শব্দের সুন্দর নাকচাবি নিয়ে যে কবিতার বিষয় পরিবেশ বড় হতে দেখেছি, যে কবিতা বেঁচে থাকার আয়ুর্বেদ, সে মর্মের অনুনাদ থেকে যাকে পৃথকভাবে শনাক্ত করা যায়, তিনি কবি খুরশীদ আনোয়ার। অভাবিত সুন্দর চেতনা ও অনুভূতির বর্ণাঢ্য আভিজাত্য নিয়ে পাঠকের পাঠ সীমানা প্রসারিত করে চলেছেন বিগত কয়েক দশক ধরে। হাওয়ার মধ্যে শব্দ ছেড়ে দিয়ে পুনরায় উড়ানো ঘুড়ির সুতোর তল টেনে আনার মতন সক্ষম শব্দের স্বতন্ত্র কবি তিনি। অগাধ পর্যবেক্ষণ শক্তি, প্রগাঢ় অনুভূতির দাহ, সর্বোপরি শিল্পিত ঘোর তাঁর কবিতার অফুরন্ত প্রাণশক্তি। ছন্দের গতিতে প্রগাঢ় লিরিসিজম বা ভাবোচ্ছ্বাস পঙক্তির ঘূর্ণিতে চিত্রকল্পের উজ্জ্বল ব্যবহার ভিন্ন মাত্রিক আবহ এনে দেয়। পাঠক মাত্রই জানেন কবিতা প্রাত্যহিক জীবনের ভাষা নয়, কাহিল বা স্থুল আবেগের নয়। আবার দরবারি ভাষায় কুর্নিশ করাও নয়। কবিতা সুবর্ণ শক্তির আশ্চর্য ফোয়ারা। সংবেদ্য অনুভূতির প্রাণকেন্দ্র। কথাটি যারা এযাবতকাল বুঝে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে যিনি অধিক বুঝেছেন, তিনি প্রিয় মানুষ, সুসংহত মানুষের শুচিস্নিগ্ধজন কবি খুরশীদ আনোয়ার। কবিতার মতো ব্যক্তি স্বভাবেও তিনি সুশিক্ষিত সজ্জন, প্রাণবন্তজন। ব্রিটিশ উপনিবেশ–উত্তর বাংলা কবিতায় তিনি শব্দ ও বোধের চিরাচরিত স্বভাবে চর্চা করে এসেছেন এই অঞ্চলের জনগণের চর্চিত অনুষঙ্গ। তবে ধারণা ও মননে তিনি পুরোদস্তুর পাশ্চাত্যের আধুনিকতাবাদী। যুক্তি ও বুদ্ধির তীক্ষ্ম ধার তাঁর কবিতা কাঠামো বিন্যাস এবং করণ–কৌশল। উচ্চারিত অনুভূতি সর্বমানবের, সর্ব সমপ্রদায়ের। এবং কবি তাঁর সময় কালের কবিদের মতো প্রথামাফিক নন একেবারেই। মানুষের মনস্তত্ত্ব দৈর্ঘ্য – প্রস্থে মেপে ভাষার ভেষজপাতায় খুশবু ছড়িয়ে দিতে পারেন অনায়াসে।
কিছু কাব্যিক প্রকরণ এ–রকম ;
ক) সংহত উচ্চারণে প্রবহমান কাব্যভাষা
খ) প্রকাশের অভিনব যোজন
গ) শ্রেয়বোধে শিল্পোত্তীর্ণ
ঘ) সাংকেতিক আবহে কবিতার পঙক্তির আড়াল
ঙ) পরিমিতিবোধ আচ্ছন্ন শাব্দিক অনুভবনীয়তা।
চ) শব্দ ও বাক্যের অকুতোভয় সম্পর্ক।
ছ) বিষয় মানুষগুলো নানা মাত্রিক চরিত্রানুষঙ্গে বিভাজিত
জ) নিরীক্ষা ধর্মী– অন্তর্গঠন অনুচ্চস্বরের অনুগত
সহজিয়া ও ইন্দ্রজালে আবর্তিত কবিতা দেয়াল।
ঝ) কখনো সখনো পরাবাস্তববাদ কিংবা অধিবাস্তবতাবাদ কখনো আবার অদৃষ্টবাদ ভীষণ আক্রান্ত গজল হয়ে ওঠে।
তাঁর কিছু মুগ্ধ পঙক্তিমালা ;
১) ‘লোবানের শিরোনামে আগুনের শিখা থেকে ওড়াও সুরভি / স্বপ্নের টুকরো থেকে জন্ম নেয় স্বপ্নাতীত আসমানি কবি / অলৌকিক সুরা দেব এই আমি সংখ্যাহীন পারায় পারায় / জুলেখার স্পর্শ দাও, হে আল্লাহ,সঙ্গে কিছু অমৃত অন্যায়।’
২) ‘চেয়ারের উর্বরতা জন্ম দিচ্ছে
লক্ষ লক্ষ পঙ্গু চারাগাছ
বিকাশহীন শিশু,
৩) ‘হে আকাশঅলা,
চাঁদকে একটি ফুটবল করে দাও
খেলবো, খেলতে হবে।
….
নদী থেকে উঠে আসে কুয়াশার শিশু
আমার বাঁ দিকে কৃষ্ণ, মাঝে মোহাম্মদ
সর্বডানে ক্রুশবিদ্ধ যীশু।’
৪) ‘কেউ কেউ ভালো কখনো থাকে না
যারা বাম হাতে খায় বাঁ – দিকে ঘুমায়।’
শব্দ হলো কাব্যাত্মা। ভাষা উন্মোচন। সে–ই অভাবিত প্রগাঢ় অনুভূতির উন্মোচন করে চলেছেন কবি খুরশিদ আনোয়ার। তাঁর প্রতিটি কবিতার গভীর ভেতরে একটা কবিতা থাকে। সেটিই উজ্জীবিত মানবানুভূতির জীবন বোধের সারাংশ। ফরাসি কবি স্তেফান মালার্মে কবিতা সম্পর্কে বলেন ‘কবিতা শব্দের–ই বিশ্ব। একটি জড় শব্দের প্রাণ ফিরে পেতে প্রকৃত অনুভাবী অভিজ্ঞ একজন কবি–র দরকার হয়ে পড়ে। অনেক কসরতের পর প্রাণ স্পন্দন সঞ্চারিত হতে থাকে। প্রত্যেক শব্দ সংবেদ্য অনুভূতির ওপর একেকটি চকমকে হীরে পান্না। কবি খুরশিদ আনোয়ার, এর কবিতা পাঠ উত্তর আমার মনে হয়েছে, শব্দের ওপর শব্দ বসিয়ে তিনি শুধু ইমারত গড়েননি, শব্দ কে নতুন মাত্রায় অভিযোজিত করে অদ্ভুত ধরনের অনুভূতির সামনে পাঠকদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তাঁর কবিতাগুলো যতটুকু ব্যাখ্যার তারচেয়ে বেশি উপলব্ধি ও গভীর অনুভূতির। শব্দ সড়কের রাস্তা ভীষণ মসৃণ ভাবাবেগে উদ্দীপ্ত।
কবির অস্তিত্ব যাপনে সমাজ সন্ধিক্ষণের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ জড়িয়ে আছে। দহনের ঘ্রাণে পরিপুষ্ট সামাজিক অসংগতি কখনো সরাসরি কখনো বা পরাবাস্তববাদী অনুষঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে ওঠেছে। কখনো আবার মরমি দ্যোতনার ভাবাবেগে উচ্ছলিত পঙক্তি গড়িয়ে গেছে আধ্যাত্ম আখ্যানের দিকে। শব্দের সাহসে কবি অস্তিত্ব ও অনস্তিত্বের মহাক্ষরণে নিজেকে ব্যাপৃত রাখতে পারেন সবসময়ে। তবে, অনুভূতি ও শব্দের নৈকট্য লাভে তিনি ধ্যানমগ্ন আধুনিক মুসাফির।
তিনি কবিতা লিখতে এসে যেমন নিজেকে আড়াল করেছেন তেমনিভাবে তার সৃজনশীলতাকেও শিল্পিত আড়াল দিয়ে আলাদা করেছে দারুণ নৈপুণ্যে। তাঁর ভাষা ও বিষয় অনেকাংশে ব্যঞ্জনা মধুর সংবেদনশীল আধুনিক এবং স্মার্ট। স্বর সুষমা ঋদ্ধ গতিশীল। উত্তর–দক্ষিণ কোনো দিকে না ঘুরে, স্বেচ্ছাসৃষ্ট কাটা কম্পাস নিজের নিয়ন্ত্রণে রেখে কবিতা ও অনুবাদ করে চলেছেন আজও অবধি। কবি টিএস এলিয়ট, একটি মন্তব্য এখানে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। নিজের সঙ্গে নিজের অস্ত্রোপচারে যুক্ত থেকে নিজের আলোকিত আলাদা কবিতাকে বের করে আনতে হয়। যিনি যত সফলভাবে নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে ভঙ্গুর অনুভূতি জোড়া দিতে জানেন, তিনি ততই বড় কবি। কবি খুরশীদ আনোয়ার, এ–ই গোপন সৃজনশীল চর্চায় নিজেকে রচনা করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। প্রমাণ করতে পেরেছেন যাবতীয় চাপসৃষ্ট অনুভূতির সদর দরোজার ক্ষমতা ও ঐশ্বর্যশালী পুরুষ তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন এই কার্তিক কবি ভাষার যাদুকর। সাহিত্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি পেয়েছেন জীবনানন্দ উৎসব কতৃক প্রদত্ত আন্তর্জাতিক রূপসী বাংলা সাহিত্য পুরস্কার এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন দিয়েছে একুশে স্মারক সম্মাননা বিশ্বসাহিত্য পুরস্কার। চমৎকার পাঠ – উচ্চারণে স্বাভাবিক মাত্রার শব্দকেও ধ্বনির শাসনে ভিন্ন মাত্রা ও পরিবেশ সৃষ্টির সক্ষমতা রাখেন এ–ই কবি। অসাধারণ বাগ্মিতা তাঁকে বিশিষ্টতা অর্জনে সক্ষম করেছে। অনুবাদ করেছে সিলভিয়া প্লাথ ও উইলিয়াম ব্লেকের কবিতা। এ পর্যন্ত কবির মৌলিক কাব্যগ্রন্থ: হরিণাবৃত্ত রোদের চিল, দেশ নেই দেশান্তরেও নই, একপুরুষের রাধাচিন্তা, হালকা কবিতা, অর্ধেক মানুষ আর অর্ধেক হাওয়া, রুহের শায়েরি, কবিতা সমগ্র –১। ছড়া গ্রন্থ: মিষ্টিমজা ছড়ার ভাজা, ঘাস ফড়িংয়ের ঘুম। সম্পাদিত পত্রিকা: একাত্তর, আপাতত, চতুর্মাত্রিক।
খুরশীদ আনোয়ার আলংকারিক ধ্যানমগ্ন ধীমান কবি ও অনুবাদক। তাঁর কাব্যের প্রবণতা শুদ্ধতা, কেন্দ্রে মানুষ আর বিষয়ের ডুবো দর্শন। তিনি গহন গভীর মৌলিক প্রতিভাবান কবি। ন্বান্ন ধানের দেহের মতো কার্তিক এই কবি আমাদের প্রবল সম্মানিত অগ্রজ প্রিয়জন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।