কবিতার শব্দে বিপন্ন মানবতার বোবাকান্না

করিম রেজা | শুক্রবার , ২৫ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:৫৩ পূর্বাহ্ণ

তুমি রাত্রি জেগে কাপড় কেটেছ,

আমরাও কেটেছিদিনের আলোতে তোমার প্রাকৃতিক আবরণ।

কবিতা: দর্জির ছেলের মৃত্যু

কাব্যগ্রন্থ : চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন

ছাত্রজনতার অভ্যুত্থানের পর দেশে একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের পেছনে ছোট ছোট অনেক অনুষঙ্গ ক্রিয়াশীল ছিল। গণইচ্ছার বিপরীতে নির্বাচন ব্যবস্থার পরিবর্তন, বিচার বিভাগে হস্তক্ষেপ, দুর্বিনীত দুর্নীতি, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আইন করে বাক স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণ, হেলমেট বাহিনী নামে পরিচিতি পাওয়া পেটোয়াবাহিনী লালন, গুমখুন,আয়নাঘরএমন আরও অনেক বিষয় এখন প্রতিদিন আলোচনার টেবিলে ঘুরপাক খাচ্ছে। আত্মসচেতন ও অনুভূতিসম্পন্ন মানুষের অস্বস্তি এতদিন চাপা থাকলেও একেবারেই অনুচ্চারিত থাকেনি। এমনই একটি শৈল্পিক উচ্চারণ নিয়ে আজ আলোচনা করবো।

২২ অক্টোবর ছিল কবি ময়ুখ চৌধুরীর জন্মদিন। একই তারিখে কবি জীবনানন্দ দাশের মৃত্যু হওয়ায় ময়ুখের জন্মতিথি চাপা পড়ে যায় আলোচনার মঞ্চ থেকে। আমার হাতের কাছাকাছি ময়ুখ চৌধুরীর দুটি কাব্য সংকলন থাকে বছরজুড়ে; প্রথমটি ‘ডান হাতের পাঁচটি আঙুল’ এবং দ্বিতীয়টি ‘পঞ্চবটী বনে’। কবিতাগুলো দারুণ কষ্টের সময় প্রতিষেধক হয়ে ওঠে, তীব্র হতাশার সময় নতুন স্বপ্নের ইঙ্গিত দেয়। এমনকি অর্থ বা ইঙ্গিতের দাবি ছাড়াও শুধু মনের আনন্দে একের পর এক কবিতা পাঠ করা যায়; দুষ্পাঠ্য বা দুর্বোধ্য মনে হয় না। ময়ুখ চৌধুরীর কবিতাগুলোতে ছন্দ এবং ইঙ্গিতের যেমন কারুকাজ আছে তেমনি আছে চিত্রকল্পের অনুপম ব্যবহার। চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন কাব্যগ্রন্থের কবিতা : ১৯৭১ পাঠ করে এক সন্ধ্যায় বন্ধু আব্দুল্লাহ আল হারুন ফোন দিয়ে বলল, শব্দ দিয়ে কীভাবে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা যায় তুমি একবার পড়ে দেখ কবিতাটি। কবিতাটিতে পাকিস্তানের পরাজয়কে কবি এক পঙক্তিতে এঁকেছেন এভাবে, ‘প্রচণ্ড দহনদীপ্ত পশ্চিমের সূর্য ডুবে গেল,’। একটি পাখির ঠোঁট, ডানা আর লেজের চিত্রকল্পে বাংলাদেশের মানচিত্রকে নির্মাণ করেছেন ময়ুখ চৌধুরী এই কবিতায়। সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন পাঠকের পক্ষেই কেবল যার পাঠোদ্ধার সম্ভব।

২০১১ সালের ৯ ডিসেম্বর এক হরতালের সকালে বিশ্বজিৎ দাস নামের একজন দর্জিকে প্রকাশ্য দিবালোকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। বাক্যটি ভাববাচ্যে লেখা হলেও এই হত্যাকাণ্ডের কর্তা কারা ছিল তা সেদিন পুরো দেশবাসী দেখেছিল। তখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছিল বিশ্বজিতের মর্মন্তুদ এক আকুতির কথা। খুনেবাহিনীকে বারবার সে বলছিল, “আমি …. নই, আমি হিন্দু, তোমরা আমার প্যান্ট খুলে দেখ।” খেয়াল করুন, সালটা ১৯৭১ নয়, ২০১১। সন্দেহ করা হয়, তৎকালীন সরকারের আনুকূল্যে এই হত্যাকাণ্ডের অধিকাংশ খুনী পরবর্তী সময় আদালতের বিচারে নির্দোষ সাব্যস্ত হয়। এই হত্যাকাণ্ড এবং পরবর্তী সময়ে তার বিচার দেশবাসীকে মর্মাহত করেছিল। কিন্তু এর মর্মাঘাত ছিল প্রকাশ্যে অনুচ্চারিত।

প্রকাশ্যে অনুচ্চারিত থাকলেও কবিতায় গোপন থাকেনি মানুষের মর্মবেদনা। ময়ুখ চৌধুরী এই হত্যাকাণ্ডের উপর দুটি কবিতা লিখেছেন। প্রথমটি ‘দর্জির ছেলের মৃত্যু’ এবং দ্বিতীয়টি ‘বাড়ি ফেরা’। দুটি কবিতাই ‘চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন’ কাব্যভুক্ত পাশাপাশি কবিতা। এখানে শ্লেষ আছে, দহন আছে, আরও আছে মূক মানবতার অবদমিত ক্রন্দন। সেই অবদমন ছিল দোর্দণ্ড রাজনৈতিক প্রতাপের রক্তাক্ত থাবার ছায়া।

কাব্যিক বিন্যাস মোতাবেক সারারাত নিজের পেশাগত কাজ শেষে বাড়ি ফিরছিলেন বিশ্বজিৎ দাস। কিন্তু দুষ্কৃতকারীরা তাকে প্রাণ নিয়ে বাড়ি ফিরতে দেয়নি। খুনীদের ভাষ্য কবির বর্ণনায় উঠে এসেছে এভাবে:

আমাদের বন্যতা তোমার বদান্যতার কথা মোটেও ভোলেনি,

তাই

ঋণ পরিশোধের যথাসাধ্য চেষ্টাও করেছি।

তুমি রাত্রি জেগে কাপড় কেটেছ,

আমরাও কেটেছিদিনের আলোতে তোমার প্রাকৃতিক আবরণ।

তুমি সেলাই করেছিলে আমাদের জামা,

আমরাও সেলাইয়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছি ময়নাতদন্তে।

উপায় ছিল না বলে

অন্তিম পোশাকটুকু সেলাই করে দিতে পারিনি এই যা।

(দর্জির ছেলের মৃত্যু/চরণেরা হেঁটে যাচ্ছে মুণ্ডুহীন)

বিশ্বজিৎ দাস, যে রাত জেগে দুপেয়ে মানুষের কাপড় কেটেছে, সেলাই করেছে, তাকেই দিনের আলোতে নির্মমভাবে কেটেছে এদেশের অমানবিক রাজনীতি। আর বিচার ব্যবস্থার ফাঁক আর ফাঁকিকে কাজে লাগিয়ে তার অন্তিম পোশাকটুকুও সেলাই করে ছেড়েছে ক্ষমতার অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতাপ। এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতাপ গণতন্ত্রকে জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ক্ষমতালিপ্সুদের পকেট টিস্যুতে পরিণত করেছে। সেই প্রতাপেরও শেষ দেখেছে এদেশের মানুষ।

বাড়ি ফেরা’ কবিতায় কবি কল্পনায় চিত্রিত হয়েছে শ্বাসকষ্টের রোগী বিশ্বজিতের মা, কালো বিড়ালের ছানা, লাল বালতিতে ভিজিয়ে রাখা কাপড়। বিশ্বজিৎ খুনেবাহিনীকে অনুনয় করছেন, ‘মাপ করে দাও। কৌতূহলবশে একটু দেখতে চেয়েছিলামরাজার পথের জন্য প্রজাদের কী কী দরকার। বড়ো ভুল হয়ে গেছে, তবুও আমাকে মেরো না।’

রাজার পথের জন্য (পড়ুন নির্বিঘ্ন ক্ষমতার জন্য) আসলে প্রজাদের কী কী দরকার? প্রশ্নটি সূক্ষ্ম অনুভূতিসম্পন্ন সকল মানুষের। কেউ উচ্চারণ করতে পারেন, কেউ পারেন না। এশুধু একটি পঙ্‌ক্তি নয়, রুদ্র প্রতাপশালী সকল শাসকের প্রতি সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসার সমাধান হওয়া উচিত। রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে নন্দিনী রাজাকে বলেছিল, আমার সমস্ত শক্তি দিয়ে তোমার সাথে আমার লড়াই। উত্তরে হেসেছিল রাজা, তাচ্ছিল্য করেছিল। বলেছিল, তোমাকে যে এই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পারি। নন্দিনীর উত্তরটাও ছিল চমক ধাঁধানো। সে বলেছিল, মুহূর্তে মুহূর্তে আমার সেই মরা তোমাকে মারবে। দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শাসকগণ জনগণের এই শক্তির কথা ভুলে যান। তাই মুহূর্তেই মেরে ফেলতে পরেন হাজারো নিরীহ মানুষ! নন্দিনী বলেছিল, ‘আমার অস্ত্র মৃত্যু।’ বিশ্বজিতদের মৃত্যু কবিতায় অমর হয়ে থাকবে বহুদিন। শাসকদেরকে জনগণের এই অস্ত্রের কথা কবিগণ স্মরণ করিয়ে দেন বারবার। তারপরও তাদের বোধোদয় হয় না। তাদের কাছে ক্ষমতাই চিরন্তন সত্য, মানবতা নয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধভালোবাসা জেগে থাকে
পরবর্তী নিবন্ধইনসাব পাঁচলাইশ থানা কমিটির উঠান বৈঠক