রমেশ শীল (১৮৭৭–১৯৬৭)। যিনি কবিয়াল রমেশ শীল হিসেবেই সমধিক পরিচিত। বাংলা কবিগানের অন্যতম রূপকার। কবিগানের লোকায়ত ঐতিহ্যের সাথে আধুনিক সমাজ সচেতনতার সার্থক মেলবন্ধন ঘটিয়ে তিনি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তিনি ছিলেন মাইজভাণ্ডারী গানের কিংবদন্তি সাধক। বাংলার লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতির অঙ্গনে কবিয়াল রমেশ শীল আপন মহিমায় সমুজ্জ্বল এক নাম। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায় অনুষ্ঠিত ‘নিখিল বঙ্গ প্রগতিশীল লেখক ও শিল্পী সম্মেলন’–এর অনুষ্ঠানে কবির লড়াইয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ কবিয়ালের মর্যাদা লাভ করেছিলেন। তাঁর গানের বাণী ছিল জনগণের কাছাকাছি। কবিয়াল রমেশ শীল ইংরেজি ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ৯ই মে চট্টগ্রামের বোয়ালখালির পূর্ব গোমদণ্ডী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম চণ্ডীচরণ শীল এবং মায়ের নাম রাজকুমারী দেবী। শৈশবে গ্রামের প্রাথমিক স্কুলে পাঠ নেবার সময় থেকেই কবিগানের আসরে গান শুনতে যেতেন তিনি। কবিওয়ালাদের গানের লড়াই আর তরজা গান তাঁকে ভীষণ টানতো। কখনো কখনো রমেশের বাড়ির উঠোনেই বসতো গানের লড়াই। মুগ্ধ হয়ে শুনতেন রমেশ আর মুখস্থ করে মুখে মুখে গাইতেন। সকলে তারিফও করতো। স্কুলে তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। কিন্তু মাত্র এগারো বছর বয়সে পিতৃহীন হলে লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে জীবন সংগ্রামে নেমে পড়তে হয় তাঁকে। রমেশ শীল কবিগানের সাথে পুরোপুরি যুক্ত হন যুবক বয়সে। কবিগানের প্রচলিত চিত্তবিনোদনের ধারা ভেঙে তিনি তাতে যুক্ত করেন অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক চেতনা। আন্তর্জাতিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি ছিলেন সচেতন। তাঁর গানের বাণী ছিল শান্তির পক্ষে।
সমসাময়িক নানা ঘটনা, সামাজিক, রাজনৈতিক বিভিন্ন বিষয়, যেমন, অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলন, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সূর্যসেন–প্রীতিলতার বীরত্বগাথা প্রভৃতি বিষয়ও তাঁর গানের অনুষঙ্গ হয়েছে। কোনো কোনো গানে কালোবাজারি, মুনাফাখোর, মজুতদার আর শোষকের বিরুদ্ধে ধ্বনিত হয়েছে তীব্র প্রতিবাদ। এসেছে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং শিক্ষাকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেবার আহ্বান। রমেশ শীল মাইজভাণ্ডারী তরিকারও অনুসারী ছিলেন। এই ধারা নিয়েও তিনি অনেক গান রচনা করেন। বাংলা একাডেমি থেকে তাঁর সমগ্র রচনাবলী প্রকাশিত হয়েছে। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে রাষ্ট্রীয় সম্মামনা একুশে পদকে (মরণোত্তর) ভূষিত করা হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন।