বাংলায় বৃটিশ শাসনের অমানবিকতা, শোষণ, লুণ্ঠন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে এদেশের মানুষের মনে ঘৃণা ও ক্ষোভ ছিল গোড়া থেকেই। ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে সংবাদপত্র প্রকাশের পর এদেশবাসী প্রতিবাদের সেই সুযোগ পেয়ে যায়। যদিও প্রথম দিকের সংবাদপত্রের চরিত্র ছিল সমাজ সংস্কার এবং ধর্ম সংস্কারের আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিন্তু কালক্রমে সংবাদপত্র এদেশবাসীর জাতীয় মর্যাদা ও জাতীয় চেতনা প্রসারের এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
১৯২০ সালে ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টির জন্মের পর সংবাদপত্র জগতে আরেকটি শ্রেণীর আবির্ভাব হল কৃষক–শ্রমিকদের রাজনীতির অধিকার নিয়ে। কাজী নজরুল ইসলাম, মুজফ্ফর আহমেদ, আব্দুল হালিমের নেতৃত্বে প্রকাশিত হলো লাঙ্গল ও গণবাণী। নতুন মাত্রা সংযোজিত হল এদেশের রাজনীতিতে। সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতার ভাব ও ভাষা ও ভঙ্গিরও পরিবর্তন ঘটল। সাংবাদিকতায় প্রবেশ করল শ্রমিক– কৃষকের রুটিরুজি ও সংগ্রাম ও সংহতির কথা। উপনিবেশী শাসন, সমাজ, সংস্কৃতি থেকে বের হবার আহ্বান জানালেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর এই লেখনীর ধারাকে আমরা দেখতে পাই উপনিবেশিত জনগণের মানসিকতা, শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ তাবত জ্ঞানকাণ্ডে যে নেতিবাচক প্রভাব দেখা দিয়েছে তা চিহ্নিত ও নিষ্ক্রিয় করার লক্ষ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সক্রিয় হয়ে উঠলেন। যাকে বলা যেতে পারে উত্তর উপনিবেশায়নের সেই তত্ত্বের কথা যেখানে জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চা থেকে উপনিবেশিকতা বিদূরিত করে নিজের আত্মপরিচয় অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলামের অনেক সম্পাদকীয় নিবন্ধ বাঙালি তরুণ সমাজকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রেই শুধু নয় ক্রমান্বয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত নবযুগ পত্রিকাটি বাঙালি জাতীয়তাবাদের মুখপত্রে পরিণত হয়। শিরীন আখতার কাজী নজরুল ইসলামের সাথে নবযুগের সম্পর্কের মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, “নজরুলের সাংবাদিক জীবন শুরু হয় ‘নবযুগ’ দিয়েই। আবার তাঁর সাংবাদিকতার পরিসমাপ্তি ঘটে ‘নবযুগেই’। এদিক থেকে ‘নবযুগ’ বাংলা সংবাদপত্র ও সাহিত্যে এক বিশিষ্ট স্থান দাবী করতে পারে।”
নবযুগ পত্রিকাটি নতুন কলেবরে ১৯৪১ সালের অক্টোবর মাস হতে প্রকাশিত হয়। নবযুগ পত্রিকার প্রকাশ বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রার সংযোজন করে। বাংলার রাজনীতিতে ১৯৪১ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত সময়গুলি ছিল খুবই ঘটনাবহুল।
১৯৪১ সালে এ কে ফজলুল হক ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে যোগদান করায় মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় দলেই তিনি সমালোচনার শিকার হন। এরই প্রেক্ষিতে এ কে ফজলুল হক নবযুগ প্রকাশের ব্যবস্থা নেন। ফলে প্রথাগত সাংবাদিকতার গণ্ডি ডিঙ্গিয়ে নবযুগ নতুন মাত্রা যোগ করে। রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়। নবযুগের এই জনপ্রিয়তা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আবুল মনসুর আহমদ বলেছেন : “যথাসময়ের একটু আগে–পিছে ১৯৪১ সালের অক্টোবর নামে ধুম–ধামের সাথে ‘নবযুগ’ বাহির হইল। জোরদার সম্পাদকীয় লিখিলাম। সোজাসুজি মুসলিম লীগ বা সামপ্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কিছু বলিলাম না। মুসলিম বাংলার বাংলা দৈনিকের আধিক্যের প্রয়োজনের উপরেই জোর দিলাম। তোখড় সম্পাদকীয় হইল। অমনি জোরের সম্পাদকীয় চলিতে লাগিল। সবাই বাহ্ বাহ্ করিতে লাগিলেন ।”
কবি কাজী নজরুল ইসলামের নিজস্ব ঢংয়ে লেখা সম্পাদকীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মী ও জনসাধারণের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করে। সম্ভবত এ কারণেই প্রথাগত সাংবাদিকতার গণ্ডি ডিঙিয়ে নবযুগ নতুন মাত্রা যোগ করে। রাজনীতি, সমাজ, সাহিত্য ইত্যাদি নানা বিষয়ে কাজী নজরুল ইসলাম, আবুল মনসুর আহমদ, অমলেন্দু দাশগুপ্ত, শামসুদ্দীন আহমদ, মাওলানা আহম্মদ আলী ও শেখ আবদুল হাকিম প্রমুখ ব্যক্তিদের লেখার কারণেও নবযুগ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।
নবযুগ পত্রিকার প্রথম সংখ্যাতেই ‘নবযুগ’ নামে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা একটি কবিতা প্রকাশিত হয়। এই কবিতার মাধ্যমেই এটা পরিষ্কারভাবে প্রতীয়মান হয় যে, ‘নবযুগ’ জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার ধারক হিসাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। দৈনিক নবযুগকে উদ্দেশ্য করে লেখা ‘নবযুগ’ কবিতায় কাজী নজরুল ইসলাম লেখেন,
‘তাই নবযুগ আসিল আবার। রুদ্ধ প্রাণের ধারা
নাচিছে মুক্ত গগনের তলে দুর্ম্মদ মাতোয়ারা।
এই নবযুগ ভুলাইবে ভেদ, ভায়ে ভায়ে হানাহানি,
এই নবযুগ ফেলিবে ক্লৈব্য ভীরুতারে দূরে টানি‘।
দৈনিক নবযুগ পত্রিকাটির কার্যালয় ছিল লোয়ার সার্কুলার রোডে। শুরুতে কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদক হিসেবে বেতন পেতেন মাসিক ৩৫০ টাকা। এ ছাড়াও দৈনিক নবযুগের প্রতিষ্ঠালগ্নে মাওলানা আহম্মদ আলী ও অমলেন্দু দাশগুপ্ত সহকারী সম্পাদক, আবুল মনসুর আহমদ বার্তা সম্পাদক, বেনজীর আহমদ যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, মাহমুদ নূরুল হুদা ব্যবস্থাপক ও খান বাহাদুর হামেশ আলী খান মহা ব্যবস্থাপক ছিলেন।এ ছাড়াও সম্পাদকীয় বিভাগে খালেক দাদ চৌধুরী, অখিল নিয়োগী, কালীপন গুহ রায়, ব্রজেন্দ্র রায়, দেব নারায়ণ গুপ্ত, কাজী মুহাম্মদ ইদরিস, আবদুল কাদির নিয়োজিত ছিলেন।
অবশ্য ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত সান্ধ্য দৈনিক নবযুগের অভিজ্ঞতা কাজী নজরুল ইসলামকে পরবর্তীকালে নবযুগের সম্পাদক হিসেবে কাজে যোগদানে উৎসাহ যুগিয়েছিল। ১৯৪১ সালে দৈনিক নবযুগ প্রকাশিত তাঁর নবযুগ শীর্ষক কবিতা থেকেও তা জানা যায়। নতুন পর্যায়ে ‘নবযুগ’ এর উদ্বোধন উপলক্ষে কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন,
‘বিশ বৎসর আগে
তোমার স্বপ্ন অনাগত ‘নবযুগ’–এর রক্ত রাগে
রেঙ্গে উঠেছিল। স্বপ্ন সেদিন অকালে ভাঙিয়া গেল,
দৈবের দোষে সাধের স্বপ্ন পূর্ণতা নাহি পেল!’
নবযুগ পত্রিকাতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর সাংবাদিকতার মাধ্যমে সত্য ও সাহসী উক্তি করেছেন নিজের সম্ভাব্য ব্যক্তিগত ক্ষতির কথা আদৌ না ভেবে। তাঁর সাহিত্য ধর্মী সাংবাদিকতায় নগরকেন্দ্রিক সমাজ জীবন থেকে শুরু করে বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের গ্রামের অধিবাসীদের অভাব অভিযোগ, দাবি প্রত্যাশা সবই তুলে ধরার চেষ্টা করতেন।
১৯৪১ সালের ২২শে নভেম্বরে ‘নবযুগে’ প্রকাশিত ‘কেন আপনারে হানি হেলা’ শীর্ষক কবিতায় তার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। কবিতার পাশাপাশি কাজী নজরুল ইসলাম দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় অনেক প্রবন্ধ লেখেন। প্রবন্ধগুলির বেশিরভাগই ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত করে লেখা। ১৯৪২ সালের ১৬ই এপ্রিল তারিখে দৈনিক নবযুগ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় ‘বাঙালীর বাঙলা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি। অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে হতাশাগ্রস্ত বাঙালি জাতিকে সচেতন হওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলা হয় :
“ বাঙালী যে দিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পারবে ‘বাঙালীর বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে। সেদিন একা বাঙালীই ভারতকে স্বাধীন করতে পারবে। বাঙালীর মতো জ্ঞান শক্তি ও প্রেম শক্তি (ব্রেন সেন্টার ও হার্ট সেন্টার) এশিয়ায় কেন, বুঝি পৃথিবীতে কোন জাতির নেই। কিন্তু কর্ম–শক্তি একেবারে নেই বলেই তাদের এই দিব্যশক্তি তমসাচ্ছন্ন হয়ে আছে। তাদের কর্ম–বিমুখতা, জড়ত্ব, মৃত্যুভয়, আলস্য, তন্দ্রা, নিদ্রা, ব্যবসা–বাণিজ্যে অনিচ্ছার কারণ। তারা তামসিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে চেতনা–শক্তিকে হারিয়ে ফেলেছে।’
বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধ্যান ধারণার আলোকে লিখিত ওই প্রবন্ধে কাজী নজরুল ইসলাম আরো উল্লেখ করেন–
‘বাঙালী শুধু লাঠি দিয়েই দেড়শত বছর আগেও তার স্বাধীনতাকে অক্ষুণ্ন রাখতে চেষ্টা করেছে। আজো বাংলার ছেলেরা স্বাধীনতার জন্য যে আত্মদান করেছে, যে অসম সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে, ইতিহাসে তা থাকবে স্বর্ণ–লিখায় লিখিত। বাংলা সর্ব ঐশী শক্তির পীঠ স্থান। হেথায় লক্ষ লক্ষ যোগী মুনি ঋষি তপস্বীর পীঠস্থান, সমাধি; সহস্র সহস্র ফকির–দরবেশ ওলী–গাজীর দর্গা পরম পবিত্র। হেথায় গ্রামে হয় আযানের সাথে শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনি। এখানে যে শাসনকর্তা হয়ে এসেছে সেই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলার আবহাওয়ায় আছে স্বাধীনতা মন্ত্রের সঞ্জীবনী শক্তি। আমাদের বাংলা নিত্য মহিমাময়ী নিত্য সুন্দর, নিত্য পবিত্র।”
দৈনিক নবযুগের এই সম্পাদকীয় নিবন্ধটির শেষাংশ ছিল উদ্দীপনামূলক। ব্রিটিশ পরাধীনতা থেকে বাঙালিকে জেগে উঠার উদাত্ত আহ্বান জানিয়ে নিবন্ধে লেখা হয়েছিল : বাঙালিকে, বাঙালির ছেলেমেয়েকে ছেলেবেলা থেকে শুধু এই এক মন্ত্র শেখাও :
‘এই পবিত্র বাংলাদেশ
বাঙালীর আমাদের।
দিয়া ‘প্রহারেন ধন জ্ঞয়‘
তাড়াব আমরা, করি না ভয় যত পরদেশী দস্যু ডাকাত
‘রামা’দের ‘গামা’দের।“
বাঙলা বাঙালীর হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালীর জয় হোক! ”
‘বাঙলা বাঙালীর হোক‘ বলে কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯৪১ সালে নবযুগ পত্রিকায় যে ডাক দিয়েছিলেন তা ব্যর্থ হয় নি। বলা যায় বিশ শতকের চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা এবং নবযুগ পত্রিকার মাধ্যমে প্রকাশিত কবিতা, নিবন্ধ বাংলার গণমানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে শুরু করে। এর মধ্যে আমরা দেখতে পাই উত্তর উপনিবেশবাদ বা বিউপনিবেশায়নের ধারাটি। কবি কাজী নজরুল ইসলামের নবযুগ বৃটিশ শাসকদের মনে কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এই তেজস্বী বিপ্লবীর ক্ষুরধার কলম সশস্ত্র বিপ্লবের বাণী প্রচার করেছিল সেদিন। নবযুগ পত্রিকার বিপুল প্রচার সংখ্যাই প্রমাণ করেছিল যে জনসাধারণকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করতে পারা যায় সংবাদপত্রের দ্বারা। তাঁর রচনার সাধারণ আলোচ্য বিষয় ঔপনিবেশিক শাসন, তার প্রক্রিয়া ও কুফল এবং তার প্রতিক্রিয়া ও মোকাবেলা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ তিনি স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং তাতে অংশও নিয়েছিলেন। ফলে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ধারাটি ছিলে তাঁর সাহিত্যকর্মে বহমান। যেমন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ রচনায় উপনিবেশবাদের বা সাম্রাজ্যবাদের প্রকট বিরোধিতা তিনি তাঁর লেখায় তুলে ধরেছেন। সামপ্রতিক সময়ের উপনিবেশায়ন কিংবা উত্তর উপনিবেশবাদ তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণা অনেক পাশ্চাত্য লেখকের আগেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন তাঁর সাহিত্যকর্মে এবং তাঁর সম্পাদিত সংবাদপত্রে।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রাক্তন উপ উপাচার্য, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।