয়ারের সময় ফেনী নদী হয়ে অভ্যন্তরে ঢুকছে বঙ্গোপসাগরের পানি। আবার ভাটার সময় দুটি গেট অকেজো থাকার কারণে পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে। এছাড়া মহাসড়ক কয়েকদিন অচল থাকায় মুদি দোকান ও কাঁচা বাজারে সকল পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। মহাসড়ক সচল হবার পরও অনেকে বেশি দাম নেয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
মীরসরাই উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রশান্ত চক্রবর্তী জানান, কিছু কিছু এলাকায় পানি কমতে শুরু করেছে। সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, যুব রেড ক্রিসেন্ট এ্যালমনাই, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন এবং শিক্ষার্থীরা পৃথকভাবে বানভাসি মানুষদের উদ্ধার এবং তাদের মাঝে বিশুদ্ধ পানীয়, ওষুধ ও খাবার বিতরণ করছেন।
অনেক গ্রামে এখনো বিদ্যুৎহীন। চট্টগ্রাম পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি–৩ বারইয়ারহাট জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার হেদায়েত উল্যাহ ও মীরসরাই জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার আদনান আহমেদ জানান, কিছু কিছু এলাকায় পানির তীব্রতা কমে যাওয়ায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হয়েছে। এখনো বন্যাকবলিত অধিকাংশ এলাকায় বিদ্যুৎ সেবা দেয়া যাচ্ছে না। তবে পর্যায়ক্রমে লাইন মেরামত করে সকল গ্রামেই বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হবে। পুনর্বাসনের শুরুতেই প্রাথমিক খাবার ও বিদ্যুতের প্রয়োজন বেশি বলে মনে করছেন অনেকে।