অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে এক অদ্ভুত প্রতিভার সমহারে জন্ম নেন নিরক্ষর কবি দায়েমুদ্দিন পণ্ডিত। ধারণা করা হয় প্রায় ১৮৩৫ সালের দিকে চট্টগ্রাম নগরের অদূরে কাট্টলী গ্রামে এই কবি জন্মগ্রহণ করেন।
কবি দায়েমুদ্দিন লেখাপড়া জানাত দূরের কথা, নিজের নামও লিখতে জানতেন না। কিন্তু বহুমাত্রিক এই নিরক্ষর কবি‘র রয়েছে বহু কবিতা ও গান। কথা বলতেন কাব্যগাঁথা ছন্দে ছন্দে।
তাঁর কাব্যিক পাণ্ডিতের গান ও কবিতা সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনতেন। ফলে সবার কাছে তিনি পণ্ডিত হিসাবে খ্যাতি লাভ করায় পরিচিত হয়ে উঠেন দায়েমুদ্দিন পণ্ডিত নামে।
কবি দেখতে ঘোর কালো ও লম্বা ছিলেন। তাঁর দাঁত অতিশয় মুক্তোরমত ধবধবে সাদা এবং তিনি তামাকসেবী ছিলেন না।
সুরসিক দায়েমুদ্দিন পণ্ডিত পরিচ্ছন্ন, সতত রঙ্গরসে ও আমোদ প্রমোদে কালাতিপাত করতে ভালোবাসতেন। তাঁর পিতার নাম কারকন। তাঁর এক ভাই ও এক বোন ছিলেন বলে জানা যায়। কবি‘র ন্যায় তাঁর ভাইও সুন্দর সুন্দর গান ও কবিতা রচনা করতেন বলে তাঁকেও লোকে পণ্ডিত নামে অভিহিত করত। তাঁর একপুত্র ও এক কন্যা সন্তান ছিল, তবে তাঁদের বংশবৃদ্ধি ঘটেনি। প্রচার আছে তাঁর পৈতিৃক নিবাস চট্টগ্রামের কাট্টলীতে ভিটেমাটি থাকলেও এর সঠিক সন্ধান মেলেনি।
নিরক্ষর কবি দায়েমুদ্দিন পণ্ডিত দীর্ঘ জীবন লাভ করেননি। সম্ভবত ১৮৭৫ সালে আনুমানিক ৫০ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
কবি দায়েমুদ্দিন চট্টগ্রামের বিখ্যাত প্রাচীন জমিদার মৌলভী হামিদ উল্ল্যাহ খাঁন বাহাদুরের সমসাময়িক ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। দায়েমুদ্দিনের এমনই কবিত্বশক্তি ছিল যে, তিনি কাওয়ালদের মত সব বিষয়ে মুখে মুখে সুন্দর সুন্দর গান ও কবিতা রচনা করতে পারতেন। বন্ধুসমাগনে তিনি বন্ধুদের লিখতে বলে নিজে মৌখিক গান ও কবিতা অনর্গল বলে যেতেন। এইরুপে তাঁর বহু কবিতাগান বন্ধুরা লিখে রাখলেও তা সংরক্ষণ করা হয়নি।
জমিদার হামিদ উল্ল্যা খাঁন বাহাদুরের কোনো এক সভায় কবি দায়েমুদ্দিন পণ্ডিত উপস্থিত ছিলেন। সে সময় কবির সাথে খাঁন বাহাদুরের কোনো পরিচয় ছিল না। সভায় উপস্থিত লোকজন তাঁকে পণ্ডিত বলে সম্বোধন করায় তাঁর কুৎসিত চেহারা ও চালচলন দেখে জমিদার হামিদ উল্ল্যার মনে কবি সম্বন্ধে অবজ্ঞা ও অবিশ্বাস জন্মালে তিনি তা পরীক্ষার জন্য কবিকে নিকটে ডেকে নেন এবং গান করতে বলেন। বলাবাহুল্য খাঁন বাহাদুর কবি‘র প্রথম সংগীত শুনেই মন্ত্রমুগ্ধ ও বাকরুদ্ধ হয়ে স্তম্ভিত ও অবাক নয়নে কবি‘র দিকে তাকিয়ে থাকেন এবং পুনঃ পুনঃ সেরুপ গান শুনার উৎসাহ প্রকাশ করেন। খাঁন বাহাদুর কবি‘র গুণে মুগ্ধ হয়ে তাঁর জন্য মাসিক বৃত্তি নির্দিষ্ট করে দেন।
আগেই বলা হয়েছে কবি দায়েমুদ্দিন পণ্ডিতের ১ ভাই ও ১ বোন ছিল। ভাইবোনকে কবি ভীষণ ভালোবাসতেন। বোনের
অকাল মৃত্যুতে কবি‘র হৃদয়ে বড় কষ্ট ও বেদনার জন্ম নেয়। সেই বেদনায় কবি তখন নিম্নের গানখানা রচনা করেন –
মন পাখিরে! তুমি বিবাদী হইয়ে চলে যাইও না
ভবে আসা যাওয়া কত যন্ত্রণা,
ও পাখি! তাই কি তুমি জান না?
সোনার পিঞ্জর ভরি রাখিলাম তোমা কত যতন করি,
যাইবার কালে যাইবে উড়ি
(ও পাখী! ) মুখে আল্লারছুল বল না ( রে পাখি)
এসেছিলে ভবের বাজারে, (রে পাখি) কার ফাঁকে ডুবলে এ সংসারে?
দমে দমে উড়ে পাখি মজে গেলে কার বাসনা!
দীন দায়েমুদ্দিনে কহে সে পাখিত আপন নহে,
যাইবার কালে যাইবে ছেড়ে আরত ফিরে চাবে না।
নগরীর হালিসহর নিবাসী মৃত আছদ আলী মালুমের পূত্র ইব্রাহিম সওদাগরের সাথে কবি‘র বিশেষ সখ্যতা ও সৌহার্দ্য ছিল। তাই কবি প্রায় সওদাগর বাড়ি যাতায়াত করতেন এবং কখনো কখনো রাতযাপনও করতেন।
দায়েমুদ্দিন কেবল একজন কবি ছিলেন না, তিনি সুকণ্ঠ গায়কও ছিলেন। ইব্রাহিম সওদাগরও তাঁর গানে মুগ্ধ হয়ে মাসিক সম্মানী দিতেন। অকস্মাৎ ইব্রাহিম সওদাগর মারা গেলে শোকাভিভূত হয়ে কবি যে গান লিখেন – তার প্রথমাংশ এইরূপ
‘বাছারে মোর ইব্রাহিম সওদাগর
আঁধার করিলি তুই হালিষসহর’
তখনকার দিনে বিয়ের আসরে গানবাজনা হত।
নীলাম্বর নামে একছেলের গান শুনে কবি লিখেন –
নীলাম্বর! সাকিন‘রে তোর বাঁশখালী গেরাম,
ও তুই পরাণের পরাণ।
যেমনি বেলা তেমনি গলা
গায় যেন কোকিলের স্বর
নীলাম্বর!
তোর ভাবেতে কল্য মোরে দেশান্তর।
মাও নাই বাপও নাই এতিমের সমান
ওরে তোরে সকলে করে মান।
তেমনি তদ্রূপ এক বিবাহের আসরে দিগম্বর নামক জনৈক সুসজ্জিত ঢোলী বালকের মনোমুগ্ধকর অভিনয় দেখে ও গান শুনে তৎক্ষণাৎ কবি গান লিখে ফেলেন। তার প্রথম কিয়দংশ নিম্নরূপ –
কি রূপ হেরিয়া আইসু মনেতে না মানে ধরা
রসে যশে দিগম্বর যেনরে আকাশের তারা
পিন্ধিছে সোনালী সাড়ী গলেতে
মুক্তোর ছরা।
তথ্য : আবদুস সোবহান ও শামস্ সাইমুম
লেখক : ছড়াকার। সাবেক জনসংযোগ কর্মকর্তা,
চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।